‘আদিবাসী’ নিয়ে ৪৯ বিশিষ্ট নাগরিকের যৌথ বিবৃতি
‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের ১৯ জুলাই'র সার্কুলার সংবিধান-পরিপন্থী ও উচ্চ আদালত অবমাননাকর উল্লেখ করে এই সার্কুলার অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন দেশের ৪৯ বিশিষ্ট নাগরিক।
এএলআরডি'র নির্বাহী পরিচালক, শামসুল হুদার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে ৪৯ বিশিষ্ট নাগরিক বলেন, “আমরা গভীর ক্ষোভ ও বিস্ময়ের সঙ্গে জেনেছি যে, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সকল টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধানদের কাছে একটি সার্কুলার পাঠিয়ে বলা হয়েছে ‘৯ আগস্ট ২০২২ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টকশো-তে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্যকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য’।
যে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় এই সার্কুলার প্রচার করেছে, সেই সরকারের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ২৮(ক) ধারায় একাধিকবার আদিবাসী শব্দটি স্পষ্ট করে ব্যবহার করা হয়েছে।
বিবৃতিতে তারা বলেন, এই সার্কুলারটি আসলে একটি সংস্থার পরিপত্রকে ভিত্তি করেই রচিত এবং তার অনুলিপি হিসেবেই প্রচার করা হয়েছে। কোন শব্দটি সংবিধান সম্মত কিংবা অসাংবিধানিক তা নির্ধারণ করার এখতিয়ার একটি সংস্থা কিংবা তথ্য মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার প্রণয়নকারীদের কাছে কখন কিভাবে গেল তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগের সঙ্গে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এটি চরম অনধিকার চর্চার পর্যায়ে পড়ে, যা মোটেই কাম্য নয়, আইনসম্মতও নয়।
কারণ আমাদের দেশের সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধানের কোন ধারা বা বিষয় নিয়ে কোন বিতর্ক বা মতান্তর দেখা দিলে তার ব্যাখ্যা একমাত্র দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টই দিতে পারবে। অন্য কোন প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নয়। আর বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টেরই এক রায়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারে কোন আইনগত প্রতিবন্ধকতা নেই।
তদুপরি এ কথাও আজ দিবালোকের মতো সত্য যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারই ১৯৭২ সালে যে আইএলও কনভেনশন ১০৭ অনুস্বাক্ষর করে গেছেন সেখানেও আদিবাসী বা Indigenous শব্দটি শুধু ব্যবহারই নয়, তাদের সকল অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। এ ছাড়া কয়েক মেয়াদে ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে তার দেয়া বানীতে আদিবাসীদের নিজস্ব পরিচয়ে সকল অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার উপর বলিষ্ঠ ভাষায় গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
সর্বোপরি সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২(ক) ও ২(খ) ধারায় যে বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেয়া রয়েছে তাতেও এই সার্কুলারে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। একজন কি কি শব্দ চয়ন করলেন তাতে রাষ্ট্রের কারও কিছু বলার নাই, যদি এই শব্দ ব্যবহারে অন্য কারও প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃনা না ছাড়ানো হয়। তাই এই সার্কুলার তথা নির্দেশনার প্রতি আমরা তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক ঔদ্বত্যপূর্ণ সার্কুলার জারি করে আদিবাসী ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করা কিংবা স্বাধীন মতামত প্রদানকারী নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের হেয় করার প্রচেষ্টা থেকে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে বিরত থাকার আহ্বান রাখছি। আর অবিলম্বে তথ্য মন্ত্রণালয়ের আলোচনা এখতিয়ার বহির্ভূত সার্কুলার প্রত্যাহারের জোর দাবি জানাচ্ছি।
বিবৃতিদাতারা হলেন- মানবাধিকার কর্মী ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল, নিজেরা করি'র সমন্বয়কারী ও এএলআরডি চেয়ারপার্সন খুশী কবির, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী ড. হামিদা হোসেন, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, নারীপক্ষ সদস্য শিরিন হক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, রিসার্স ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের (রিব) নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যন্সেলর পারভীন হাসান, চাকমা রানী ও উপদেষ্ট চাকমা সার্কেল চীফ রানী ইয়েন ইয়েন, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ, মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. জেড আই খান পান্না, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সহ-সভাপতি ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট তবারক হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও এইচডিআরসি'র উপদেষ্টা, ড. আবুল বারকাত, কবি ও লেখক রেহনুমা আহমেদ, এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অনারারি নির্বাহী পরিচালক, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, এমিরেটাস অধ্যাপক, ব্লাক হিল স্টেট ইউনিভার্সিটি ও জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের ডিজ আহরার আহমেদ, ব্রতি'র নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুর্শিদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, আলোকচিত্রী ও সমাজকর্মী ড. শহিদুল আলম, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক, জাকির হোসেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, বেলা'র প্রধান নির্বাহী, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বীনা ডি’ কস্টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, ইংরেজী বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক, তাসনিম সিরাজ মাহবুব, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়েরইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক ফেরদৌস আজীম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন কণা, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক নোভা আহমেদ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস কাউন্সিলের ম্যানিজিং ডিরেক্টর মাহরুখ মহিউদ্দিন, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রেজাউল করিম লেনিন, সাংবাদিক ও গবেষক সায়দিয়া গুলরুখ, মানবাধিকার কর্মী মো. নুর খান লিটন, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, মানবাধিকার ও আদিবাসী অধিকার কর্মী হানা শামস আহমেদ, কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, সঙ্গীতশিল্পী ও লেখক অরূপ রাহী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, আইনজীবী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী এবং মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
এনএইচবি/এএস