শতভাগ আস্থা অর্জন করতে পারেনি ইসি
আগামী সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, কীভাবে করলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে- সে বিষয়ে ধাতস্থ হতে রাজনৈতিকদলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংলাপের আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান ইসির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করা। তবে পুরোপুরি আস্থা অর্জনে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা মনে করেন, এ সংলাপ ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। ইসির টার্গেট ছিল নিবন্ধিত ৩৯টি দল তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সংলাপে বসবে। আর এতেই তাদের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ সমর্থন পাওয়া যাবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্রদলগুলো সাড়া দিলেও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা। মোট ২৮টি দল সংলাপে অংশ নিয়েছে। আর দুটি দল অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে ইসির কাছে সময় চেয়েছে। অর্থাৎ ৩০টি দল ইসির সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সংলাপ ইস্যুতে ইসির প্রধান টার্গেট মিস হয়েছে। তবে সংখ্যার হিসেবে নিয়ে নিবন্ধিত বেশিরভাগ দলই তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছে। কিন্তু রাজনীতির মাঠের পরিসংখ্যান ধরলে বড় একটা পক্ষ তাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। তাই পুরো নম্বর দিতে চান না বিশ্লেষকরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘এটা অনর্থক সংলাপ। এটাকে সংলাপ বলা যায় না। এটা গল্প করার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল, সবাই গল্প করেছে। সংলাপে অধিকাংশ দল ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে এতে ইসির কী করণীয় আছে। সংলাপ হয় সমাধানের জন্য, এ সংলাপ থেকে কোনো সমাধান আসবে বলে মনে হয় না।’
সংলাপে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মতামত ও প্রস্তাব তুলে ধরেছে। সংলাপের শেষ দিন রবিবার (৩১ জুলাই) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণসহ ১৪টি প্রস্তাবনা দিয়েছে। তাদের প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় কর্মকর্তা পর্যায়ে হাওয়া ভবনের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক দলীয় ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব দলীয় ব্যক্তি এখন নির্বাচন কমিশনের আওতাভুক্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছে। নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত রাখার লক্ষ্যে এ বিষয়ে কমিশনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া, বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময় দলীয়করণের অংশ হিসেবে পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনে ব্যাপকভাবে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়োগ করেছিল। এদের অনেকেই এখন জেলা পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অথবা দায়িত্ব পাওয়ার জন্য অপেক্ষমান। এসব দলীয় কর্মকর্তাদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের সব ধরনের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে বাইরে রাখতে হবে।
অন্যদিকে ইভিএম এর বিরোধিতা করে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বলেছে, তারা চায় আনুপাতিক হারে ভোট পদ্ধতি। তারা আরপিও সংশোধনের প্রস্তাবও করেছে। এ ছাড়া বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছে দলটি। শুধু জাতীয় পার্টি নয় ১৬টি দল ইভিএম এর বিপক্ষে মতামত দিয়েছে। তা ছাড়া কোনো কোনো দল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সীমিত আকারে মেশিনটি ব্যবহারের জন্য বলেছে। দলগুলো হচ্ছে— বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাকের পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। আর জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) পেপার ট্রেইল যুক্ত করা সাপেক্ষে ইভিএম ব্যবহার করার জন্য বলেছে।
ইসির সংলাপে অংশগ্রহণ করা ২৮টি দলের পক্ষ থেকে তিন শতাধিক প্রস্তাব এসেছে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে। কিছু কিছু প্রস্তাব আছে যেগুলো নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে। অনেকে আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে দিতে বলেছে। কোনো কোনো দল নির্বাচনকালীন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। এসব প্রস্তাব ইসির এখতিয়ারের বাইরে। এগুলো করতে হলে সরকারকে আইন সংশোধন করতে হবে। সংলাপে অংশগ্রহণ করা ১৫টি দল চায় নির্বাচনকালীন সরকার।
এ ধরনের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, রাজনৈতিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকেই সমাধান করতে হবে। সবার সর্বাত্মক অংশগ্রহণ না থাকলে কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয় বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা এটিও বলেছে নির্বাচন হবে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে সেটা যে সরকারই থাকুক। ইসির ভাবনা অবাধ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ ভোটের ব্যবস্থা করা।
যেসব দল সংলাপে অংশগ্রহণ করেনি তাদের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য আমরা দাওয়াত দিয়ে যাব। আমরা চাইব সব দল নির্বাচনে আসুক নির্বাচন করুক। সব দল নির্বাচনে এলে আমাদের কাজটাও সহজ হয়ে যাবে।
সিইসি আরও বলেন, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার সাধ্যমতো চেষ্টা তারা করবেন। সরকার সহযোগিতা করবে। সংসদ নির্বাচনের কাজটা জটিল। তবে সবার আন্তরিক সহযোগিতা থাকলে জটিল, কঠিন কাজ হলেও অনেকটা ফসল তুলে আনা যাবে।
সিইসি বলেন, আমি মনে করি, নির্বাচনের মাঠে যদি প্রতিপক্ষ থাকে, দলগুলো থাকে, তাহলে ভারসাম্য হয়ে যায়।
নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার এ সরকারই করতে পারবে। দলগুলোর প্রস্তাব পর্যালোচনা করে সরকারের কাছে, দলের প্রধানের কাছে সারসংক্ষেপ পাঠিয়ে দেবে কমিশন।
ইসির ডাকে সাড়া দেয়নি যে ৯টি দল
বাংলাদেশ মুসলীম লীগ-বিএমল, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এলডিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
এনএইচবি/এসএন