জয় হোক নারীর, জয় হোক মানবতার
আজ ৮ই মার্চ, সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করছি আমরা।
আমরা অনেক দিবসের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা বা তারতম্য কতটা বুঝে করি, কতটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে, আমাদের বোধ হয় সময় হয়েছে এটা বিশ্লেষণ করে দেখার। ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চে নিউইয়র্ক শহরে পোষাকশিল্পের নারী শ্রমিকরা কাজের ঘণ্টা কমানো এবং মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে নামে। পরে ১৯০৯ সালে আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক নারী সংগঠন ভোটের অধিকার, মজুরি বৃদ্ধি ও কর্মঘণ্টা নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। সেই থেকে শুরু।
দ্বিতীয়টি ছিল আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সংগঠনগুলোর একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ। সেই সম্মেলনে জার্মান নেত্রী ক্লারা জেটকিন প্রস্তাব করেন যে ৮ই মার্চ হবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। তখন থেকেই শুরু এই দিবসটির উদযাপন, ঠিক যেভাবে ১ মে হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। একই চিন্তা থেকেই নারীদের জন্য আলাদা একটি দিন ধার্য করা হয়। তখন কেবল এই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো এবং প্রগতিশীল চেতনায় উদ্বুদ্ধ সংগঠনগুলো এই দিবসটি পালন করত।
জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালকে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ ঘোষণা করে এবং মেক্সিকোতে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরে জাতিসংঘ এটিকে দশক হিসেবে গ্রহণ করে ১৯৮৫ সালের নাইরোবি সম্মেলনে। এর পরের দশকে ১৯৯৫ সালে বেইজিংএ বিশাল আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের মাধ্যমে গোটা বিশ্ব এই দিবসটি পালন করে।
পৃথিবীর অর্ধেক জনগণ নারী, তাহলে এদের জন্য আলাদা দিবসের প্রয়োজনীয়তা কেন? পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় যেখানে নারীদেরকে সমান মর্যাদা, সমানাধিকার, সমান দৃষ্টিভংগীতে দেখার বিষয়টি এখনও অনেক দূরের, সেক্ষেত্রে এই ধরনের সম্মেলন অনুষ্ঠান, নীতি নির্ধারন, এবং আন্তর্জাতিক সনদ গঠন এখন অবশ্যই প্রয়োজন। এটা আমাদের, অর্থাৎ গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।
একটি দিনে আমরা আমাদের অবস্থা বিশ্লেষণ করে গোটা বছরের কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচী মূল্যায়ন করছি, কোথায় দুর্বলতা আছে, আর কী আমাদের প্রয়োজন এই মুহূর্তে, আমরা এখনও পরিষ্কার নই, তাই এই বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা এখনও রয়েছে।
বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে; আমাদের গড় আয়ু, নারীদের গড় আয়ু, যাদেরকে বলে উন্নত দেশ, তাদের সমান পর্যায়ে এসেছে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমেছে, নারীদের কর্মসুযোগ এবং কর্মক্ষেত্রও অনেক বেড়েছে। এখন যেমন কলকারখানায় নারী শ্রমিকদের দেখা যায়, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এতে পোষাকশিল্পে নারীদের বড় অবদান রয়েছে, তেমনি গ্রামে ক্ষেত খামারে নারী কৃষি শ্রমিকদের সংখ্যাও বেড়েছে। যে পেশাগুলোকে মনে করা হতো পুরুষদের, সেসব ক্ষেত্রেও এখন নারীরা সমানভাবে কাজ করছে, নারীদের জন্য সব দ্বার খুলে গেছে। তারপরও কথা রয়ে যায়, বাড়ির কাজ এখনো নারীদেরই দায়িত্ব হিসেবে রয়ে গেছে এবং জাতীয়ভাবে এটার অর্থনৈতিক কোনো মূল্য ধরা হয় না যখন একটি দেশের গড় জাতীয় আয় ঠিক করা হয়।
প্রতিক্ষেত্রেই দেখা যায় নারী শ্রমিক পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় কম মজুরী পায়। যদিও আমাদের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, নারী এবং পুরুষের কোনও বৈষম্য নেই। নারী বাইরে কাজ করলেও বাড়ীর সব কাজ যেহেতু নারীকেই সামাল দিতে হয়, তাই ধরে নেয়া হয় যে নারী কর্মক্ষেত্র থেকে আগে চলে যাবে, ফলে সে কম কাজ করবে। বাস্তবে যদিও দেখা যায়, নারীরা কম ফাঁকি দেয় এবং পুরুষের তুলনায় কোনও অংশেই কম কাজ করে না। এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে সৃষ্ট। এরই ফল আমরা দেখি ভয়াবহভাবে নারীর শরীরের উপর আক্রমণ, নির্যাতন, যৌন হয়রানী, ধর্ষণ এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে একটি বৈষম্যমূলক অবস্থানের মধ্যে দিয়ে।
তাই আমাদের আজকের দিনের ডাক হচ্ছে-এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এই পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত পুরুষ কখনোই অন্যকে সম্মান করতে শিখবে না। তাই সকল ক্ষেত্রের ভিন্নতা–তা সে সামাজিক, অর্থনৈতিক, জাতিগত, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় বা যে কোনও ভিন্নতাই হোক না কেন--সকলকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা ও সম্মান দেখাতেই হবে।
এই হোক আমাদের আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২২ এর অঙ্গীকার।
জয় হোক নারীর।। জয় হোক মানবতার।।