নিজের স্বার্থেই রাশিয়া আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ অথবা সংকট যেভাবেই বলি না কেন–এটি খুবই দুঃখজনক। বাংলাদেশের জন্য একইসঙ্গে বিশ্বের জন্য একটি দুঃসময় আমরা অতিক্রম করছি। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ ইতিবাচক। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যথেষ্ট আন্তরিক। শুধু ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান দিয়ে এটিকে মূল্যায়ন করা যায় না। এ সম্পর্কে আরও বহু দিক রয়েছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের যেমন স্বার্থ রয়েছে, রাশিয়ার স্বার্থ আরও বড়। আর তাই এ সম্পর্কে এখনই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেই মনে হচ্ছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শুধু ভালো সম্পর্ক দিয়ে সবসময় সব সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। নেওয়া উচিত না। কিছু নিজেদের স্বার্থ আছে, কিছু ভবিষ্যতের প্রশ্ন আছে, কিছু নীতির প্রশ্ন আছে। এখন রাশিয়া যেটি করেছে, সেটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এর আগেও আমরা ভোটদানে বিরত ছিলাম। এটি কোনদিকে যাওয়া উচিত, সেটি বলা খুব কঠিন।
এদিকে, শর্ত তো সবদিকেই আছে। আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও শর্ত আছে। তারা তো চায় যে, আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখি। রাশিয়ার সঙ্গেও আমাদের শর্ত আছে। তারচেয়েও বড় কথা হলো, দুর্বল দেশের উপর অত্যাচার আমরা তো চাইতে পারি না। আমরাও তো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশ। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র অনেক শক্তিশালী। আমাদের নীতিগত অবস্থান হচ্ছে, দুর্বলের পক্ষে থাকা, এটি আমাদের সংবিধানেও লেখা আছে।
দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ অথবা ব্যবসায়িক স্বার্থ যেভাবেই বলি না কেন, আমাদের মনে রাখতে হবে–এখানে বাংলাদেশের স্বার্থ যেমন আছে রাশিয়ার স্বার্থও তেমন আছে। রাশিয়ার স্বার্থ আমাদের চেয়েও বেশি। তারা একটি বিশাল প্রজেক্ট আমাদের কাছে বিক্রি করেছে। তারা যে লোন দিচ্ছে সেটিও হার্ড টার্মে, সফট টার্মে না। কাজেই এখানে তাদের বড় স্বার্থ আছে। ওভার প্রাইজও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সোলার প্রজেক্ট যেটি ইন্ডিয়াতে বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে চল্লিশ হাজার কোটি টাকা আমরা বেশি দিয়েছি। কাজেই রাশিয়ার স্বার্থ যে নাই, তা না। আমরা যা কিছুই করি না কেন, রাশিয়ানরা যে সাপ্লাই দেয়, এতে রাশিয়ানদেরই লাভ বেশি। তাদের প্রযুক্তি ও কৌশলগত সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন; কিন্তু এতে তাদের স্বার্থই বেশি।
প্রসঙ্গত, গত ২১ ফেব্রুয়ারি সোমবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রুশপন্থী বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের দুই অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। সেখানে ‘শান্তি রক্ষায়’ সেনা পাঠানোর নির্দেশ দেন তিনি। এরপর উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। একই সঙ্গে ‘প্রজাতন্ত্র’ দুটিতে রুশ সেনাদের ‘শান্তিরক্ষী’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন তিনি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহীনিয়ন্ত্রিত ডনবাস অঞ্চলে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত পূর্ব ইউক্রেনের ওই অঞ্চলে গত আট বছরের লড়াইয়ে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। ৩৩ দিনের যুদ্ধে ইউক্রেনের একাংশ এখন রাশিয়ার দখলে। রাজধানী কিয়েভ ঘিরে রেখেছে রাশিয়ার বিশাল সেনাবহর।
আমরা অন্যায়কে সমর্থন করতে পারি না, কখনো হয়তো বাধ্য হয়ে করি। করতে হয়। তবে এ ধরনের মানবকল্যাণ বিরোধী সিদ্ধান্তে আমরা প্রত্যেকেই ক্ষতিগ্রস্থ। এর একটি ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তবে যুদ্ধ কতদিন চলে, তার উপর নির্ভর করছে অনেককিছু। সারাবিশ্বেই তার প্রভাব পড়বে। সেটি নিয়ে চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। বিশ্বব্যাপী সুদূরপ্রসারি প্রভাব পড়বে; অর্থাৎ বাংলাদেশের উপরও তার প্রভাব পড়বে।
তবে আরও একটি কথা সত্যি, তা হলো–রাশিয়ার সঙ্গে নীতিগতভাবে আমরা মতভেদ তৈরি করেছি, ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দিয়েছি। তবে রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে, এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই।
লেখক: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
এসএ/