স্থানীয় উন্নয়নে এমপির ভূমিকা
ব্রিটেন এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি তুলনামূলক আলোচনা
আমার বর্তমানে চলমান গবেষণা প্রকল্পের লক্ষ্য যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা অন্বেষণ করা। সাংবিধানিকভাবে আমাদের দেশে সাংসদদের উপর অর্পিত বাধ্যতামূলক উপদেষ্টার ভূমিকা এবং এর ফলাফল সম্পর্কে আমি বিশেষভাবে আগ্রহী। নতুন আঙ্গিকে ব্যাখ্যার লক্ষ্যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে থাকাকালীন স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় ব্রিটিশ এমপিদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে শুরু করি। এই প্রক্রিয়ায় হাউস অব কমন্সের সদস্যরা কীভাবে তাদের নির্বাচনী এলাকার জনগণের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে তাও আমি প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হয়েছি ।
আমি কেমব্রিজ এমপি মি. ড্যানিয়েল জেইচনারের ডেডিকেটেড ওয়েবসাইট থেকে জানতে পেরেছি যে তিনি ‘সার্জারি’ নামে নিয়মিত সেশন করেন, যেখানে তিনি তার নির্বাচনী এলাকার জনগণের সাথে সমস্যার বিষয়ে কথা বলার জন্য দেখা করেন। এই বিষয়টি সত্যিই আমার মধ্যে কৌতূহল তৈরি করে এবং আমি কেমব্রিজ এমপির সাথে কথা বলার জন্য একটি সাক্ষাত্কার আয়োজন করি। ইউনাইটেড কিংডমের বেশির ভাগ সাংসদ তাদের ভোটারদের সাথে নিয়মিত এই ‘সার্জারি’ বৈঠক করেন। এটি সম্পূর্ণরূপে স্বেচ্ছাসেবী, তাই এমপিরা যতবার খুশি তাদের নির্বাচনী এলাকার মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়া পরিচালনা করতে পারেন। সাধারণত শুক্রবার বা সপ্তাহান্তে এমপিরা ওয়েস্টমিনস্টার থেকে ফিরে আসার পর এটি অনুষ্ঠিত হয়।
একজন স্থানীয় এমপির সার্জারির সময় সম্পর্কে জানার সর্বোত্তম উপায় হল তার ওয়েবসাইটে দেখা বা নির্বাচনী অফিসে কল করা। সার্জারির বিবরণ স্থানীয় সংবাদপত্র বা পাবলিক লাইব্রেরিতেও প্রকাশিত হতে পারে। তবে যে কেউএমপির অফিসে কল করতে পারে এবং সার্জারি সেশনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারে। মি. জিচনার সাধারণত সপ্তাহে একবার সার্জারি সেশন করেন এবং স্থানীয়ভাবে ও অনলাইনে তার জন্য বিজ্ঞাপন দেন। বর্তমানে এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। কেননা সার্জারি সেশনের মাধ্যমে তারা তাদের ভোটারদের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হন।
উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুক্তরাজ্যের এমপিদের কোন আনুষ্ঠানিক ভূমিকা নেই। ভোটাররা প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে এমপিদের কাছে লেখেন, কিন্তু একজন এমপি কী করতে পারেন সে সম্পর্কে তাদের অবাস্তব প্রত্যাশা করা উচিত নয়। যারা সিদ্ধান্ত নেন যেমন, পরিকল্পনা কর্মকর্তা, কাউন্সিলর, পরিকল্পনা পরিদর্শক এবং পরিকল্পনা মন্ত্রী-তাদেরকে কঠোর পদ্ধতিগত নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। এই নিয়মগুলির কারণেই আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির বাইরে কারও সাথে অনানুষ্ঠানিক, ব্যক্তিগত আলোচনা দ্বারাসিদ্ধান্তগুলিকে প্রভাবিত করা যায় না ।
কখনও কখনও সাংসদরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট তাদের ভোটারদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে সহায়তা করেন। একইভাবে, তিনি যে নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেন, তার পক্ষে পরিকল্পনা কমিটির সাথে কথা বলার জন্য তিনি তার নামও প্রস্তাব করতে পারেন। মি. জেইচনার বিশ্বাস করেন যে, কোন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। নির্বাচনী এলাকার দাবির ভিত্তিতে পরিকল্পনা কমিটির সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনি তার নাম দেয়ারচেষ্টা করেন, তার প্রভাব এটুকুই। এটি যুক্তরাজ্যের বিকেন্দ্রীকৃত এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলির সৌন্দর্য।
বাংলাদেশে, এমপিরা তাদের উপদেষ্টা ভূমিকার সীমানা অতিক্রম করা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কারণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অনেকাংশে অকার্যকর। আমাদের দেশে সংসদ সদস্যের তিনটি প্রাথমিক দায়িত্ব রয়েছে: রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব, সামাজিক বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব এবং নির্বাচনী প্রতিনিধিত্ব। তবে সাংবিধানিকভাবে স্থানীয় সরকার পরিচালনায় বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরা শুধুমাত্র উপদেষ্টা ভূমিকা পালন করতে পারবেন। যদিও এটি কেন্দ্রীয় নেতা ও রাজনীতিবিদদের স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পে জড়িত হতে বা তাদের নিজস্ব সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে বাধা প্রদান করে না।
উপজেলা পরিষদ আইন ২০০৯ অনুসারে, স্থানীয় সরকার সংস্থার উপদেষ্টা হিসাবে একজন এমপির ভূমিকা বিতর্কিত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ডকে উপেক্ষা এমনকি নিয়ন্ত্রণ করে সংসদ সদস্যদের ‘উপদেশ প্রায়ই ‘নির্বাহী আদেশে’ পরিণত হয়। গ্রামীণ বাংলাদেশে গণমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেসাবে বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি এমপি, মাঠ প্রশাসক এবং স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে সম্পর্ক আরও স্বচ্ছ করা উচিত।
যদিও বিকেন্দ্রীকরণ গ্রামীণ বাংলাদেশে জনসমর্থক উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অনুঘটক, তবুও এমপি এবং মাঠ প্রশাসক এবং স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে সম্পর্ককে আরও বিশ্বস্ত করা উচিত। সংসদ সদস্যদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তারা তাদের নির্বাচনী এলাকার জনগণের সাধারণ স্বার্থের কথা চিন্তা করা এবং জাতীয় পর্যায়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যই নির্বাচিত হন। তারা জনগণকে শাসন করার জন্য নির্বাচিত হন না, এবং এটি তাদের কাজের অংশও নয়।
উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে, সংসদ সদস্যদের স্থানীয় সরকার সংস্থার বিভিন্ন কার্যক্রম দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করা উচিত যাতে তারা সংসদ কর্তৃক গৃহীত নীতি অনুসরণ করতে পারেন। কিন্তু স্থানীয় শাসনে তাদের হস্তক্ষেপের ফলে জনসম্পদ নিয়ন্ত্রণ, পক্ষপাতদুষ্ট বণ্টন, অসদাচরণ, স্বজনপ্রীতি এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে পারে। সর্বপরি, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলি সঠিকভাবে কাজ করার জন্য সর্বোত্তম চর্চাগুলি গুরুত্বপূর্ণ। সংসদ সদস্যদের প্রক্রিয়াগত সঠিকতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হওয়া উচিত কেননা তারা আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মশালবাহক।
উন্নয়নকে সত্যিকার অর্থে অর্থবহ করতে এমপিদেরকে অবশ্যই স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে একযোগে কাজ করতে হবে। সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক সংস্থা হিসেবে স্থানীয় সরকারের কার্যকারিতার জন্যশক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। এমপি, স্থানীয় সরকার সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সহযোগিতা বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় ন্যায়সঙ্গত উন্নয়ন নিশ্চিত করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক: ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভিজিটিং স্কলার (অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ)। ইমেইল: t.islam@juniv.edu