প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভিন্ন ভাবনা
বাংলাদেশ যে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ, এটি কেউ অস্বীকার করবেন না। পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভূতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের অবস্থান, এরই সঙ্গে উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা এবং দেশজুড়ে প্রায় চারশত নদীর নেটওয়ার্ক–সব মিলিয়ে যত ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা ভাবা যায়, এক সুনামি ছাড়া প্রতিটিরই শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ।
সমুদ্র উপকূলবর্তী অন্যান্য দেশের তুলনায় বঙ্গোপসাগরের মৃদু ঢাল প্রায় ২০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত বলে সুনামি থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি; কিন্তু বন্যা, খরা, সাইক্লোন, টর্নেডো, অতিবৃষ্টি, ভুমিধস, পাহাড়ধস ইত্যাদি প্রতি বছরের ঘটনা। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলের উপর আমাদের অবস্থান বলে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনাও নিত্যই থাকে। এর সঙ্গে তো জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি রয়েছেই।
গত কয়েক বছরে বজ্রপাতের কারণে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। কেউ বলছেন, যত্রতত্র মোবাইল ফোনের টাওয়ার বসানোর ফলে এটি বেড়েছে। কেউ বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এটি বেড়েছে। আসলে কেন বাড়ছে, সেটি নিশ্চয়ই গবেষণার বিষয়। তবে বাস্তবতা হলো–এটি এতটাই বেড়েছে যে, সরকার বাধ্য হয়ে সম্প্রতি এটিকেও একটি জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে।
প্রতি বর্গ কিলোমিটারে সহস্রাধিক জনবসতির এই দেশটিতে এত ধরনের দুর্যোগ হলেও দেশটি কিন্তু কেবল সৃষ্টিকর্তার কৃপার উপর ভরসা করে চুপচাপ বসে নেই। সরকার এবং বেসরকারি পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে যুক্তভাবে কাজ করেছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি, যার কারণে বিশ্বব্যাপী আমরা রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছি।
যে কোনো সাইক্লোনের পুর্বাভাস হলে রেডিও-টিভিতে বিভিন্ন বন্দরে এই যে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত বা ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের কথা আমরা শুনি। এগুলো অন্য কোনো দেশ থেকে আমরা আমদানি করিনি বা শিখিনি। এগুলো আমাদের দেশেই সৃষ্টি করে অন্য দেশকে আমরা শিখিয়েছি। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য উপকূলের জেলাগুলোতে লাখো ভলান্টিয়ার তৈরি করা হয়েছে, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যে জেলাগুলোতে বন্যা নিয়মিত হয়, সেগুলোতেও এভাবেই শত-সহস্র ভলান্টিয়ার তৈরি করা আছে।
বাংলাদেশে বন্যার রেকর্ড করা হয়েছে ১৭৮১ সাল থেকে। এগুলো বিশ্লেষণ করেই বিশেষজ্ঞরা নানা পদক্ষেপ নেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভোলায় যে সাইক্লোন হয়েছিল, তাতে এক রাতে পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হন। বিশ্বব্যাপী কোনো সাইক্লোনে মৃত মানুষের এটিই সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর পরও বাংলাদেশে বড় বড় সাইক্লোন হয়েছে, কোথাও বা আড়াই লাখ মানুষ, বা সোয়া লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন। সেখান থেকে কমিয়ে মৃতের সংখ্যা এখন ১০ জনের নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। এটি চাট্টিখানি কথা নয়। কতটা পরিকল্পনা করলে এবং তার কতটা বাস্তবায়ন করলে এটি সম্ভব? তবে এখনো যে কোনো বড় সাইক্লোনে ফসলের ক্ষতি, বনাঞ্চলের ক্ষতি, অবকাঠামোর ক্ষতি, মানুষের জীবিকার ক্ষতি–এগুলো তো রয়েই গেছে। মাঠে ফসল থাকলে জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতি তো হয়ই, সাগরের নোনা পানির কারণে মাটির যে ক্ষতি হয়, কয়েক বছর লাগে তার উর্বরতা ফিরিয়ে আনতে। ২০০৭ সালের সিডর এবং ২০০৯ সালের আইলা’র উপর্যুপুরি আঘাত আমাদের উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
বন্যা বা সাইক্লোন যখন হয়, বিস্তীর্ণ অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে ওই অঞ্চলের সব মানুষই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। তবে এর মধ্যেও একটু বেশি ঝুঁকিতে পড়ে কিছু মানুষ। যেমন–শিশু, বয়ষ্ক, অসুস্থ্য, গর্ভবতী; কিন্তু তার চেয়েও বেশি ঝুঁকিতে পড়ে প্রতিবন্ধীরা। এ ছাড়াও, প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায়, তার চেয়েও বেশি মানুষ আহত হয়, এবং এর মধ্যে একটি বিরাট সংখ্যক মানুষ স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। এ কারনেই বলা হয়ে থাকে যে দুর্যোগ এবং প্রতিবন্ধিতার একটি নিবিড় আন্তসম্পর্ক রয়েছে।
টর্নেডো যে কোনো জায়গাতেই হতে পারে। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, বা ময়মনসিংহ ইত্যাদি জেলার কিছু অঞ্চল আছে, যেগুলিতে প্রায় প্রতিবছরই টর্নেডো হয়। বন্যা বা সাইক্লোনের মত টর্নেডোতে কোনো পুর্বাভাস পাওয়া যায় না। হঠাৎ করেই ছোট একটি এলাকাতে প্রবল ঘুর্ণিবায়ু আরম্ভ হয়ে যায়, বাড়িঘর গাছপালা সব তছনছ করে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার শেষ হয়ে যায়। বাড়ীর টিনের চালাগুলি ঘুড়ির মত উড়তে উড়তে দুমড়ে মুচড়ে যায়; কিন্তু এরই মধ্যে মানুষের হাত-পা কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কী পরিমাণ মানুষ শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, তার হিসেব নেই। অথচ, সাইক্লোন বা টর্নেডোর পর সরকারী অনুদান প্রাথমিকভাবেই যা আসে, তার মধ্যে থাকে ঘর পুনর্নিমাণের জন্য ঢেউটিন। এগুলোই পরবর্তী সময়ে আবার নতুনভাবে মানুষের হাত-পা কেটে প্রতিবন্ধী বানিয়ে দিচ্ছে।
প্রতিবেশী দেশে, বিশেষ করে কলকাতায় যাওয়ার সময় প্লেন থেকে নিচে তাকালে বাড়িঘর দেখেই আঁচ করা যায় কখন আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করা হলো। এদিকে চকচকে টিনের চাল আর ওপাশে লাল রঙ্গা টালির ছাদের পার্থক্য চোখে পড়বেই। উপকূলীয় এবং টর্নেডোপ্রবণ এলাকাগুলোতে টিনের পরিবর্তে টালির ছাদ ব্যবহার করা হলে হাত-পা কাটার ঝুঁকি যেমন কমানো সম্ভব, একই সঙ্গে প্রায় হারিয়ে যাওয়া মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন করা সম্ভব। বিষয়টি ভাবা দরকার।
বাংলাদেশে যত ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, এর যে কোনোটি সামাল দেওয়ার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি, উদ্ধার, কেন্দ্র পরিচালনা, পুনর্বাসন ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরে কার কী দায়িত্ব রয়েছে, কীভাবে তা গ্রহণ করা হবে, পুরো ব্যবস্থা কীভাবে সমন্বয় করা হবে, ইত্যাদি সব বিষয়াদি সমন্বিত করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টার’ নামে একটি নির্দেশিকা প্রণয়ন করে। এরপর আবার কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে এটিকে সম্প্রসারণ ও পরিমার্জন করে ২০১৯ সালে এটিকে আপডেট করা হয়েছে।
এই ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টার’-এ প্রতিবন্ধী মানুষদের কথা বিশেষ যত্নের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত সব কমিটিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা তাদের সংগঠনের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়েছে, যেন পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন, সব স্তরেই প্রতিবন্ধী মানুষের বিশেষ চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তার বিষয়গুলো ভাবা হয়। দুর্যোগ-পূর্ববর্তী সময়ে যখন এলাকার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়, তখন প্রতিবন্ধী মানুষদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও এই নির্দেশিকায় বলা আছে। মন্ত্রণালয়টির এই উদ্যোগটি অবশ্যই প্রসংসার দাবি রাখে। শুধু তা-ই নয়, ঢাকায় ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে দুর্যোগ ও প্রতিবন্ধিতা শীর্ষক ১ম ও ২য় আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে এই মন্ত্রণালয়টি আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসা কুড়িয়েছে, এবং এই বিষয়েও গ্লোবাল পাইওনিয়র হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। সম্মেলনে গৃহীত ‘ঢাকা ঘোষণা’ জাতিসংঘ থেকেও স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বের সব দেশকে দুর্যোগ ব্যবস্থার উপর জাতীয় প্রতিবেদন জাতিসংঘে প্রেরনের জন্য প্রস্তুতিতে এই ঢাকা ঘোষোনাকে আমলে নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
তবে যে কোনো দুর্যোগের সময় সকল সেবার সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকলেও সরকার একাই যে সকল কার্য পরিচালনা করে, তা তো নয়। অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানও আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে আসে। ব্যক্তি উদ্যোগেও নানা কর্মসুচী হাতে নেয়া হয়। সকলেই যে প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয় মাথায় রাখে, তা তো নয়। এমনকি সরকারি উদ্যোগেও যে সমস্যা হচ্ছে না, তাও তো নয়!
উপকূলীয় জেলাগুলিতে যতগুলি সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে, তার অধিকাংশই বেশ পুরনো। নতুন করে যে শেল্টারগুলি নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলির ডিজাইনেই উইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষের প্রবেশগম্যতার করা ভাবা হয়েছে। কিন্তু পুরনোগুলোতে আর সেই সুযোগ নেই। তাহলে শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ কিভাবে সেগুলি ব্যবহার করবে? ভলান্টিয়াররা হয়তো চ্যাংদোলা করে তাদের উপরে তুলে দিল। কিন্তু সেগুলিতে তো কোনো প্রবেশগম্য টয়লেটের ব্যবস্থাও নেই। তাহলে এই মানুষগুলো দীর্ঘক্ষণ শেল্টারে থাকতে হলে কিভাবে সময়যাপন করবে?
শেল্টারে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা কক্ষ রাখা হয়। নারীদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে পুরুষ, বা পুরুষের কক্ষে নারীদের প্রবেশের সুযোগ নেই। একটু ভাবুন তো একজন বয়ষ্ক শারিরীক প্রতিবন্ধী মানুষের কথা, যাকে দেখাশোনা করার জন্য স্ত্রী বা মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই, তাকে কোন কক্ষে রাখা হবে? আপদকালীন সময়টিতে তার দেখাশোনা কে করবে? তার প্রস্রাব-পায়খানা কে পরিষ্কার করে দেবে? গাদাগাদি করে থাকা মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিক এই কাজগুলো করে ফেলার পর কী পরিমাণ গালমন্দ সহ্য করতে হবে অন্যান্য মানুষদের কাছ থেকে?
একটি পরিবারে ৩৫/৩৬ বছর বয়সের একজন মেয়ে রয়েছে, যার মানসিক রোগের কারণে গায়ে কোনো কাপড় রাখে না। মেয়েটিকে সারাবছর একটি ঘরেই আবদ্ধ করে রাখা হয়। সাইক্লোনের কারণে এই পরিবারটিকে সাইক্লোন শেল্টারে চলে যেতে হবে। এখন এই মেয়েটিকে কি তারা নিয়ে যেতে পারবে? নাকি তাকে বাসায় আবদ্ধ রেখেই বাকিরা চলে যাবে? নিয়ে গেলে শেল্টারে তাকে সামাল দিবে কীভাবে? রেখে গেলে সে বাঁচবে তো? এমন ঘটনা বহু পরিবারে আছে আমাদের দেশেই। আমরা কেউ কি ভেবে দেখেছি এই পরিবারগুলোর চ্যালেঞ্জের কথা?
প্রতিবন্ধী মানুষের কথা যখন বলা হয়, তখন শুধু যে উইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের কথা বলা হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের আইনেই প্রতিবন্ধিতাকে ১০টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যারা চোখে দেখতে পায়না, তাদের সঙ্গে যারা শুনতে পায়না এবং কথা বলতে পারে না, তাদের চ্যালেঞ্জগুলি নিশ্চয়ই একইরকম নয়। আবার এমন অনেকেই আছে, যারা দেখতেও পায় না, শুনতেও পায় না এবং কথাও বলতে পারে না। তাদের চ্যালেঞ্জগুলি আরও বেশী মারাত্মক। এমন মানুষ থাকতে পারে, সেটিই কি আমরা কখনও ভেবে দেখেছি? বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বা অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন মানুষের চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তাগুলোও তো একেবারেই ভিন্ন। সেরেব্রাল পালসি (সিপি) এর মত জটিল প্রতিবন্ধী মানুষের চাহিদাগুলোও আবার একেবারেই ভিন্ন। এগুলো কোনোটিই কিন্তু বিরল নয়। আমাদের যে কোনো গ্রামে বা শহরে এই ভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ পাওয়া যাবে।
সাইক্লোনের ক্ষেত্রে মানুষকে শেল্টারে থাকতে হয় অল্প সময়ের জন্য। বড়জোর এক বা দুদিন। মূল পানি নেমে গেলেই তারা যারযার এলাকায় ফিরে যেতে পারে। কিন্তু বড় রকমের বন্যা হলে থাকতে হয় দীর্ঘ সময়। শেল্টার পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন, তাঁদের অবশ্যই প্রতিবন্ধী মানুষের ভিন্নতার ভিত্তিতে ভিন্ন চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সংবেদনশীল হতে হবে। বড় সংখ্যক মানুষের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে সারিসারি অস্থায়ী টয়লেট স্থাপন করা হয়। কিন্তু হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী বা ক্রাচ ব্যবহারকারী মানুষগুলো সে পর্যন্ত যেতে পারবে কিনা, বা ব্যবহার করতে পারবে কিনা, সেটি পরিকল্পনায় রাখি কি?
আমরা যারা রিলিফের সামগ্রী নিয়ে যাই, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সামনের মানুষকে রিলিফ সামগ্রী বিতরণ করে কিছু ছবি তুলে বিদায় হই; কিন্তু যে মানুষগুলোর হাটাচলা করতেই সমস্যা, তারা কখনো রিলিফ সামগ্রী পেল কি না, তা কি আমরা ভাবি? তাদের পক্ষে তো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। এ ছাড়াও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন বা মানসিক রোগগ্রস্ত সন্তানকে ঘরে ফেলে রেখে তার মায়ের পক্ষেও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। আবার তাদের সঙ্গে নিয়ে লাইনে দাঁড়ানোও সম্ভব নয়। এতে লাইনে দাঁড়ানো অন্যান্যরাও বিরক্ত হবে, আয়োজকরাও বিরক্ত হবে। তাহলে যাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল সবচাইতে বেশি, তারা কি রিলিফ সামগ্রী পাওয়া থেকে বিচ্ছিন্নই থেকে যাচ্ছে?
শ্রবণ-বাক প্রতিবন্ধী মানুষটি তো ইশারাভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষায় কথা বলতে পারে না। আমরাও ইশারা ভাষা জানি না। তাহলে তার প্রয়োজনগুলো মেটাব কীভাবে? দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েটি রাতে টয়লেটে যেতে হলে অন্য কারো লালসার শিকার হচ্ছে না তো? শেল্টার বা রিলিফ ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন, তাঁরা এগুলোও ভাবছেন তো?
প্রতিবন্ধী মানুষদের মধ্যে অনেকেরই নানাধরনের সহায়ক উপকরণ ব্যবহার করতে হয়; কিন্তু দুর্যোগের সময় এর মধ্যে অনেকগুলোই হারিয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষদের সাদাছড়ি, শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষদের হিয়ারিং এইড, শারিরীক প্রতিবন্ধী মানুষের ক্রাচ বা লাঠি দুর্যোগকালে হারিয়ে যাওয়া নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু দুর্যোগ-পরবর্তি পুনর্বাসনের জন্য যে প্যাকেজ তৈরি করা হচ্ছে, তার মধ্যে কি এগুলো আমরা হিসাব করি?
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী যে মানুষটি সাদাছড়ি হাতে প্রতিদিন একই পথে বাড়ি থেকে বের হয়ে কাজে যেত, আসা যাওয়ার পথে সবগুলি ল্যান্ডমার্ক তার মুখস্ত ছিল। রাস্তা কোথায় বাঁক নিয়েছে, কোথায় উঁচুনীচু, কোথায় শক্ত পথ, কোথায় কাদা-পানি জমে, এগুলো নির্বিঘ্নে একাই পার হয়ে যেতে পারত। বন্যায় পানিতে তলিয়ে গিয়ে আর পানির স্রোতে সবগুলো ল্যান্ডমার্ক যখন পরিবর্তন হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পর শেল্টার থেকে ফিরে এসে দৃষ্টিমাণ মানুষদের নতুন পথ খুঁজে নিতে বা তৈরি করে নিতে সময় লাগে না; কিন্তু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষটিকে এই নতুন পথ চেনাতে আর এতে স্বাচ্ছন্দ চলাচলে অভ্যস্ত করতে সাহায্য করার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে তো?
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা আসলে কত, এ নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। তবে যে সংখ্যাটি জাতিসংঘের আঞ্চলিক দফতর থেকে স্বীকৃত, তা হলো জনসংখ্যার ৯ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, যা পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালে গৃহভিত্তিক আয়-ব্যয় জরিপ থেকে পাওয়া। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে হিসেব করলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দেড় কোটি। দুর্যোগ যেহেতু আমাদের দেশে প্রতিবছর লেগেই থাকে, যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় দুর্যোগের বিষয়টিকে ভাবনায় রাখতেই হয়। কিন্তু এই বিশাল ভাবনার মধ্যেও এই দেড় কোটি মানুষের ভিন্নভিন্ন চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার ভাবনাগুলো আমরা বিশেষভাবে ভাবছি কি?
লেখক: ডিস্যাবিলিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট
এসএ/