কেজরিওয়াল কোনো বিকল্প নন
ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টি (আপ) জেতায় দুই ধরনের লোক খুশি। এক রকম হচ্ছে–যাক বাবা পরিবারবাদী মা-ভাই-বোনের দল কংগ্রেসের হাত থেকে পাঞ্জাবিরা এই যাত্রায় মুক্তি পেল! কারণ, মা সোনিয়া ক্যাপ্টেনকে ইস্তফা দিতে বলেছিলেন। আর রাহুল মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন চান্নিকে। আরেকদল মনে করেছেন, দিল্লি হোক কি পাঞ্জাব, বিজেপিকে কেজরিওয়ালের দল আপই ঠেকাতে পারবে। তাদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের দিদি নয়, কংগ্রেসের বিকল্প হচ্ছে আপ। উদাহরণ স্বরূপ এরা বলছেন, গোয়াতেও আপ দুটি আসন পেয়েছে। কিন্তু তৃণমূল কোটি কোটি টাকা খরচ করেও একটি আসন জিতেনি। ফাল্গুনের দুপুরের কড়া রোদে কলকাতায় আপ মিছিল করেছে। এটা বাঙালিদের একাংশের কাছেও একটা বড় খবর।
স্থানীয় সূত্রে এমনটাও জানা গেছে যে, পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের মুসলিমরা সব আপে নাম লেখাবে বলছে। কারণ কংগ্রেস তো হাওয়া হয়ে গেছে। বিকল্প তো দরকার। তারা মমতায় বিশ্বাসী নন। মমতা বিজেপির সঙ্গে বারেবারে ঘর বেঁধেছেন। বিজেপির দুই সাবেক মন্ত্রী শত্রুঘ্ন সিনহা ও বাবুল সুপ্রিয়কে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল আর বালিগঞ্জ কেন্দ্রে প্রার্থী করেছেন মমতা। তার থেকে বাবা আপই ভালো!
সত্যিই বিজেপির বিকল্প দরকার বটে। তাই আন্না হাজারের আন্দোলনকে মূলধন করে দল গঠনের দুই বছরের মধ্যেই একে একে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যোগেন্দ্র যাদব, প্রশান্ত ভূষণ কুমার বিশ্বাসদের অপমান করে তাড়িয়ে দিয়ে গোটা দলটা আত্মসাৎ করা ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের প্রাক্তন অফিসার কমনম্যান কেজরিওয়াল তাদের কাছে বিকল্প মুখ।
পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে দিল্লির বিধানসভা জিতে কেজরিওয়াল প্রথম ছুটে গিয়েছিলেন হনুমান মন্দিরে পূজা দিতে। এরপরে দিল্লির দাঙ্গায় তার সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নিয়েও অনেক প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু কেজরিওয়াল স্পিক-টি-নট। বেনারসের মন্দিরে দাঁড়িয়ে আগেই কাশির মন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন। গোয়ায় জিতলে বিনে পয়সায় তীর্থ যাত্রার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অরবিন্দ কেজরিওয়াল নামে অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোকটি এইসবই করেন। কারণ তিনি আরেকটি নরেন্দ্র মোদি হতে চান। তিনি আসলে তো আরএসএসের প্ল্যান-বি। যদি কোনো কারণে বিজেপি ব্যর্থ হয়, কেজরিওয়াল আছেন।
জেনে রাখুন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল সত্যি সত্যিই আরএসএসের এজেন্ট। তিনি, তার পরিবার জনসংঘ পরিবার, এটিও সত্যি। মনে রাখতে হবে এই জনসংঘই আজকের বিজেপি। বিজেপি আদভানির মতো নরেন্দ্র মোদিও জনসংঘ করতেন। সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, এই কেজরিওয়াল ছোটবেলা থেকেই আরএসএসের খুব কাছের ছিলেন। এমনকি যখন খড়গপুর আইআইটিতে পড়াকালিন সময়ে এবং তার পরবর্তীকালেও আর এসএস করতেন। পরে লোকপাল বিল নিয়ে আরএসএসের খাস লোক আন্না হাজারের সঙ্গে একমঞ্চে যোগ দেন। সঙ্গে ছিলেন বাবা রামদেব, কিরণ বেদি প্রমুখ। তারা সকলেই মোদি ঘনিষ্ঠ হিসেবে নানাভাবে লাভবান হয়েছেন। সবাই তা জানেন।
খুশি হিন্দুদের এক বড় অংশের মানুষও। যারা মনে করেন দেশের সবচেয়ে বড় বিপদের নাম পাকিস্তান। মুসলিম মানেই দেশদ্রোহী। তাদের বিশ্বাস করা উচিত নয়। উত্তর প্রদেশে ২০ শতাংশ মুসলমান বাস করেন। বিজেপি তাদের দলের পৌনে চার শ সদস্যের মধ্যে একজন মুসলমানকেও তাদের দলের প্রার্থী করেনি। তারা আরও মনে করে চা-ওয়ালার পুত্র নরেন্দ্র দামোদাস মোদি যা করেন, দেশের মানুষের ভালোর জন্যই করেন। মহাত্মাগান্ধী আর জওহরলাল নেহরুর কংগ্রেস দেশের সর্বনাশ করেছে। না হলে দেশ কোথায় এগিয়ে যেত। চীনই শুধু নয়, আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যেত। তারা আরও মনে করে নেহেরু, ইন্দিরা রাজীবের উত্তরাধিকারি রাহুল আসলে একটা ‘পাপ্পু’। ওর বোনটিও একটা ক্ষমতালোভি। গান্ধী পরিবার মুক্ত ভারত গড়তে তাই বিজেপিকেই ভোট দেওয়া উচিত। যাতে যোগীর মতে ‘ইটলি কা ভাই-বেহেন’ দেশ থেকে পাকাপাকিভাবে বিদেশ চলে যায়। কিন্তু এর পরিণামের কথা অন্ধ মোদি ভোটার, যাদের দেশের ভক্ত মনে করা হয়, তারা কখনও ভাবতে চায় না।
মোদির এই বিপুল জয়ে সবচেয়ে লাভবান হবে কে? বিজেপির সবচেয়ে বড় বন্ধু, অর্থের জোগানদাতা গৌতম আদানি। আগামী দুই বছরের জন্য তার সামনে খুলে গেল সম্পদ লুটের বিপুল ভান্ডার। এর আগেই মোদির আশীর্বাদে ১১টি জলবন্দর এবং ৮টি স্থলবন্দর পেয়েছেন গৌতম আদানি। এবার সরকারি তেল কোম্পানির দিকে হাত বাড়িয়েছেন। ইন্ডিয়ান অয়েল আদানির সঙ্গে যৌথ ব্যবসার জন্য চুক্তি সই করেছে। এবার বিক্রি হবে পেট্রোলিয়াম, সেখানেও আদানি অন্যতম দাবিদার। হয় আদানি নয়তো মুকেশ আম্বানি পেট্রোলিয়াম কিনে নিবে। ফলে তেলের দামের উপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াবে।
ইতিমধ্যে ট্রাক্টরসহ কৃষি সরঞ্জাম কেনার জন্য চাষিদের স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া যে ঋণ দেয়, তা আদানি ক্যাপিটালের মাধ্যমে দেওয়ার জন্য। এসবিআইয়ের সঙ্গে আদানি ক্যাপিটালের চুক্তি হয়েছে। লক্ষাধিক এসবিআই কর্মচারী আর গ্রামের প্রত্যন্ত প্রান্তে এসবিআইয়ের শত শত শাখা কাজ করতে পারছে না, মাত্র কয়েক হাজার আদানি ক্যাপিটালের কর্মী সেই কাজ সহজে করবেন–কি অদ্ভুত যুক্তি। আসলে এই ঋণের জন্য চাষীরা প্রত্যক্ষভাবে আদানির কাছে নিজেদের বন্ধক রাখবে। ব্যাংকের টাকা কৃষকদের ঋণ দিয়ে মাঝখানে গৌতম আদানি কমিশন খাবেন। কি দারুণ কৌশল! আর এসবের বিনিময়ে ২০২৪ সালের আগে বিজেপির ভান্ডার আরও ভরে উঠবে হাজার হাজার কোটি টাকায় কেনা ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক
এসএ/