নারী জাগরণে হতে হবে প্রত্যয়ী
নারী তোমার ভেতরে লুক্কায়িত হাজারো গোলাপ, পাপড়ি ছিটিয়ে তুমি জানান দাও তোমার পদযাত্রা। তুমি কন্যা, জায়া, জননী। তুমি আমাদেরই করেছো মহীয়ান। হ্যাঁ, আমি সেই নারীকেই বুঝিয়েছি যারা দেশের অগ্রযাত্রায় শামিল হয়েছে আমি তাদেরই কথা বলতে চাই। সমাজে নারীকে কখনো দেখা হয় মমতাময়ী, আবার কখনো দেখা হয় নির্দয়, মমতাহীন কুচক্রের রানি হিসেবে। হাজারো শৃংখল তার পায়ে বিদ্ধ, কখনো উড়ার মতলব নিয়ে হিংস্র দাবানল নিভিয়ে প্রতিক্ষণে স্বাধীনতার সুখ পেতে চায়।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারীর অগ্রযাত্রাকে স্থায়ী রুপ দিতে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা অন্তর্ভূক্ত করেন। পৃথিবীর সব নারীর অধিকার রক্ষায় ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয় এবং তা যথাযথভাবে পালনের জন্য পৃথিবীর সব রাষ্ট্রকে আহ্বান জানানো হয়। ৮ মার্চ নারী দিবস প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদেরকে জানান দেয়। আমরা নারীরা কি বুঝতে পারি এর মর্মার্থ? অনেক দেশেই খুব জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালিত হয় দিনটি। বাংলাদেশেও নারী দিবসে আলোচনায় আসে নারাীদের কথা, আত্মপ্রত্যয়ী হবার কথা, সিম্পোজিয়াম, সেমিনার, র্যালি, অনলাইন প্লাটফর্মে, গণমাধ্যমে টকশো-তে, বিশেষ নিবন্ধ আরও কত কি আয়োজন। আমরা এগুলোর মাধ্যমে নারী জাগরণের একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সুবাতাস বইতে দেখি।
সমাজের নারীরা এখনও আগের মতোই রয়েছে অধিকার বঞ্চিত। শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে নারীরা চরম নির্যাতনের শিকার। সমাজে একজন নারী ধর্ষিত হলে চক্ষু লজ্জার ভয়ে মুখ খুলতে চান না। যারা মুখ খোলেন প্রতিবাদ করেন উল্টো তাদের দোষ খুঁজে বের করে জনসম্মুখে চরিত্রের কালিমা লেপন এবং হেনস্তা করা হয়। যা সবসময় ঘটছে আমাদের আশেপাশে, তাহলে ভাবুন তো আমরা নারীর যথাযোগ্য সম্মান দিতে পারছি কি? আমাদের সমাজের অস্থিমজ্জায় কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি এবং সমাজে নারীর প্রতি অপদৃষ্টি দূর করা প্রয়োজন। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় মানবকূলের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত নারীর প্রতি অন্যায়, হয়রানি, অনাচার চলতেই থাকবে। আবার নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য ও বিড়ম্বনাও কম নয়। কর্মজীবী নারী কর্মক্ষেত্রে ও অফিস সহকর্মী দ্বারা হয়রানি বা হেনস্তার শিকার হোন। একজন শিক্ষিত নারী সেও স্বাধীন হতে পারেনি। অন্যায় দেখে প্রতিবাদ করেও পরিত্রান পাওয়া কঠিন হয়ে পরে একজন নারীর পক্ষে।
কন্যারা জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত দেশ মাতৃকার মুক্তি অসম্ভব। বেগম রোকেয়ার অসাধারণ চিন্তা চেতনায় মিশে আছে নারীর অধিকার, নারীর কল্যাণ, নারীর মুক্তি। একজন গবেষক হিসেবে মনে করি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার আদর্শ এবং দর্শন প্রতিটি নারীর ভেতরে লালন এবং বেগবান করা অবশ্য কর্তব্য। বেগম রোকেয়া নারীর ক্ষমতায়নের ভবিষ্যৎ রূপরেখা এঁকেছিলেন এভাবে: “তোমাদের কন্যা শিশুদিগকে শিক্ষিত করিয়া ছাড়িয়া দাও, দেখিবে তারা নিজেদের অন্ন বস্ত্রের ব্যবস্থা নিজেরাই করিয়া নিতে পারিবে”। বেগম রোকেয়ার চিন্তা চেতনায় মিশে ছিল নারী জাগরণ। তিনি বহু আগেই সমাজ পরিবর্তনের ঝান্ডা তুলে ধরেছেন। তিনি শতবর্ষ আগেই বলে গেছেন, “মানব সমাজ একটি দুই চাকার গাড়ির মতো, সমাজ এগিয়ে যায় সেই চাকার উপর ভর করেই। কিন্তু এক চাকাকে দূর্বল রেখে কিংবা অচল রেখে অপর চাকার উপর নির্ভর করে খুব বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া যায় না। গৃহের সিলেবাসে বন্দি নারীরা আজ অনেকটাই শৃংখলমুক্ত আশা জাগানিয়া হয়ে থাকতে ভালোবাসে। তাইতো বর্তমানে নারীরা গৃহের রুটিন কর্ম থেকে বের হয়ে জাগরণের স্পৃহা নিয়ে দেশের প্রতিটি স্থানে প্রতিনিধিত্ব করছে। এটা নারীর ক্ষমতায়ণের একটি ইতিবাচক দিক। লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। রাজনীতি, প্রশাসন তৃণমূলে সকল ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে এটা বলতেই হবে। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার সকল ক্ষেত্রেই নারীকে দিতে হবে যোগ্য সম্মান। বৈষম্য কমিয়ে আনার প্রত্যয়ে আমাদেরকে বসে থাকার মনমন্ত্র দূর করে এগিয়ে আসার আহবান সকলের প্রতি।
লেখক: বেগম রোকেয়া পদক প্রাপ্ত ২০২১, গবেষক ও লেখক