কৃষকের আত্মহত্যা আর আত্মজিজ্ঞাসা
ধানের জমিতে সেচ দেয়ার জন্য পানি চেয়ে তা না পেয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর দুইজন সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা কি চাপা পড়ে গেল? আর চাপা পড়বেই বা না কেন? মানুষের জীবন তো এখন একটা সংখ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। কর্তা ব্যক্তিরা সমস্বরে যখন বলতে থাকেন তাদের কৃতিত্বে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ তখন যদি জিজ্ঞেস করা হয় কেন তাহলে খাদ্য আমদানি? উত্তর মেলেনা তার। বরং পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়, না খেয়ে মরেছে কি কেউ?
যে কৃষক ফসল ফলিয়ে নিজে বাঁচে আর বাঁচিয়ে রাখে দেশের মানুষকে, সেই কৃষক যখন সেচের পানির অভাবে ফসল বাঁচাতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তখন আর প্রশ্ন করা নয়, কাউকে দায়ী করা নয়, সামান্য বেদনায়ও কি আচ্ছন্ন হয় দায়িত্বশীলদের মন? পানির অপর নাম জীবন, সেই পানির জন্য আত্মহত্যা করে দুই আদিবাসী কৃষক কি কোন বার্তা দিয়ে গেল? সবাই বলে মানুষের জীবন তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু সেই জীবন কখন আর কিভাবে সে আত্মহনন করতে পারে? চোখের সামনে সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটতে দেখেও যখন প্রতিকারের কোন উপায় দেখেনা, সমাধানহীন সংকট, চূড়ান্ত অপমান আর অপদস্থ হয়েও পায় না কোনো সহযোগিতার আশ্বাস, তখন সে হারিয়ে ফেলে জীবনের প্রতি আস্থা আর সমাজের প্রতি বিশ্বাস। নিজের হাতে জীবনের সমাপ্তি টেনে দিয়ে মুক্তি পেতে চায়। একে কাপুরুষতা বলে সমাজ কি পাবে দায় থেকে মুক্তি?
স্বাধীনতার মাস, মার্চ মাস। ১৯৭১ সালের এই মাসের ২ তারিখে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়েছিল ছাত্ররা, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করা হয়েছিল, ৭ মার্চ তারিখে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে পাকিস্তানীদের হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছিল, আমরা তোমাদেরকে ভাতে মারব, পানিতে মারব। আর ৫০ বছর পর ভাত খাবার জন্য ধান চাষের জমিতে পানি দিতে না পেরে সেই মার্চ মাসে আত্মহত্যা করলেন দুই আদিবাসী ভাই। রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে রবি মারান্ডি ও অভিনাথ মারান্ডি আত্মহত্যা করেছেন। দুজনেই কৃষক, আদিবাসী এবং সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর।
এখন বোরো ধান পুষ্ট হওয়ার সময়। পানি না পেলে ধান চিটা হয়ে যাবে। তিন মাসের পরিশ্রম, টাকা পয়সা খরচ সব শেষ হয়ে যাবে পানি না দিতে পারলে। কিন্তু দিনের পর দিন এই দুই ভাই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কাছে গভীর নলকূপ থেকে জমিতে সেচের পানির জন্য ধরনা দিলেও পানি পাচ্ছিলেন না। তারা কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, পানি না দিলে এমনিতেই তো না খেয়ে মরে যেতে হবে। তার চেয়ে তারা আত্মহত্যা করবেন। বহু বঞ্চনা আর প্রতারণার পরও আদিবাসীরা তাদের সম্ভ্রমবোধটুকু এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাঁরা যা বলেন তা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিএমডিএর কর্তাব্যক্তিরা হয়তো ভাবতে পারেননি এই দুজন সত্যিই আত্মহত্যা করবেন। দুই ভাই একসঙ্গে গভীর নলকূপের সামনে কীটনাশক পান করেন ২৩ মার্চ সন্ধ্যায়। রাতেই অভিনাথের মৃত্যু হয়। আর রবি মারা যান রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে ২৫ মার্চ রাতে। এরা দুজন সম্পর্কে চাচাতো ভাই। তাঁদের পরিবারের দাবি, ১০–১২ দিন অপেক্ষার পরও ধানের জমিতে পানি নিতে না পারার ক্ষোভ থেকে তাঁরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
তবে অতীতের অনেক ঘটনার মত এক্ষেত্রেও জমিতে পানি না পেয়ে তাদের বিষপানের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুর রশিদের ভাষ্য, তারা দুই কৃষকের বিষপানের কথা শুনেছেন। পানির অভাবে তাদের জমির ধান মারা যায়নি। সেই শোকে তারা বিষপান করেছেন–এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখন পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে অপারেটরের কোনো অনিয়ম থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কি দায়িত্বহীন উদাসীনতা আর সেই পুরাতন কথা! কে নেবে ব্যবস্থা আর কে করবে কার বিচার?
কিছুদিন আগেই ডিজেলের দাম বাড়ানোতে সরকারের লাভ হলেও কৃষকের খরচ গেছে বেড়ে। উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা বলেন, বোরো মৌসুমে এক হেক্টর জমিতে ১০ থেকে ১৫ বার সেচ দিতে হয়। এতে প্রয়োজন হয় ৪৫-৫০ লিটার ডিজেল। এই হিসাবে প্রতি হেক্টরে বোরো চাষে ডিজেলের বাড়তি দামে কৃষকের অতিরিক্ত খরচ হবে ৭০০ টাকার বেশি। তাদের মতে, তেলের দাম বাড়ায় ধানের চাষ করাই দুষ্কর হয়ে গেছে। হালচাষের খরচ বেড়ে গেছে। শ্যালো মেশিনে সেচের খরচ বেড়ে গেছে। খরচ বেড়েছে বলে কৃষক কি তাহলে ধান চাষ কমিয়ে দেবেন? না। কারণ ধান আবাদ না করে তার কোন উপায় নেই। নিজের পরিবারের খাবারের সংস্থান তো করতে হবে?
আগেই প্রাক্কলন করা হয়েছিল ডিজেলসহ সব উপকরণের দাম বাড়ায় ১ একর জমিতে বোরো আবাদ করতে গত বছরের চেয়ে অতিরিক্ত ২-৩ হাজার টাকা বেশি খরচ হবে। তেলের দাম বাড়ায় একরপ্রতি সেচখরচ ৪০০ টাকা, ট্রাক্টর দিয়ে চাষে ৩০০ টাকা ও মাড়াইয়ে ৩০০ টাকার খরচ বেশি পড়েছে। সারসহ অন্য উপকরণের দামও চড়া। তাই প্রতি একরে অতিরিক্ত খরচসহ মোট খরচ পড়ে ৪২ থেকে ৪৩ হাজার টাকা। অথচ প্রতি মণ ধানের দাম ৮০০ টাকা ধরে একরে ৫০ মণ ফলন হলেও ৪০ হাজার টাকার বেশি উঠবে না। তাহলে চাষ করে লাভ কী? পেটের দায়ে এবং উপায় নেই বলে কৃষক যদি চাষাবাদ করে তাকে কি স্থায়ী উন্নয়নের কৃষি অর্থনীতি বলা যাবে?
কৃষিতে প্রচুর ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে বলে যে বাহবা নিচ্ছেন সরকার তার সুফল সাধারণ কৃষক কতটুকু পান? অভিনাথ মারান্ডির জমির পরিমাণ দেড় বিঘা। ফলন হলে সর্বোচ্চ ৩০/৩৫ মন ধান পেতেন। বর্গাদারকে দিয়ে, চাষের খরচ মিটিয়ে অভিনাথ নিজে আর কত পেতেন? ৫/৬ মন ধান। দাম কত হতে পারে? ৬ হাজার টাকা। একজন ধনী ব্যক্তির একবেলার হোটেলের খাবার খরচের চেয়েও কম। অথচ এর জন্য জীবন দিল অভিনাথ এবং রবি মারান্ডি। ড্রয়িং রুমের আড্ডায় অনেকেই হয়তো বলবেন কি বোকা এই সাঁওতালরা। কিন্তু বুকের ভিতর কতটা অপমান, অসহায়ত্ব আর ক্ষুব্ধতা জমলে কীটনাশকে জীবন বিসর্জন দিতে পারলো এই দুই ভাই, তা বোঝার মন কি এই রাষ্ট্র আর ক্ষমতাসীনদের আছে? তেভাগার জন্য জীবন দিয়েছিল সাঁওতালসহ আদিবাসীরা। তা ছিল সংগ্রামের আর মর্যাদার মৃত্যু। তখন কণ্ঠে ছিল গান, আর দেব না, আর দেব না রক্তে রাঙা ধান। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ধান চাষ করতে পানির জন্য জীবন দিল যে আদিবাসীরা, তারা দেখিয়ে দিল বৈষম্যের চিত্র? একে তো কৃষক তার উপর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী! উন্নয়নের সব সূচকেও কি আড়াল করা যাবে কৃষকের এই অসহায়ত্ব?
এসএ/