বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের উন্নয়ন বিস্ময়কর
আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী যেমন উদযাপন করছি একইসাথে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি। আমি খুব সহজভাবে যদি বলি, বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের উন্নয়ন বিস্ময়কর। বাহাত্তর সালে অর্থনীতির আকার ছিল আট বিলিয়ন ডলার সেটি এসে দাঁড়িয়েছে চারশ ষোল বিলিয়ন ডলার। খুব স্বাভাবিক হিসেবে যদি ধরি, অর্থনীতি ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। একইসাথে বাহাত্তর সালে আমাদের দারিদ্রের হার ছিল আশি শতাংশের বেশি। সেটি এখন কোভিডের আগে দিয়ে বিশ শতাংশে নেমে এসেছে। কোভিডের কারণে এটি হয়তো সামান্য বেড়েছে, কিন্তু আমি মনে করি সেটি সাময়িকভাবে বেড়েছে। বিশের কাছাকাছিও যদি থাকে, তবুও আমি মনে করি দারিদ্রের বিচারেও কিন্তু আমাদের সফলতা কম না। বাহাত্তর সালে বিদ্যুৎ মাত্র আট দশমাংশ মানুষের ঘরে গিয়েছিল, এখন প্রায় শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ যাচ্ছে এই পঞ্চাশ বছরে। বাহাত্তর সালে আমাদের গড় আয়ু ছিল সাতচল্লিশ। সেটি এখন তিয়াত্তর বছর। খাদ্যে আমরা মাথাপিছু চাল উৎপাদন করতাম একশ চল্লিশ কিলোগ্রাম। এখন আমরা সেটি উৎপাদন করি প্রায় আড়াইশ কিলোগ্রাম। আমরা মাত্র ছয়টি ডিম উৎপাদন করতাম মাথাপিছু, এখন আমরা একশ'র উপরে মাথাপিছু ডিম উৎপাদন করছি। কাজেই একথা নিশ্চয় বলতে পারি যে, অংকের বিচারেও বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যপক প্রসার ঘটেছে। দারিদ্র নিরসনেও বাংলাদেশের সাফল্য মোটেও কম না।
এতকিছুর পরেও চ্যালেঞ্জিং বিষয় যেটি, যে চ্যালেঞ্জটি রয়ে গেছে সেটি হল, বৈষম্য। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্য বেশ বেড়েছে। বেড়ে যাবার একটি বড় কারণ হল, কতিপয় ধনি তারা অনেকবেশি ধনী হয়ে গেছে। সেই কারণে সম্পদের একটি বড় হিস্যা তারা পাচ্ছে। তারমানে এটিও নয় যে, যারা পিরামিডের নীচের দিকে আছে তারা না খেয়ে আছে। সেটিও ঠিক না। তাদেরও চাপ আছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের উপর যথেষ্ট চাপ আছে। জিনিসপত্রের দাম তাদের জন্য ধরা ছোয়ার বাইরে চলে গেছে। তা স্বত্তেও আমি বলব, পশ্চিমবঙ্গের সাথেও যদি মিলিয়ে দেখি, যারা একেবারেই গরীব মানুষ, থাকার মতো ঘর নাই, একখণ্ড জমি নাই, এরকম মানুষ পশ্চিমবাংলায় অনেক আছেন, কিন্তু সেই তুলনায় আমাদের এখানে কম। পায়ে একজোড়া জুতো নেই, এরকম মানুষ পশ্চিম বাংলায় আছে কিন্তু আমাদের এখানে অনেক কম। তারা হয়তো খুব ভাল নেই, কিন্তু তারা দুই বেলা খেয়ে পরে বেচে আছে। স্বাধীনতার পরে আমরা দেখেছি মানুষ না খেয়ে মারা গেছে, বলব না যে তারা না খেয়ে মারা গেছেন, অনেক রকম সামাজিক অপ্রাপ্তি ছিল, সেটি অনেকটাই কেটে গেছে। কিন্তু শাসন ব্যবস্থায় বিশেষ করে দুর্নীতি কারসাজি ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে, বঙ্গবন্ধু আসলে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন, সেটি আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। দুর্নীতি এখনও ব্যাপক আছে। কতিপয় মানুষের কাছে এখনও সেবা পৌঁছায়নি। যদিও সাম্প্রতিককালে ডিজিটাল সুবিধার কারণে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। কিন্তু এখনও অনেকটা পথ আমাদের হাটতে হবে সেই স্বস্তিময় শাসন ব্যবস্থার দিকে।
এক্ষেত্রে যে বিষয়টি না বললেই নয়, তা হল, নারীর ক্ষমতায়ন। আগে মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতো না, এখন চল্লিশ শতাংশ মেয়েরা আনুষ্ঠানিক কাজের সাথে যুক্ত। উন্নয়নের ধারার মধ্যে একটি ধারা হল, ম্যনুফেকচারিং খাত অর্থাৎ শিল্পখাত। বিশেষ করে গার্মেন্টস, চামড়াসহ অনেকগুলি অবকাঠামোগত খাতের উন্নয়ন হয়েছে। রপ্তানি খাতে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মত। ৩৮ থেকে ৪০ শতাংশ নারী এখন আনুষ্ঠানিক কাজে যুক্ত। এর প্রভাব কিন্তু সারা বাংলাদেশেই পড়েছে। নারীর এই অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ার কারণে সমাজের ভিতরেও কিন্তু এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
আরেকটি খাত যেটি পঞ্চাশবছরে অনেক বেড়েছে তা হল প্রবাসী আয়। প্রবাসী আয় বাহাত্তর তিয়াত্তর সালে ছিলই না, গতবছর আমরা পচিশ বিলিয়ন ডলার পেয়েছি। এবছরও সম্ভবত বাইশ বিলিয়ন বা তার বেশিই পাব। এই যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশ থেকে আসছে, সেটি কিন্তু সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়রা আনছে। গ্রামে গঞ্জে তার প্রভাব পড়ছে। গ্রাম বাংলা বদলে গেছে। গ্রামে আগের মত খোরপোষের কৃষি নাই। মডার্ন কৃষি, ডাইভারসিফাইড কৃষি, কৃষির পাশাপাশি অকৃষি খাত। গ্রামে এখন নানা ধরণের কর্মকাণ্ড হচ্ছে। গ্রামেও এখন কমিউনিটি হাউজ হচ্ছে। কফিশপ হচ্ছে। গ্রাম বাংলাও বদলে যাচ্ছে। শহরের অনেক সেবা গ্রামেও যাচ্ছে। মায়েদের সেবা, শিশু সেবা, প্রসুতি সেবাসহ নারীর উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তার সুফল কিন্তু গ্রাম বাংলাও পাচ্ছে। এমন কিছু অসুখ বিসুখ আছে যেগুলি সামাল দেওয়া গরিব মানুষের পক্ষে সম্ভব না। এছাড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষনীয়। শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। গরিব মানুষের সন্তানেরাও পড়ালেখা শিখছে। হয়তো গুণগত মানে এখনও আরও উন্নয়ন দরকার। তবে চেষ্টা তো হচ্ছে। শিশু বৃত্তি, মায়েদের আর্থিক সাহায্য প্রদানসহ অনেক কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে গ্রামের মেঠোপথ। সেই মেঠোপথের বেশ উন্নয়ন হয়েছে। সেই মেঠোপথ ধরেই আমরা সড়ক মহাসড়কে যাই। এখন সেই মহাসড়কে শহরের অনেক স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়রা আসছে। আশা করি খুব ভাল সাড়া পাওয়া যাবে।
লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক