অস্থির সময়ে দরকার সুস্থির অর্থনীতি
বিশ্ব এক অস্থির সময় পার করছে। মূল্যস্ফীতি এখন এক গ্লোবাল ফেনোমেনা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সবখানেই এখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এটির একটি বড় কারণ অস্থির যুদ্ধ। ফ্রি ক্যাপিটাল ফ্লো বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। সত্যি কথা হলো–ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে পৃথিবী কিন্তু আর আগের মতো থাকবে না। অর্থনীতিসহ অন্যান্য দিক বিচার-বিবেচনা করে বলা যায়, আগামীতে পৃথিবীর অন্য চেহারা মানুষ দেখবে।
ইতিমধ্যেই আমরা এক নতুন বিশ্বের আঁচ পাচ্ছি। যেমন বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্র দেশগুলো যে মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেন করে থাকেন, সেই সুইফট সিস্টেম রাশিয়ার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন চীন ও রাশিয়া একজোট হয়ে ডলার সিস্টেমকে বাদ দিয়ে, অন্যমুদ্রাভিত্তিক লেনদেন শুরু করেছে। এমনকি সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতও বলেছে, চাইনিজ কারেন্সি (ইউয়ান) ব্যবহার করে তেল বিক্রি করবে। তাহলে ১৯৪৬ সাল থেকে যে ডলার সুপ্রিমেসি ছিল, সেটি এখন ঝুঁকির মুখে।
বাংলাদেশও এই অস্থির বিশ্বব্যবস্থার বাইরে না। অনেক প্রডাক্ট বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে খাদ্যে এক বৈশ্বিক অভাব দেখা দিবে। সংকট না বললেও এটি এর থেকে খুব কম কিছুও না। গম অথবা চাল, যা-ই বলি না কেন; বাংলাদেশ কিন্তু আমদানি করে এবং এখন বেশি দামেই আমদানি করতে হচ্ছে। মুদ্রা বিনিময়ের হার ৮৫ শতাংশের কাছাকাছি ছিল, সেটি এখন ৯০ শতাংশের কাছাকাছি চলে গেছে। কাজেই বাংলাদেশি মুদ্রাও চাপের মুখেই আছে।
শ্রীলঙ্কাতে আমরা দেখেছি, করোনাকালে দুই বছর পর্যটন খাত বন্ধ ছিল। আরেকটি বিষয় হলো–ঋণের কিস্তি দেওয়ার সময় শুরু হয়ে যাওয়ায় তাদের ঋণ শোধ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনো তা সীমার মধ্যে আছে। তবে এ কথাও মাথায় রাখতে হবে যে, যখন যেখান থেকে খুশি ঋণ নেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের রেকর্ড যেহেতু ভালো, সেজন্য অনেকেই আমাদের কাছে ঋণ বিক্রি করতে চাচ্ছিল। বাংলাদেশ বাণিজ্যিক ঋণ নেয়নি সেভাবে; কিন্তু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন কারণেই ঋণের বোঝা বেড়েছে, বাড়ছে। যখন ঋণ পরিশোধের সময় শুরু হয়ে যাবে, তখন বাংলাদেশের ইকোনমি সমস্যার মুখে পড়বে।
তবে বাংলাদেশ উতরে যেতে পারে যদি রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়তে থাকে। গত দুই-তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে ক্যাপিটাল ইন ফ্লো সেভাবে হয়নি। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে। তারা ঋণ করে ঘি খেয়েছে। পাকিস্তানও তা-ই করেছে। পাকিস্তানের বর্তমান সরকার কিন্তু আইএমএফের কাছেই ধর্ণা দিচ্ছে।
বাংলাদেশ বেশ কয়েকবছর যাবৎ আইএমএফ থেকে ঋণ নেয় না। এডিবি, বিশ্ব ব্যাংক থেকে আমরা নিয়েছি। তবে এখনো আশাবাদী থাকা যায়, খুব বেশি সমস্যার মুখে হয়তো পড়ব না। তবে সতর্ক থাকতে হবে।
ঋণের সঙ্গে আরেকটি শঙ্কার কারণ মূল্যস্ফীতি। এটি থেকে বাংলাদেশ বাঁচবে না। মূল্যস্ফীতি হবেই কিছু। সরকার যেটি করছে–এক কোটি মানুষকে ভর্তুকি দেওয়ার ফলে বাজেটের উপরে চাপ সৃষ্ট হবে অবধারিতভাবেই। ভর্তুকি স্থায়ী সমাধান নয়। তাই তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে ভর্তুকি বিষয়টিই অদরকারি হয়ে পড়বে। ভর্তুকি দিলেও দরিদ্র লোকের সংখ্যা বাড়বে এবং তাদেরই সমস্যা বেশি হবে।
মূল্যস্ফীতির বড় আক্রান্ত সমাজের দরিদ্র মানুষগুলো। সরকার যা করছে, তার বিকল্প নেই। তবে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে সাবধান থাকতে হবে। আমাদের ভ্যাট পেমেন্টটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কাপড় অনুযায়ী কোট সেলাই যারা করে না, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। অস্থিরতা থেকে মুক্তি আমরা খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব, আমরা সেটি মনে করছি না। আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
নিজেদের টাকার মূল্যমান ধরে রাখতে হবে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা রপ্তানি করছি কম, আমদানি করছি বেশি। এ অবস্থারও পরিবর্তন দরকার। আমদানির ক্ষেত্রেও বুঝে শুনে আমদানি করতে হবে। এখন ক্রান্তিকাল যাচ্ছে। কাজেই শ্রীলঙ্কা পাকিস্তানের বিষয়টি আমাদের মনোযোগের সঙ্গে দেখতে হবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। আমাদের ইকোনমি কিন্তু এখন বেশ বড়। সেদিকে নজর রাখতে হবে। কাজেই যা অর্জিত হয়েছে, তা ধরে রাখা আর সামনের দিনে যেন বিপদের দিকে পড়তে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা খুব জরুরি।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এসএ/