মানুষ আজ ধনতন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত
ইকবালের একটি কথা আছে, হে মুমিন, মর্দে মুমিন, এমন কিছু কর, যেন তোমার ভাজ্ঞ লেখার সময় আল্লাহ স্বয়ং তোমাকে জিজ্ঞাসা করেন, বল মুমিন, তোমার কপালে আমি কি লিখব? অর্থাৎ আমাদের ভাজ্ঞ আমাদের হাতে। একজন মুমিন তার সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু আমিতো আর শেক্সপিয়ার হব না, আমাকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদই হতে হবে। অর্থাৎ আমাকে আমিই হতে হবে। তোমাকে তুমি। তবে মানুষ জেনে যেতে চায় মৃত্যুর আগে যে, সে আসলে কি কাজ করল? অন্তত নিজের কাছে এটুকু বলা যে, আমি ফাঁকি দেইনি। মানুষ যত উপরের সিঁড়িতে উঠবে ততই সে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাবে। কাজেই আমি কি? আমি কত বড় কি ? এসবের আসলেই কোন মূল্য নেই আমার কাছে। আত্মখেদ নিয়েই প্রতিটি মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। সেজন্য প্রতিটি মানুষের নিজের কাছে এই উত্তরটুকু খুঁজে নেওয়া দরকার মনে হয়। আমি পাশ করেছি অথবা পাশ না করি at least I ve tried এতটুকু সে অন্তত জানতে চায়। মানুষ যখন নিজেকে ফাঁকি দেয় তখন আসলে সে নিজেকে পায় না। সেই জায়গাটি আর তৈরি হয় না। মানুষ প্রতারিত হয় নিজের কাছেই।
আমার মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে মানুষের আত্মতৃপ্তির অনুভূতি আজ আর নাই। এখন মানুষ আর অনুভব করার সময় পায় না। সময়টা হচ্ছে আমার কাছে জীবন। জীবনতো আসলে একটি , ‘period of time’. কিন্তু সময়টি তো আমাদের প্রভূরা অর্থাৎ মালিকরা আমাদের কাছে থেকে কেড়ে নিয়েছে। সেজন্য আজ দেখা যায় প্রেম নাই, গান নাই, মান নাই, কিছু নাই। আগের দিনের মানুষের মধ্যে অনুভব করার মত সময় ও সক্ষমতা ছিল। আগে অবকাশ ছিল, এখন নাই। আগে একটি ভাল গান শুনলে সেটি নিয়ে গুনগুন করার জন্য সময় ছিল, এখন নাই। মানুষ এখন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। সবকিছুতে অস্থিরতা, প্রতিযোগিতা, দৌরাত্ম্য এসবই চলছে।
আমার ধারণা পৃথিবীতে ৭% মানুষ। বাকি ৯৩% তাদের শ্রম, তাদের আত্মদান, তাদের দুঃখ, তাদের সংগ্রাম, এইসব কিছুর উপরে তারা বেঁচে আছে এবং মানুষ মাত্রই ষড়রিপু চক্রে ঘূর্ণায়মান। রিপুমুক্ত মানুষ হয় না যেমন তবুও কেউ কেউ হয়ত জয় করতে চায়। সেই চেষ্টাটুকু থাকে। মানুষ যা নিয়ে জন্মেছে, তা কি সে বাদ দিতে পারবে? পারবে না। তবুও চেস্টাটুকু করা একটু অন্বেষণ করা।
একধরণের মানুষ আছে, যারা সারা পৃথিবীর মানুষ যখন দৌড়ায় তখনও স্থির হয়ে থাকে। মানুষ আসলে বিত্ত অথবা যদি বলি ধনতন্ত্রের সাথে, প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কারণ টেকনোলজিও ধনতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত। কিছু মানুষের লাভের জন্য এরা টেকনোলজি তৈরি করে এবং মানুষের কাছে পপোলারাইজ করে। এইমাত্র আমি যে কলাটি খেলাম, সেটি থাইল্যান্ড থেকে এসেছে। কলাটির উপরে চকোলেট দেওয়া। কিন্তু আমাদের দেশের যে সুঘ্রাণযুক্ত শবরী কলা, তার স্বাদ অন্যরকম। একটি দেশীয় আমেজ, অন্যটি টেকনোলজি। এখন এই যে কলার গায়ে চকোলেট মিশিয়ে বিক্রি করা, এটা যদি মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে যায়, তাহলে কলার মালিক অর্থাৎ প্রভুর অনেক টাকা হবে। কলা খাওয়ার সময় আমার মনে হয়েছে, মানুষকে অলস বানানোর এই যে চেস্টা সেটি ভাবনার বিষয়। এখন আর লং ডিস্টেন্স কল করতে বাটন ঘোরাতে হয় না, স্ক্রিন টাচ করলেই ছবিসহ চলে আসে। আর এসবের দৌরাত্ম্য মানুষকে পুরোপুরি অক্ষম করে ফেলে।
মানুষের অস্থিরতা এবং দৌরাত্ম্য বেড়েছে যেমন গুণগত মান কমেছে তেমন। একটি উদাহরণস্বরূপ যদি বলি, সেই লালরং সুমিষ্ট পেপে আজ আর দেশে নেই, যা আছে তা হরেক রকম, বাইরে থেকে মনে হয় লাল, ভেতরে সাদা, কোনো স্বাদ নেই, কোন গুণ নেই। সবক্ষেত্রেই একই অবস্থা বিরাজমান।
আমরা তো শ্রেষ্ঠ বলে নিজেদের দাবি করি, কিন্তু আমরা আসলেই নিজেদের বিবেকের কাছে, কতটুকু শ্রেষ্ঠ হতে পেরেছি, আমার মনে হয়, সেটি অবশ্যই ভেবে দেখার সময় এসেছে। নিজেদের মূল্যায়নের পাশাপাশি পেছনে ফিরে যাওয়া যেহেতু সম্ভব নয়, কিন্তু ফিরে দেখার সময় হয়েছে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা।