বাজার নিয়ন্ত্রণে দরকার কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। চাহিদা বেড়ে গেলে সরবরাহ কম হয়। আর চাহিদা বেড়ে গেছে সরবরাহজনিত কারণেই। আবার যেসব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, সেগুলো কিন্তু বাজারে আছে। সরবরাহের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বাজারজাতকরণের ব্যাপারে যথেষ্ট ঝামেলা ছিল। বাজারজাতকরণের ফলে ৫ টাকার বেগুন ৪০ টাকা হয়। ৬ টাকার করলা ঢাকায় এসে ১০০ টাকায় বিক্রি হয় সরবরাহের কারণে। আছে চাঁদাবাজি, যাতায়াত ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান খরচ। এখন সমস্যা হলো–খাবার দাবারের সঙ্গে অন্যসব কিছুর দামও বেড়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইলেক্টট্রিক টুলস এমনকি সেবার মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে। এসব কারণে যাদের স্বল্প আয়, বা প্রান্তিক জনগণ; তাদের যতটুকু সঞ্চয় আছে সেসবও খরচ হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে ডিপোজিটও কমে যাচ্ছে।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্য লাগামহীন। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে সংসার খরচ বেড়ে গেছে। সে তুলনায় আয় বাড়েনি। পরিবহন খরচ বেড়েছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ বেড়েছে। অনেকে অতিলাভের আশায় পণ্য গুদামজাত করে রেখেছে। রমজানে আরও বেশি মুনাফার আশায়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রমজানে ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেয়। মুনাফা কম করে। আমাদের দেশেই কেবল উল্টো চিত্র দেখা যায়।
জনগণের চাপে হোক আর স্বেচ্ছায় হোক, সরকার টিসিবির পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি শুরু করেছে। টিসিবির লাইন প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে। কেবল নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্তই নয়, মধ্যবিত্তরাও দাঁড়াচ্ছে। আসলে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ টিসিবির পণ্যবাজার দামের চেয়ে কিছুটা সহনীয়। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের তাল মেলাতে পারছে না আমাদের মধ্যবিত্তশ্রেণি। দেশের নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ অনেকদিন ধরেই কষ্ট সহ্য করে আসছে। বিগত দুই বছরে করোনা মহামারির কারণে অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছে।
এ ছাড়া অন্য কারণও আছে। সুদের হার কম। লোকজন সঞ্চয় রাখে না। এখন সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারের একটি কঠোর পদক্ষেপ। মোবাইল কোর্ট কোনো কাজের না। একজন দোকানদারকে কারওয়ানবাজারে গিয়ে ১ লাখ টাকা ফাইন করলেও তাদের কাছে এটা তেমন কোন ব্যাপার না। ১ লাখ টাকা ফাইন করলে পরেরদিন চাঁদা তুলে তারা দিয়ে দেবে। যদি বলা হয় যে, পুরো বাজারের সব দোকান বন্ধ করে দেওয়া হবে, হোলসেলের গুদাম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গুদাম বন্ধ করে দিলে ওরা কী করবে? একটি বাদ হয়ে যাবে, তখন তারা অন্যভাবে সমস্যা করবে। কঠোর কয়েকটি পদক্ষেপ নিলেই কেবল বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। এখন ধমক দিয়ে দাম কমিয়ে দিয়েছে, এগুলো কোনো কাজের কথা না।
আন্তর্জাতিকভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, তাই মুল্যস্ফীতি বাড়বে এটি ঠিক না। এই জিনিসগুলি হয়তো এখনো আসেনি, অথচ দাম বেড়ে গেছে। সত্যি কথা হলো, আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ম্যানুপুলেশনের কোনো শাস্তি নেই। কোনো প্রতিকার নেই। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে না এলে আমরা উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছে যাব–এগুলো আমার কাছে মনে হয় অনেকটা ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছু নয়। জনগণের জীবন যাত্রার মান যদি উন্নত না হয়, তাহলে এসব কথা অর্থহীন। আমাদের জীবনে নৈতিকতার বড় অভাব।
এসব বলয় থেকে বেড়িয়ে আসা উচিত। আর তা করতে বাজারের উপর সচেতনভাবে নজরদাড়ি বাড়াতে হবে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকতে হবে। এখন সরবরাহ কিন্তু কম না, কিন্তু দাম বেড়ে যাচ্ছে। সরকার অনেক কিছুই করার কথা বলবে, তা বেশিরভাগ সময়ই হয় অর্থহীন। এ অচলাবস্থা দূর করতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ইম্পোরটেড প্রডাক্টের দাম কতটুকু বেড়েছে সেই অনুপাতে বাজারে দাম বেড়েছে কি না সেগুলো কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি ৫ ডলার বাড়ে, বাংলাদেশের বাজারে বাড়বে ২০ ডলারের মতো। শুধু বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সমাধান সম্ভব নয়। প্রশাসনিকভাবে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
এসএ/