শিলংয়ে যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করলেন রণাঙ্গনের যোদ্ধারা
মেঘ-পাহাড়ের দেশ মেঘালয়ের শিলংয়ে পা রেখেই বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে গেলেন ৫০ বছর আগে। ১৯৭১ এর সেই দিনগুলোতে। যেদিন কাঁধে কাঁধ রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। টগবগে তরুণরা। তাদের সঙ্গে স্মৃতিচারণে মেতে উঠলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় যোদ্ধারাও। তখন কে কোথায় ট্রেনিং নিয়েছিলেন, কীভাবে যুদ্ধ করেছিলেন কিংবা যুদ্ধের শহীদ সহকর্মীদের দাফন কাফনে ব্যস্ত ছিলেন।
যুদ্ধ দিনের সেইসব স্মৃতি মনে করে অনেকেই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তাদের মেলবন্ধনে অন্যরকম এক পরিবেশের সৃষ্টি হল শিলংয়ের হোটেল পাইনউডে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং হচ্ছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম স্মৃতি বিজড়িত স্থান। সেখানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে রণাঙ্গানের বীর সেনানিরা একত্রিত হয়েছিলেন রবিবার (১৭জুলাই)।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ৫০ বছরেরও বেশি সময় পর শিলংয়ে একত্রিত হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্য সরকারের সৌজন্যে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন বাংলাদেশের ১৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এতে অংশ নেন আসাম-মেঘালয় অঞ্চল থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের কয়েকজনের স্বজনও।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এদের কেউ ছিলেন স্কুল ছাত্র, কেউ বা কলেজ ছাত্র, কেউ কৃষক। যে যে পেশাই ছিলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের ৭ই মার্চের সাড়া জাগানো ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখিয়েছিলেন, প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন শিংলয়ে। প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতে সবাই ছিলেন টগবগে যুবক। এখন বার্ধক্যে পৌঁছেছেন। কিন্তু তাদের স্মৃতি থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি একমুহূর্তর জন্যও হারিয়ে যায়নি।
হোটেল পাইনউডে বাংলাদেশ ও ভারতের বীর মুক্তিযোদ্ধারা এই মিলনমেলায় মুক্তিযুদ্ধকালের লড়াই-সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট, আবেগ-অনুভূতির স্মৃতিচারণ করতে করতে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।
স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী (বীর বিক্রম)। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ভারতের মানুষকেও ছুঁয়েছিল। আসাম-মেঘালয়সহ সারা ভারতের মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভূমিকা রেখেছেন। এমনকি ভারতের ১১ শতাধিক সেনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন।
শমসের মুবিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় শিলংয়ে ৫২ জন শহীদকে সমাহিত করা হয়েছিল। শিলংয়ে এই শহীদদের সমাধিস্থলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরাসহ আরও যেখানে শহীদরা সমাহিত হয়েছেন, সেখানেও যেন এমন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তের অক্ষরে লেখা। এই ইতিহাসগুলো পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও পৌঁছে দিতে হবে, যেন এই সম্পর্কের শেকড় সবাই জানে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল শিলংয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশ স্বাধীন করার লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার স্মৃতিচারণ করে বলেন, এই শিলংয়ে এসেছিলাম ১৯৭১ সালের মে মাসে, টগবগে যুবক তখন এসেছিলাম যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। আর এখন এলাম বন্ধু ভারত সরকারের আমন্ত্রণে।
শিলংয়ের মানুষের সেই সময়ের সহযোগিতা আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কখনো ভুলতে পারব না। এত বছর পর সেই স্মৃতির জায়গায় আসতে পেরে ভীষণ গর্ববোধ হচ্ছে, ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব এলাহী (বীর প্রতীক) তুরা জেলার মারগারচর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, আসাম-মেঘালয়সহ ভারতের এসব এলাকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীর্থভূমি। এই তীর্থভূমি থেকে এখানকার মানুষের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তারপর দেশ স্বাধীন করার লড়াইয়ে নেমেছেন।
তীর্থভূমিতে এসে সেই সময়ের স্মৃতিচারণের সুযোগ দেওয়াটাকে সম্মানের উল্লেখ করে তিনি এই আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি ধন্যবাদ জানান।
বীর মুক্তিযোদ্ধা জামাল খাঁ মা-বাবার বাধা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, যেই আবেগ নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম, দেশ গড়তে সেই আবেগ ধারণ করতে হবে তরুণ প্রজন্মকেও।
অনুষ্ঠানে আরও স্মৃতিচারণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম, এম ফরিদুজ্জামান খান, মো. হারুন উর রশীদ, নাজমুল হাসান পাখি, গৌরাঙ্গ চন্দ্র দাস, হাজী আবদুল জলিল, শফিকুল বাহার মজুমদার, আলহাজ শরীফ উদ্দীন, মো. শাহজাহান, আবুল বাশার, আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি (বীর প্রতীক)।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনস্বীকার্য ভূমিকার জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন শিলংয়ের তিন ভাই-বোন আহমেদ হোসাইন, আফজাল হোসাইন ও আশরাফী বেগম। এদের মধ্যে দুই ভাইও ছিলেন অনুষ্ঠানে। এ ছাড়া ছিলেন আরেক পুরস্কারপ্রাপ্ত বীরসেনানি অঞ্জলি লাহিড়ীর ভাগ্নে সুরজিৎ ও কয়েকজন ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধার স্বজন।
আটাশি বছর বয়সী আহমেদ হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫২ শহীদের মরদেহ আসে শিলংয়ে। তাদের শিলং মুসলিম কবরস্থানে দাফন করা হয়। এই ইতিহাস অনেকেরই অজানা।
একটি ঘটনা তাকে অনেক বেশি নাড়া দিয়েছে উল্লেখ করে আহমেদ হোসেন বলেন, একদিন একটি লাশ এলো, বস্তা খুলে দেখি ১২-১৩ বছরের কিশোর, তার বুকে গুলি, এই ঘটনা আমাকে বেশ আলোড়িত করে। এমন বাচ্চাদেরও হত্যা করতে পারল হানাদার বাহিনী? এই ঘটনাই আমাকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে আসে।
তিনি বলেন, আমার ধারণা ছিল মুক্তিযুদ্ধে নিশ্চয়ই বড় কেউ অংশগ্রহণ করবে, বাচ্চারা সেখানে আক্রমণের শিকার হবে সেটা আমার ধারণা ছিল না। সেদিন ১২ বছরের যুবকের মরদেহ দেখে আমি আপ্লুত হয়ে যাই। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখিনি তখন অনেক ছোট ছিলাম। কিন্তু যখন বাংলাদেশের মানুষটা আক্রান্ত হল তখন আর বসে থাকিনি। পেশায় একজন ফটোগ্রাফার আহমেদ হোসেনের সংগ্রহে কয়েক হাজার ছবি রয়েছে।
এ সময় কর্নেল সাজ্জাদ জহির, ক্যাপ্টেন আনোয়ারসহ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তার স্মৃতি বর্ণনা করেন আহমেদ হোসাইন।
এসএম/এনএইচবি/এমএমএ/