কলেজ অধ্যক্ষকে এমপির নির্যাতন! তদন্তে জাবি প্রশাসন
রাজশাহীতে এবার এমপির টর্চার সেলে কলেজ অধ্যক্ষকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। দলীয় নেতা ও অপর আরেকটি কলেকের অধ্যক্ষকে দিয়ে ভুক্তভোগী অধ্যক্ষকে ডেকে এনে নিজ মালিকাধীন 'থিম ওমর প্লাজা'র এমপি চেম্বারে ওই শিক্ষককে বেধড়ক কয়েক দফা পেটার অভিযোগ উঠেছে, রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
এ ঘটনায় বুধবার (১৩ জুলাই) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) এর রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেনকে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক মো. আতাউর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এতথ্য নিশ্চিত করা হয়। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে সমালোচিত এমপি ফারুক চৌধুরির এহেন কর্মকাণ্ডে আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে অন্য কলেজ অধ্যক্ষদের মাঝেও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিটিং এর নামে কলেজের আরও অন্তত আট জন অধ্যক্ষ-উপাধক্ষের সামনে গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে রেধড়ক পিটিয়ে আহত করেছেন এমপি। ঘটনারপর গুরুতর আহত ওই অধ্যক্ষ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে রাজশাহী নগরীর রায়পাড়ায় তার নিজ বাসায় চলে যান। ভয়, আতঙ্ক, লজ্জা আর ক্ষোভে এখনো কোথাও অভিযোগ করেন নি তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ জুলাই রাতে নগরীর নিউমার্কেট সংলগ্ন থিম ওমর প্লাজায় এমপি চেম্বারে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় গোদাগাড়ী উপজেলার বিভিন্ন কলেজের আরও সাতজন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ উপস্থিত ছিলেন। ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে সবার সামনে অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে বেপরোয়া কিল-ঘুষি দিয়ে আহত করা হয়। পরে আবারও নিজ চেম্বারে থাকা টর্চার উপকরণ (হটিস্টিক) দিয়ে নির্যাতন করা হয়। কিন্তু এমপির হুংকারে কেউ তাকে বাঁধা দেয়ার সাহস দেখান নি।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গোদাগাড়ীর মাটিকাটা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আব্দুল আউয়াল রাজু ফোন করে বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষদের ৭ জুলাই রাত ৯টায় থিম ওমর প্লাজায় এমপির চেম্বারে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেন। অধ্যক্ষ রাজু এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর অনুসারী। তার ফোন পেয়ে রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাসহ আটজন অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ এমপি ফারুকের চেম্বারে হাজির হন। এমপি ফারুক প্রথমেই অধ্যক্ষ সেলিম রেজার কাছে জানতে চান তার কলেজের কতিপয় শিক্ষক একজন অধ্যক্ষ ও দলীয় নেতার স্ত্রীকে নিয়ে অশ্লীল কথাবার্তা বলেছেন। প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি কি ব্যবস্থা নিয়েছেন।
জবাবে অধ্যক্ষ সেলিম বলেন, যদি আপনার কাছে প্রমাণ থাকে আমি তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। আমি এই বিষয়ে কিছুই জানি না। এরপরপরই এমপি তার ফোনের রেকর্ড অন করে বিষয়টি অধ্যক্ষ সেলিমকে শুনতে বলেন। এরইমধ্যে এমপি ফারুক চৌধুরি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সেলিম রেজাকে জাপটে ধরে বেধড়ক মারপিট করেন। এক পর্যায়ে অধ্যক্ষ সেলিম প্রায় অচেতন হয়ে পড়লে পুনরাই চেম্বারে আগে থেকে রাখা টর্চার উপকরণ (হকি স্টিক) দিয়ে নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে অধ্যক্ষদের একজন সেলিমকে এমপির কব্জা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চেম্বার থেকে বের করে আনেন।
পরে আহত সেলিম রেজাকে অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সাঈদ আহমেদের চেম্বারে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর কয়েকজন স্বজন ও সহকর্মীর সহায়তায় তিনি বাসায় ফেরেন। ঘটনার পর অধ্যক্ষ সেলিম রেজা ভয়-লজ্জা-আতঙ্কে বাসা থেকে আর বের হননি। সোমবার (১১ জুলাই) রাতে রায়পাড়ায় বাসায় গিয়ে অধ্যক্ষ সেলিম রেজার সঙ্গে কথা বলেন যুগান্তরের একজন সাংবাদিক। সাংবাদিক শুনে প্রথমে কথা বলতে অস্বীকার করেন। তবে পরে আগাগোড়া ঘটনার বিবরণ দেন তিনি।
ওই সাংবাদিককে অধ্যক্ষ সেলিম রেজা জানান, ৭ জুলাই রাতের ঘটনার পর তিনি বাড়িতেই থাকছেন। তবে সোমবার বিকালে এমপির ঘনিষ্ঠ গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা যুবলীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক বেলাল উদ্দিন সোহেল তার বাসায় আসেন। তিনি হোয়াটসঅ্যাপে এমপির সঙ্গে কথা বলেন। পরে তাকে ফোন ধরিয়ে দেন। এ সময় এমপি ফারুক চৌধুরি ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সময় করে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেন।
অধ্যক্ষ সেলিম আরও বলেন, যেহেতু তিনি (এমপি) দুঃখ প্রকাশ করেছেন তাই আমিও আর কিছু বলছি না। ঘটনাস্থলে উপস্থিত গোদাগাড়ীর একটি কলেজের অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করে বলেন, কিভাবে কি বলবো। ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। একজন সংসদ সদস্য এমন জঘণ্য কাজ করতে পারেন, আমরা ভাবতেই পারছি না। একজন কলেজ অধ্যক্ষকে গরু পেটা করে পেটানো- কী সাংঘাতিক ঘটনা। আমরা বিচার দেব কার কাছে। কে করবে বিচার!
এ ব্যাপারে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, অধ্যক্ষ সেলিম রেজার সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছি। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে এখনো কালশিরা পড়ে আছে। ওই শিক্ষকও আতঙ্ক গ্রস্থ। এমপি ফারুক চৌধুরী শুধু সেলিম রেজাকেই নয়, এমন এহেন কর্মকাণ্ড তার পুরোনো অভ্যাস।
এর আগেও এমন অনেকেই মারধরের শিকার হচ্ছে। ভয়-আতঙ্কে কথা বলার সাহস পায় না। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণও এটি। ভুক্তভোগী শিক্ষক প্রতিবাদ করার সাহসটুকু পাচ্ছে না। ফারুক চৌধুরীর মতো বেপরোয়া এমপিদের কারণেই সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এর প্রতিকার হওয়া উচিত বলে করেন তিনি। এদিকে, অভিযোগ অস্বীকার করে সংসদ-সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী সাংবাদিককে বলেন, ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে আমার চেম্বারে তারা অনেকেই এসেছিল। নিজেরা মারামারি শুরু করলে আমি গিয়ে তাদেরকে থামাই।
এএজেড