উপেনের ‘দুই বিঘা জমি’
শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের অজস্র স্মৃতির অন্যতম উপকরণ ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা অবলোকন এবং তার অপূর্ব নিদর্শন উপেনের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার মাধ্যমে উপস্থাপন। নিভৃত পল্লীর অতি সাধারণের বাস্তব ছবি অতি নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর কবিতায়। শিলাইদহ বাসকালে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লেখার উৎস পেয়েছিলেন যা অন্য কোথাও হয়নি। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের ভাষায় এর সমর্থন মেলে। অর্থাৎ শিলাইদহ ছিল তাঁর সাহিত্য সাধনার অনুকূল পরিবেশ।
‘রাখি হাট খোলা নন্দির গোলা মন্দির করি পাছে’ শিলাইদহ কুঠিবাড়ি থেকে উত্তর পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলে এ স্থানগুলো অতিক্রম করতে হতো। হাটখোলা বলতে শিলাইদহ কুঠির হাট, যা পদ্মাগর্ভে বিলীন (বর্তমানে হাসপাতালের সন্নিকটে), লালন চন্দ্র নন্দির গোলা (বোনাপাড়া), তারপরই গোপীনাথ দেবের মন্দির।
‘দুই বিঘা জমি’ বাবু ও উপেনের সত্য কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয়েছে। তৎকালীন ধনীরা অশিক্ষিত প্রজার কাছে বাবু বলে পরিচিত। আর উপেন ছিল কসবা আচার্য পরিবারের সাধারণ গরীব প্রজা ও ব্রাহ্মণ কৃষক। রবীন্দ্রনাথের আমলে শিলাইদহ পল্লীতে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কজুমার, কামার, কর্মকার, সূত্রধর, ধোপা, জেলে, তাঁতি প্রভৃতি শ্রেণি বাস করত। গোপীনাথ দেবের মন্দির ও যুগল শাহের কালী মন্দির এখনও বিলীন হয়ে যায়নি। গোপীনাথ দেবের প্রকাণ্ড রথটি ছিল কাঠের তৈরি। স্থান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এইসবই দুইবিঘা জমির উপকরণ। কেউ কুঠিবাড়ির পূর্বদিকে আম্র কাননের মধ্যে অবস্থিত বলে ধারণা করেন। সে আমলের প্রাচীন লোকদের নিকট থেকে জানা যায় উপেন নামক ব্যক্তির জমিতে ঠাকুর বাবুরা খাজনা নিতেন। বিরাহিমপুর’ ঠাকুর বাবুদের জমিদারি হলেও কয়েকটি পরগনার অন্তর্ভূক্ত ছিল যার বর্তমান শুধু উপেনের ভিটেই ছিল। রবীন্দ্রনাথ দুই বিঘা জমি উপেনের ভিটে হিসেবে চিহ্নিত করেছেন কিন্তু দুই বিঘা জমি কুঠিবাড়ি সংলগ্ন উপেনের জমি। উপেন প্রজা মাত্র। উপেনের ভিটে মাইল দুরে কসবা গ্রামে এবং এখানকার এই দুই বিঘা জমিই তার শেষ সম্বল। উপেনের ছোট ভাই ভবানী আচার্যের সঙ্গে গ্রামের কয়েক বয়ঃবৃদ্ধ লোকের মুখ থেকে শোনা কথা বলে–আজও লোকমুখে এই ঘটনার জনশ্রুতি আছে। তাঁর বংশধর দেশ বিভাগের সময় ভারতে চলে যায়।
আবার শচীন্দ্রনাথ অধিকারী দুই বিঘা জমির কাহিনি বর্ণনা করেছেন, ঘটনাটি অধিকারী বাবুদেরই কয়েকজন গরিব গৃহস্থের বসতবাড়ি তাদের বাড়ির শামিল করে আয়তন বাড়িয়েছেন। ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি’ অধিকারী বাবুদের প্রভাবশালী বাবু গুরুচরণ কয়েকজন বাড়ির মালিককে উচ্ছেদ করেছেন। তাদের অন্যতম ছিল যদুদত্ত। এই যদুদত্তই রবীন্দ্রনাথের কবিতার উপেন। গুরুচরণ অধিকারীর প্রাসাদ পাশেই বাগানের ধারেই যদুদত্ত বাস করতো। সে ছিল বাবুর কাছে ঋণী। বাবু চেয়েছিলেন তাঁর ভিটে-মাটির বিনিময়ে আরও কিছু টাকা দিবেন। কিন্তু উপেন রাজি হয়নি; বরং দয়াভিক্ষা চেয়েছিল ভিটে রক্ষার জন্য। ‘দেনার দায়ে ফেলে গুরুচরণ করিল ডিক্রি’ তাই উপেন বাধ্য হলো ভিটামাটি থেকে চলে যেতে; কিন্তু এই উপেনের বসতভিটা কেড়ে ছন্নছাড়া করার জন্যই কি ডিক্রি জারি করলেন? জমি হারানোর শোকে ম্যানেজার বাবু কবির অজ্ঞাতে ডিক্রি জারি করেছিলেন। আর জমি হারানোর শোকে উপেন সন্নাসী বেশ ধারণ করে বোষ্টমীর আস্তানায় নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে কয়েক বছর পর ফিরে এসেছিল আবার মাটির টানে।
আবার লোকমুখে কথিত আছে, উপেন ছিলেন এক প্রান্তিক কৃষক। উপেনের যে জমাজমি ছিল তার মধ্যে দুই বিঘা জমি ছাড়া সবই ঋণের দায়ে তাকে হারাতে হয়েছে। এখন সম্বল শুধু ভিটেমাটির দুই বিঘা জমি। কিন্তু উপেনের কপাল খারাপ। তাঁর এলাকার জমিদার বাবুর ভূমির অন্ত নাই। তথাপি বাবুর নজর পড়েছে উপেনের দুই বিঘা জমির উপর। বাবু উপেনের জমি কিনতে চায়। শুনে উপেন বলে, রাজা এই দেশের মালিক আপনি, জায়গার অভাব নেই। কিন্তু আমার এই জায়গাটি ছাড়া মরার মতো ঠাঁই নেই। উপেন দুই হাত জোড় করে বাবুর কাছে সাত পুরুষের ভিটেটা কেড়ে না নেওয়ার অনুরোধ করে। এতে বাবু রেগে চোখ গরম করে চুপ করে থাকেন। নাছোড়বান্দা বাবু দেড় মাস পরেই মিথ্যে ঋণের দায়ে উপেনের প্রতি ডিক্রি জারী করে।
উপেন নিজের ভিটে ছেড়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে ১৫/১৬ বছর কেটে যায়। অনেক তীর্থস্থান, শহর, গ্রাম সে বিচরণ করে, তবুও উপেন তাঁর সেই দুই বিঘা জমির কথা ভুলতে পারে না। তাই মাতৃভূমির টানে উপেন একদিন ফিরে আসে নিজ গ্রামে। অনেক পথ পেরিয়ে নিজ বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হয়। সে দেখে বাড়িতে আগের কোন চিহ্ন নেই। উপেনের মন বিষন্ন হয়ে পড়ে। নিজের বাড়িতে এসে উপেন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। তাঁর চোখ ভরে জল আসে। অবশেষে তাঁর ছেলেবেলার সেই আমগাছটির দিকে চোখ পড়ে উপেনের। স্মৃতিময় আমগাছটি দেখে তাঁর মনের ব্যথা দূর হয়ে যায়। আমগাছটির নিচে বসে সে ভাবতে থাকে ছেলেবেলার কথাগুলো। তখনি হঠাৎ তাঁর কোলের কাছে দুটি আম ঝরে পড়ে।
ক্ষুধার্ত উপেন ভাবে আমগাছটি তাকে চিনতে পেরে দুটি আম উপহার দিয়েছে। কিন্তু আম দুটি হাতে নিতেই বাগানের মালি যমদূতের মতো লাঠি হাতে এসে উপেনের উপর গালিবর্ষণ করে। উপেনের ঘাড় ধরে রাজার কাছে নিয়ে যায়। বাবু তখন মাছ ধরছিল। মালির কাছে সব শুনে বাবু রেগে উপেনকে বকা দেন, মারতে চান। উপেন কাতর হৃদয়ে বাবুর কাছে আম দুটো ভিক্ষা চায়। কিন্তু বাবু উপেনকে সাধুবেশী চোর বলে উল্লেখ করে। এতে উপেন হতভম্ব হয়ে যায়। যে জমিদার বাবু জোচ্চুরি করে উপেনের সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে, সেই বাবু আজ নিজেকে সাধু বানিয়ে উপেনকে চোর আখ্যা দিল!
চোর উপাধি শুনে উপেনের চোখ দিয়ে ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা ও পরিহাসের কথা মনে পড়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। এই কবিতার মাধ্যমে কবি দেখাতে চেয়েছেন সমাজে এক শ্রেণির লুটেরা বিত্তবান প্রবল প্রতাপ নিয়ে বাস করে যাচ্ছে এবং তারা সাধারণ মানুষের সম্পদ লুট করে সম্পদশালী হয়। তারা অর্থ, শক্তি ও দাপটের জোরে অন্যায়কে ন্যায় ও ন্যায়কে অন্যায় বলে প্রতিষ্ঠা করে। তাছাড়া সম্পদের মালিকরা আরো সম্পদ আহরণের জন্য কীভাবে লালায়িত হয় সেই বিষয়টিও এখানে উঠে এসেছে।
রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমির বাস্তবতা ও পটভূমি আরও অনুসন্ধানের বিষয়। জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজার যে উপেনকে ছন্নছাড়া করার ব্যবস্থা করেছিল, সেই করুণ কাহিনি উপেন জমিদার রবীন্দ্রনাথকে শুনিয়েছিলেন। তিনি কল্পনার জাল বুনে এমন বাস্তব ছবি তৈরি করেছেন যা গ্রামবাংলার সমাজে আজও প্রতিবাদী হয়ে উচ্চারিত।
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক
এসএ/