শ্রীলঙ্কার বিপর্যয় আমাদের শিক্ষা
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দুটি কারণেই শ্রীলঙ্কায় বিপর্যয় ঘটেছে। অভ্যন্তরীণ কারণ হলো–তাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটি দুর্বলতা ছিল। তারা যেভাবে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে, সেই বিনিয়োগের জন্য নেওয়া ঋণ তাদের চাপে ফেলেছে। ঋণ পরিশোধ করার সময় চলে আসছে, অথচ ফরেন কারেন্সি বা রিজার্ভ ঠিকমতো থাকবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই! যেভাবে ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল, সেগুলো ঠিকভাবে হয়নি।
এগুলোর পেছনে একটি বড় কারণ ছিল–তারা আসলে বুঝেনি কোভিড নিয়ন্ত্রণে আসতে না আসতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। ট্যুরিজম থেকে তারা প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার অর্জন করে; কোভিডের দুই বছর তো কিছুই আসেনি এ খাত থেকে। তারপর এটি ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। এর একটি বড় অংশ আসে রাশিয়া থেকে। সেটি আসা বন্ধ হয়ে যায় যুদ্ধের কারণে। তাদের চায়ের ১৫ শতাংশ যায় রাশিয়ায়, সেটিও বন্ধ। এ জন্য পেমেন্ট তারা পাচ্ছিল না। যে কারণে তাদের রিজার্ভ অনেক কমে প্রায় দুই বিলিয়নের কাছাকাছি চলে আসছে। কাজেই ঋণ পরিশোধের জন্য টাকার সমস্যা হয়ে গেছে।
রিজার্ভ কমে যাওয়ার ফলে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে অনেক। অবমূল্যায়ন হওয়ার ফলে, তারা আমদানি যা করে, তার উপর মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে আমদানি করার মতো অর্থ তাদের রিজার্ভে ছিল না। তেলের দাম বেড়েছে। তেল পুরোটাই আমদানির উপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছিল না, কারণ তেলের দাম বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্ন হওয়ার ফলে উৎপাদন কমে গেছে। ফলে সরবরাহে সমস্যা হয়ে গেছে।
তারা কিছু পলিসি নিয়েছিল, যেমন–কৃষিক্ষেত্রে অর্গানিক ফার্মিংয়ের উপর জোর দিয়েছিল। সেটির উৎপাদনশীলতাও ঠিক থাকেনি। তার ফলে এগ্রিকালচারের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০১৯ সালে বর্তমান রাজাপক্ষে সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা অনেক রাজস্ব প্রণোদনায় ট্যাক্স কমিয়েছে। তার ফলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বিঘ্নিত হয়েছে। সুতরাং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় তারা কোনো দক্ষতা দেখাতে পারেনি।
অর্থনীতিবিদরা বলছিলেন যে, এমন একটা সময় আসবে যখন রিজার্ভ কমে যাবে। রপ্তানি কমে যেতে পারে, আমদানির খরচ বাড়বে। রেমিট্যান্স কমে যেতে পারে; কিন্তু তারা এ ক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা নেয়নি। যে কারণে এরকম একটি অবস্থা দাঁড়িয়েছে। ভারত বলছে ২ বিলিয়ন ডলার দিবে। আইএমএফ স্থিতিশীল করার জন্য কঠিন কঠিন শর্তে ঋণ দেবে। জনগণের ব্যয় খরচ কমাতে বলবে। ট্যাক্স বাড়াতে বলবে ইত্যাদি।
এ বাস্তবতায় জনগণেরও আয় ক্ষমতা কমেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। রায়ট হচ্ছে এবং সেখানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করছে। গতকাল পুরো কেবিনেট পদত্যাগ করেছে। কেবলমাত্র প্রেসিডেন্ট আছে। সবকিছু মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভাল অবস্থায় থাকার পরেও সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনায় দুর্বলতা এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি দুটির সমন্বয়–সবমিলিয়ে তারা একটি বিপদে পড়েছে এবং বিপদে পড়েছে অর্থনীতি। ভারত তাদের কিছুটা সহায়তা দেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য।
তবে এ আর্থিক সংকটের রাজনৈতিক অভিঘাত রয়েছে। জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলছেন অনেকেই। তবে ক্ষমতাসীনদের এমন আহ্বানে কান দেয়নি বিরোধীরা। তাই আলোচিত জাতীয় সরকার রাজাপক্ষদের নিয়ে করা হবে, না কি তাদের বাদ দিয়ে করা হবে–তা এখনো নিশ্চিত নয়। চলছে ব্যাপক জন-অসন্তোষ। সবমিলিয়ে কীভাবে একটি ভালো অর্থনীতি অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, পরিকল্পনার অভাব এবং বাস্তব অবস্থাকে উপেক্ষা করলে ধসে পড়তে পারে, সেটির একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে শ্রীলঙ্কা।
বাংলাদেশের প্রসঙ্গে আসা যাক। বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির তুলনা করা ঠিক হবে না। তবে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা আমি মনে করি বাংলাদেশসহ অন্যান্যদের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে। এটি আমাদের জন্য এক সতর্কবার্তা। আমাদের অর্থনীতি অনেক বড়। শ্রীলঙ্কা ৮০ বিলিয়ন ডলারের আর আমাদের ৪২৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। তাদের রাজকোষ শূন্য হয়ে গেছে। আমাদের যথেষ্ট রিজার্ভ আছে।
তবে সুশাসন শক্তিশালী করা, সাশ্রয়ী ও সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যে কতটা জরুরি সে সম্পর্কে আমাদের শ্রীলঙ্কা থেকে শেখার দরকার রয়েছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা দক্ষতার সঙ্গে ও বাস্তবতার নিরিখে করতে হবে। এই সতর্কবার্তা যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্যই প্রযোজ্য। রিজার্ভ যেন না পড়ে যায় সেজন্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ, রেমিট্যান্স বাড়ানো, সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষতা, প্রয়োজন অনুযায়ী মেগাপ্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়া–এসব বিষয়ে শ্রীলঙ্কায় যে বিপর্যয় চলমান, সেখান থেকে অবশ্যই আমাদের শিক্ষণীয় রয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক এবং সম্মানীয় ফেলো (সিপিডি)
এসএ/