বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক, মুক্তিযুদ্ধ ও জনযুদ্ধ প্রসঙ্গ
২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মূলত ছিল জনযুদ্ধ। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি এই যুদ্ধে ব্যাপকভাবে গণমানুষ অংশগ্রহণ করেন। এদেশের সাধারণ মানুষ লড়াই করেছেন মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য। কেউ লড়েছেন অস্ত্র হাতে, কেউ অস্ত্র ছাড়া, অন্য কোনোভাবে। পাকিস্তান দখলদার বাহিনিকে হটিয়ে দেশ স্বাধীন করতে এদেশের শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, বয়স্কজন যুদ্ধ প্রাণপণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদান- আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। তাঁদের বুদ্ধিমত্তা, কৌশল, মৃত্যুঝুঁকি আর বুকভরা দেশপ্রেম বাস্তবিকই অহংকার করার মতো। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যিনি সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জেলের নির্মম নির্যাতন সহ্য করেছেন কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপোশ করেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা জানতাম না বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে না বাঁচিয়ে রেখেছে। তবু আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধ চালিয়ে গেছি। দেশ স্বাধীন করেছি। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেখানে আমাদের পিছু হটবার কোনো কারণই থাকতে পারে না। আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের অবস্থা হয়ে পড়েছিল নাজুক। সদ্য স্বাধীন দেশ। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ। যুদ্ধ যা করে তা হচ্ছে আলগা টাকা বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। আমাদের দেশে বাতাসে আলগা টাকা উড়ে বেড়াতে থাকল। সবাই অস্ত্র জমা দিলো না। মানুষ হয়ে পড়ল অস্থির। সুবিধাবাদীরা শুরু করল ডাকাতি, লুটপাট, চুরি, জোচ্চুরি, জোরদখল।
বঙ্গবন্ধু এলোমেলো হয়ে যাওয়া নবজাতক দেশ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দেশের আনাচেকানাচে ছুটতে থাকলেন। সবাইকে আঁকড়ে ধরে আহ্বান জানালেন দেশ গড়ার।
তখন দেশের ভেতরে বাইরে তুমুল অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকা ওঁৎ পেতেছে যদি তালেগোলে নিজ গোলায় কিছু তুলে নেওয়া যায়। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ভেতর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠনের উদ্যোগ চলছে, সরকার উৎখাতে গণবাহিনী গঠিত হয়েছে। সকলের তৎপরতা অতি উচ্চকিত। বঙ্গবন্ধুর অতি প্রিয়জন মওলানা ভাসানী সরকার খেদাও আন্দোলনের কথা বলে অনশন শুরু করলেন।
সেসব চলছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দেশে স্থিতিশীলতা আনবে। গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত থাকা জরুরি। সমালোচনা সংশোধনের পথ।
বঙ্গবন্ধু স্থির, দৃঢ় এবং তেজোময়। তিনি রাজনীতির প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা তখন সংবিধানকে সমুন্নত করার কাজ করছি। সেই পথে এগুচ্ছি। সাংবিধানিক পথে গণমানুষের জন্য গড়ে উঠছে স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ।
অকস্মাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের রাজনীতিকে কয়েক ধাপ, মাত্রা এবং সময়ের হিসেবে কয়েক বছর পিছিয়ে দেওয়া হলো। স্থবির করে দিলো আমাদের প্রগতির পথ। স্বাধীন দেশে আমরা স্বৈরাচারের শৃঙ্খলে আটকা পড়ে গেলাম। স্বাধীন দেশের চেহারা আচমকা বদলে গেল। অরাজনৈতিক এই জঘন্য ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থা হয়ে গেল ছিন্নবিচ্ছিন্ন।
আবেগের বশবর্তী হয়ে কিংবা অন্যের প্ররোচনায় কয়জন সামরিক কর্মকর্তা আর তাদের এদেশীয় ক্ষমতালিপ্সু দোসর ও বিদেশি চক্রান্ত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পথচলাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। গণতন্ত্রকে সামরিক বুটের নিচে ফেলে পিষতে থাকল। নাজুক করে দিলো দেশ।
আমরা হারালাম কৃষক, শ্রমিক, মজুর আর বাংলাদেশের খেটে খাওয়া আপামর মানুষের আপনজনকে। শাহাদতবরণ করলেন বঙ্গবন্ধু।
আত্মীয়স্বজন-সহ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা পৃথিবীর বর্বরোচিত, নৃশংসতম, ন্যাক্কারজনক কুটিল অধ্যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আনত শ্রদ্ধা, প্রগাঢ় ভালোবাসা এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দৃপ্ত প্রত্যয়।
জয় বাংলা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক।