ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৬
বিষাদ বসুধা
আরেফিনের মৃত্যুর পর মোহিনী সাতদিন বাসার বাইরে যাননি। কারো সঙ্গে কথা বলেননি। অফিসের খোঁজখবর নেননি। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। কেউ যাতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে সেজন্য নিজের মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছেন। বাসার অপারেটরকেও বলে রেখেছেন, বাইরের কোনো ফোন তাকে দেওয়া যাবে না। তিনি যে বাসায় আছেন সে কথাও বলা যাবে না। এটা তার একটা অদ্ভুত স্বভাব। তিনি যদি নিজে লুকিয়ে রাখেন তাহলে কেউ তাকে আর খুঁজে পায় না।
মোহিনী তার মা বাবাকে বলে রেখেছেন, তাকে যেন তারা ডাকাডাকি না করেন। আসলে নিজেই নিজেকে ঘরে বন্দি করেছেন। বন্দি করেছেন নিজের মনকেও। এই সময়টা মোহিনী নিজের মতো করে কাটাবেন। ইচ্ছা হলে কারো সঙ্গে কথা বলবেন। ইচ্ছা না হলে বলবেন না। কেউ তাকে খেতে ডাকবে না। গোসলের জন্য বলবে না। অফিসে যাওয়ার জন্য তাড়া করবে না। ঘুমানোর কথা কিংবা ঘুম থেকে ওঠার কথাও বলবে না। এই কাজগুলো মোহিনী নিজের ইচ্ছা মতো করবেন। এ সময় কখনো তিনি টানা আঠারো ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন। আবার আঠারো ঘণ্টা জেগে থেকেছেন। গান শুনেছেন। ছবি দেখেছেন। বই পড়েছেন। একেবারে নিজের সঙ্গে কাটানো যাকে বলে! তিনি তাই করেছেন। পুরো সময়টুকু তিনি নিজেকে দিয়েছেন। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেছেন। গল্প করেছেন। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন। বোঝাপড়া তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। কি করবেন তিনি? নতুন করে আবার সংসার করবেন? কি হবে? যদি আবার আঘাত পেতে হয়! যদি আবার এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু!
মোহিনী অতীত নিয়ে ভাবেন। ভাবে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর কথা। আরেফিনের সঙ্গে তার ভালোবাসার দিনগুলোর কথা। একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর কথা। সেই দিনগুলো কত আনন্দের ছিল। কত মধুর ছিল। সেদিন কত স্বপ্ন ছিল। কত আকাঙ্ক্ষা ছিল। শুরুটা বেশ ভালোভাবেই হয়েছিল। যদিও মা বাবা মেনে নিতে পারছিলেন না। কারণ, আরেফিন খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। পরিচয় দেওয়ার মতো কিছু নেই। আরেফিন তাই ওর মা-বাবার কথা মুখেও আনেনি। তারপরও মা বাবা অসন্তুষ্ট ছিলেন। যে কারণে তার জন্য ঘর ছাড়ার মতো অন্যত্র বাসা নিয়ে থেকেছি। ওর জন্য মা বাবাকে তো বটেই, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সব খুইয়েছিলাম। তারপরও সেটাই মেনে নিয়েছিলাম। আমি আসলেই আরেফিনকে নিয়ে সুখী হতে চেয়েছি। মনে মনে ভেবেছি, কেউ নেই, কিছু নেই! আরেফিন তো আছে! মেধাবী ছেলে। সুশিক্ষিত। চৌকস। সে অনেক বড় হবে। আমার অনুপ্রেরণায় সে অনেক বড় হবে। অনেক দূর এগিয়ে যাবে। জীবনে বড় হতে হলে কারো না কারো অনুপ্রেরণা তো লাগে! তা ছাড়া সে আমার প্রথম ভালোবাসা। তার সঙ্গে আমি বেইমানি করতে পারব না। করিওনি। অথচ আরেফিন বিশ্বাসই করত না যে; আমি ওকে বিয়ে করব। ও বলত, এটা হতে পারে না। কেউ মেনে নেবে না। সবার বাধা উপেক্ষা করেই তো ওকে আমি বিয়ে করেছিলাম! কারণ ওকে আমি কথা দিয়েছিলাম। সেই কথা আমি রেখেছি। কে জানতো আরেফিন এভাবে পাল্টে যাবে! মানুষের মন। চেনা বড়ই শক্ত। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। সাপের মতো খোলস পাল্টায়। সেজন্যই হয়ত মানুষে মানুষে এতো বিভেদ।
মোহিনী আরও ভাবেন, তারপরও তো আরেফিনকে নিয়েই ছিলাম। কত যন্ত্রণা দিয়েছে! রাতের পর রাত ঘুমাতে পারিনি। ওর অনেক যাতনা সহ্য করেছি। অনেক ছোটলোকিপনা মেনে নিয়েছি। ওর জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করেছি! অথচ শেষ পর্যন্ত আরেফিন আমার সঙ্গে অভিমান করল। অনেক বড় অভিমান। আমি বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলে হয়ত ওকে যেতে দিতাম না। ও আমাকে না বলে চীনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের বাড়িতে চলে যাব। তাই করেছি। আমি কি পেয়েছি সে হিসাব কষতে গিয়ে ভুল আমিও করেছি। আর সে ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে আজ। সবই যেন নিঃশেষ হয়ে গেল। আবার নতুন করে সংসার জীবনে পা দেওয়ার কোনো মানে নেই। কী আছে! বিধাতা তো আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। সংসার জীবন হয়ত আমার জন্য নয়। সবাইকে সবকিছুতেই শতভাগ সফল হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই! অন্যদিক থেকে তো আমি সফল! আমি যদি এ রকম একটা সমৃদ্ধশালী পরিবারে না জন্মাতাম! যদি দরিদ্র পরিবারে জন্মাতাম! তাহলে তো অর্থ কষ্ট, খাবার কষ্টে জীবন আরও অতীষ্ট হয়ে উঠত। আমি বিশাল একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। বাবার প্রতিষ্ঠানগুলোও আমারই থাকবে। হয়ত এগুলো নিয়েই আমাকে থাকতে হবে। সামনের দিকগুলোতে মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়াই হয়ত উত্তম কাজ হবে।
মোহিনীর একটি গানের কথা আজ বড় মনে পড়ছে। তিনি মোবাইল হাতে নিয়ে ইউটিউবে সার্চ দেন। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বড় অভিমান করে চলে গেছ আর বলে গেছ ফিরে আসবে না। আমি জানি হার মানবে তবু দূরে থাকা ভালোবাসবে না।’..
গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন মোহিনী। ঘুমের ঘোরে তিনি আরেফিনকে দেখেন। আরেফিন তার কাছে আসেন। তাকে আদর করেন। আদরে আদরে ওকে ভরিয়ে তোলেন। তার কপালে চোখে ঠোঁটে গলায় বুকে তারপর শরীরের সর্বত্র আরেফিনের ঠোঁটের পরশ বুলিয়ে মোহিনীকে পাগল করে তোলেন। গভীর ভালোবাসার আবেশে ডুবে যান মোহিনী। দারুণ এক ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে মোহিনীর ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে দেখেন সবই দুঃস্বপ্ন। যা হওয়ার নয়। কোনো দিন যা হবে না। হতে পারে না। কিন্তু তিনি এ রকম একটা স্বপ্ন দেখলেন!
আবার মোহিনীর মনটা ভারী হয়ে ওঠে। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকে। ঘুরেফিরে আরেফিনের কথা মনে পড়ে। অতীতের নানা স্মৃতি মনের আয়নায় ভেসে উঠে।
মোহিনী অফিসে যাবেন। মোহিনী আর ঘরে বসে থাকবেন না। অতীতকে আকড়ে ধরে বসে থাকবেন না। তিনি নিজেকে ভাঙবেন। নিজেকে আবার নতুন করে গড়ে তুলবেন। নতুনভাবে তিনি বেঁচে থাকবেন। মানুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেবেন। নিজের যা সম্পদ আছে তা প্রয়োজনের বেশি একটুও তিনি রাখবেন না। এখন মানুষ বড় অসহায়। এই বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। বাড়াতে হবে সাহায্যের হাত। ঘরে বসে আর অলস সময় কাটাবেন না। এ পর্যন্ত যা করেছেন সেটা তা খুবই সামান্য। আরও অনেক কিছু করার আছে তার। অনেকভাবে তিনি মানুষকে সাহায্য করতে পারেন।
মোহিনী ভাবেন, এদেশের মানুষ বড় অসহায়। এই দেশে কথায় কথায় মানুষের চলে চাকরি যায়। ঠুকনো অজুহাতে চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়। করোনাকালে এ পর্যন্ত অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেকেই বেতনবঞ্চিত। এ অবস্থায় ঢাকা শহরে একটা পরিবার চলে কি করে! তা ছাড়া জিনিসপত্রের যা দাম! বাড়ি ভাড়া, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ! চিন্তাই করা যায় না। করোনার মধ্যেও স্কুলগুলো বেতন নিচ্ছে। বাড়িওয়ালারা বাড়িভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এসব অমানবিক খবর পত্রিকায় দেখে মন খারাপ হয় মোহিনীর। তিনি মনে মনে বলেন, মানুষ এত নিষ্ঠুর কেন? মানুষ তো মানুষের জন্যই। অথচ সেই মানুষ কত স্বার্থপর! কত আত্মকেন্দ্রিক! কত রূপ সেই মানুষের! নিজের স্বার্থে মানুষ সবকিছু করতে পারে!
মোহিনীর কাছে এই মানুষগুলোকে অচেনা লাগে। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াবেন। কাউকে না কাউকে তো হাল ধরতেই হয়! সেই হালটা তিনি ধরবেন। যত কষ্টই হোক, তিনি এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হবেন না।
আবার মোহিনীর মনে প্রশ্ন জাগে; একা কী করবেন তিনি? তার পক্ষে কতটুকুই বা সম্ভব! তারপরও মোহিনীর পক্ষে যা করা সম্ভব তা তিনি করবেন বলে মনস্থির করেছেন। তার দেখাদেখি আরও অনেকেই হয়ত এগিয়ে আসবেন। অথবা কেউ যদি নাও আসে লজ্জা তো পাবে!
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
বিষাদ বসুধা: পর্ব-২৫
আরএ/