ভাইরাল! ভাইরাল!!
এখন ভাইরাল যুগ চলছে! ভাইরাল হতে কেনা চায়! সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়! ভাইরালের ভালো-মন্দ দুটি দিকই রয়েছে; কিন্তু সবাই কী আর ভালো-মন্দের বিষয়টি নিয়ে ভাবে! যেভাবেই হোক, ভাইরাল হওয়ার দিকেই যেন সবাই দৌঁড়াচ্ছে! কারণ এতে একদিকে খ্যাতি, অন্যদিকে যোগ হচ্ছে অর্থ। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এতে অপসাংবাদিকতারও বিস্তার ঘটছে!
সবাই চায় তার সৃষ্টি বা কাজ যেন সবাই পড়ে, দেখে বা শোনে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার জন্য অর্থ পাওয়ার সুযোগ থাকায় অনেকে একে পেশা হিসেবেও নিয়েছে। অনেক ইউটিউবার আছেন যারা শিক্ষা, ডাক্তারিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কনটেন্ট তৈরি করে একদিকে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন; অন্যদিকে আশাতীত অর্থ উপার্জনও করছেন। এতে শিক্ষার্থীসহ অনেকে উপকৃতও হচ্ছেন। এটা হলো ইতিবাচক দিক।
একইভাবে বিভিন্ন নিউজ কনটেন্ট টিভি, পত্রিকাসহ সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমেও ভাইরাল হচ্ছে। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য অর্থ আয় হচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মিডিয়া থেকে আয় বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয়কেও ছাড়িয়ে গেছে! এ কারণে এখন টিভি, পত্রিকাসহ সব মিডিয়া ডিজিটাল কনটেন্ট থেকে যত বেশি আয় করা সম্ভব, তার দিকে জোর দিচ্ছে। তাই পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন সব প্রতিষ্ঠানেই ডিজিটাল মিডিয়া নামে আলাদা বিভাগ চালু হয়েছে। এই বিভাগের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো–ভাইরাল হয় এমন কনটেন্ট খুঁজে বের করা এবং তৈরি করা। আর তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নিজেদের কনটেন্ট ভাইরাল করার জন্য টাকা খরচ করে ‘বুস্ট’ও করে!
আবার কোনো কোনো টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ রিপোর্টারসহ, সারাদেশের প্রতিনিধিদের ক্রমাগত চাপ দেয় ভাইরাল হয়-এমন নিউজ তৈরি করতে! তাদের পারফরম্যান্স এখন এই ভাইরাল নিউজের উপরই নির্ভর করছে। অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাল হওয়া নিউজ থেকে পাওয়া অর্থের একাংশ সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার বা প্রতিনিধিদের দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের ক্ষেত্রেও এটি মুখ্য হয়ে উঠেছে!
এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, যারা সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁক-ফোঁকর গলিয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনো কন্টেন্ট শুধু আপলোড করে ভাইরাল করতে পারে, তাদের এখন পোয়াবারো। কারণ ভাইরাল করতে পারলেই তো অর্থ আসে। আর তাদের পরামর্শেই কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে মূল সংবাদ বিভাগে অ্যাসাইন্টমেন্ট দিতে হয়। কর্তৃপক্ষের সুনজরে থাকা এসব আপলোডারই এখন সেখানে ছড়ি ঘোরায়।
মূলধারার প্রতিদিনের সংবাদ তেমন ভাইরাল হয় না। ক্যামেরার সামনে বেফাঁস কথাবার্তা, আর হালকা, চটুল, মুখরোচক সংবাদই বেশি ভাইরাল হয়। অবশ্য কোনো কোনো ভালো প্রতিবেদন, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও যে ভাইরাল হয় না এমন নয়। অবশ্য তার পরিমাণ কম। তাই প্রতিদিন ভাইরাল সংবাদ তৈরি করতে গিয়ে অপকৌশলের, অপসাংবাদিকতারও আশ্রয় নিতে হয়! এতে কোনো কোনো রিপোর্টারের বক্তব্য–তারা শুধু ভাইরাল হবে এমন নিউজের সাংবাদিকতা করে ফেসবুক বা ইউটিউব সাংবাদিক হতে চায় না। এতে করে প্রচলিত সাংবাদিকতা অনেক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভাইরাল হওয়া নিয়ে কিছু খবরও গণমাধ্যমে বেরিয়েছে।
‘টিএসসিতে বৃষ্টির মধ্যে তরুণ-তরুণীর ছবি তুলে সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে আলোচিত-সমালোচিত সেই ফটো সাংবাদিক জীবন আহমেদ মারধরের শিকার হয়েছেন। মারধরের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে দিচ্ছেন বলে নিজের ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। তিনি একটি অনলাইন পোর্টালে কর্মরত ছিলেন। বুধবার জীবন আহমেদ তার নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ কথা জানান। চাকরি ছাড়ার কারণ হিসেবে জানা যায়, সেই ভাইরাল হওয়া ছবি তোলার অপরাধে নিজের পেশার লোকদের হাতেই মারধরের শিকার হন তিনি।’ (যুগান্তর অনলাইন সংস্করণ, ২৪ জুলাই ২০১৮)
‘বাংলাদেশি এক সাংবাদিকের চিড়িয়াখানায় খাঁচাবন্দি একটি বাঘের সঙ্গে কথা বলার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশি একটি পেজ থেকে ভিডিওটি ভাইরাল হলে তা নজর কাড়ে মিডিয়া বিষয়ক একটি পেজের। আন্তর্জাতিক পেজটিতে ভিডিওটি শেয়ার করে লেখা হয়েছে, ‘বাঘের সঙ্গে একজন সাংবাদিকের কথা বলা ও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।’ (ইনকিলাব, ১৫ মে ২০২১)
এ রকম আরও বহু খবর গুগলে সার্চ দিলেই বেরিয়ে আসবে! এমন অনেক খবরও আছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, ভাইরাল হওয়ার কারণে অনেককে সামাজিকভাবে চলাফেরা করতে সমস্যা হচ্ছে। তাই সুষ্ঠু সাংবাদিকতার স্বার্থে; সাংবাদিকতা ও ভাইরাল নিয়ে আলোচনা, সচেতনতার প্রয়োজন আছে বৈকি।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক
এসএ/