ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৯
নেই দেশের নাগরিক
‘শান্ত হোন ভাই। আল্লাহকে দোষ দিয়ে আর কী হবে। আল্লাহ কোনো দোষ নেন না। তিনি মরণের কোনো না কোনো কারণ বেঁধেই দিয়েছেন। সে কারণ খণ্ডাবে, এই দুনিয়ায় এমন কে আছে? ‘মালেকুল মওত’ তো আমাদের সবার কাছে কাছেই ঘুরঘুর করছেন। কেউ আগে কেউ পরে। দেশহীন মানুষের আর বেঁচে থেকে কী লাভ! নৌকা তো আর দেশ হতে পারে না, জীবনও হতে পারে না। আপনি কী ভাবছেন, এই নৌকাতে কি আর কোনো জীবন্ত মানুষ বেঁচে আছে? আমরা কি আর বেঁচেবর্তে থাকা মানুষ? নাহ, আমরা হলেম, শকুনের ছৌ’এর নজরে থাকা কয়েক ঘণ্টার শরীর। রুহু তো দেহের ভেতরে বাঁধন কাটতে শুরু করে দিয়েইছে! শুধু ফুড়ুৎ করে উড়তে বাকি!’
ইয়াসিন মাস্টারেরও চোখ ছলছল করে উঠল। আরিফা অনর্গল মাথায় জল ঢেলে যাচ্ছে। কাঁসার ঘটিটা নদীতে চুবিয়ে জল তুলছে আর মরণাপন্ন শ্বশুরটার মাথায় ঢালছে। জাফর আলির উসকো খুসকো ফিনফিনে ফেঁসোর মতো বাবরি চুলের মাথাটা চুইয়ে সে জল নৌকার খোলে গলগল করে পড়ছে। ভেজা নৌকা আরও ভিজে উঠছে। তার কালো রঙ আরও কৃষ্ণকায়া হয়ে উঠছে। এত হৈচৈ চেঁচামেচিতে সাকিবও কাঁথা মুড়ে উঠে বসেছে। সে ফ্যালফ্যাল করে দেখছে, মানুষ আর যমের টানাটানি।
‘জানেন, আমার আব্বার একটা শেষ ইচ্ছে আছে।’ বলল মতি।
‘শেষ ইচ্ছে! কী সেটা?’ জানতে চাইলেন ইয়াসিন মাস্টার।
‘আমার আব্বার ইচ্ছে তিনি মারা গেলে, তাকে যেন মাটিতে কবর দেওয়া হয়। তিনি নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন, তিনি যদি কবরের মাটি পান, তাহলে আমরা আমাদের দেশ ফিরে পাব।’
‘কবরের মাটি! সে কি আর এ জন্মে মিলবে? মাথা গোঁজারই ঠাঁই নেই তো কবরের মাটি!’ খেয়ালি হয়ে বললেন ইয়াসিন মাস্টার। আসমানের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। ভাবলেন, ডানা থাকলে আসমান-দেশ’এ উড়ে যেতাম। আসমানে কোনো তারকাঁটা নেই। আসমানেও তো আল্লার দেশ আছে। সেখানে থাকেন জিন-ফেরেস্তারা। কই, সেখানে তো এরকম কাটাকাটি, হানাহানি হয় না? আল্লাহ সাত আসমান বানিয়েছেন! সে আসমান-দেশ থেকে তো কেউ ভিটে ছাড়া হয় না? দেশ, বিদ্বেষ যত কিছু সবই এই মাটিতে। এই মানুষের গোহালে।
‘এই দেখো দেখো, চোখ খুলছেন!’ আরিফার মুখটা আচানক খুশিতে ভরে উঠল। তার ঠোঁট চিরে বেরোল চিলতে আনন্দ। আরিফার ডাক শুনে, সবাই একেবারে হুমড়ি পড়ল। সবার চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে জাফর আলি ধীরে ধীরে চোখের পাতা খুললেন। ‘আল্লাহ হু আকবার’ বলে মতি আনন্দে পশ্চিমদিক মুখ করে ঠকাঠক দুবার সিজদা দিল। নুহুও বড়ভাইয়ের দেখাদেখি মাথা ঝোকালো আসমানের খোদার কাছে।
‘জীবন মরণের মালিক আল্লাহ। এক দানা পরিমাণ রিজিক থাকা পর্যন্ত কখনই মৃত্যু হবে না। চাচার এখনো শেষ সময় আসেনি।’ ইয়াসিন মাস্টার আল্লাহর নাম নিলেন। ইয়াসিন মাস্টারের কথা শুনে জাফর আলি মিহি করে ঠোঁট নড়ালেন, ‘কে? আ তি ফ এসছিস?’
জানালার ফাঁক গলে হালফিলের একটা হিন্দি গানের সুর মিহি করে ভেসে আসছে। বোঝাই যাচ্ছে, ঝ্যানঝেনিয়ে একটা রেডিও বাজছে। এই ঘোর জঙ্গলে রেডিও ছাড়া আর কী বা বাজবে? সব তারই তো চোহদ্দির বাইরে। শুধু এই বেতারেই ভরসা। দুম করে গানটা থেমে গিয়ে, বিবিসির খবর ভেসে উঠল, ‘নাফ নদীর দুই পাড়ে হাজার হাজার ঘরছাড়া রোহিঙ্গাদের ভিড় উপচে পড়ছে। রাখাইনের মংডুর দংখালীর এক গ্রামে বার্মিজ জান্তার সৈন্যরা অতর্কিতে হামলা চালিয়ে শতাধিক নিরীহ রোহিঙ্গাকে গুলি করে খুন করেছে। রাষ্ট্রসংঘ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে। এক বিবৃতিতে রাষ্ট্রসংঘের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, মায়ানমার সরকারকে অবিলম্বে এই পাশবিক কাজ বন্ধ করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াকে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া প্রসঙ্গে রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব জানিয়েছেন, কোনো ব্যক্তি বা জাতি বা ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ যদি কোনো দেশে বসবাসরত অবস্থায় অত্যাচারিত হয়ে নিরাপত্তার অভাবে বা ধর্মীয় কারণে ভীত হয়ে অন্য কোনো দেশে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন তারা সেই দেশে বৈধ উদ্বাস্তুর মর্যাদা পাবেন এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী হবেন’।
কাঠের সিঁড়ি দিয়ে খটখট করে উঠতে উঠতে আতিফ কাঁচা খিস্তি দিল, ‘শালা শুয়োরের বাচ্চা, থাম নুনু কেটে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি।’ হড়াম করে কপাটটা খুলে গেল! ভেতরের লোকটা ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল, ‘আরে তুই! এমনি করে কেউ দরজা খোলে? আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম!’
‘ভয়! এই লাইনে এসে আবার ভয়! ওসব ভয় টয় পুষে রাখলে জেহাদ করবি কী করে? তুই তো বেটা এই ‘মিশন’টা সফল করতে পারবি ন্যা! তোকে দেখে তো আমার সন্দেহ হচ্ছে।’
‘আরে না রে না। এ ‘অ্যাটাক’টা আমার নেতৃত্বেই হবে। তুই একদম চিন্তা করিস না। খোদার কশম, ওই চৌকি আমি উড়াবোই।’
‘সাবাশ, জোশ তো ভালই আছে দেখছি। তা এত তেজ কোথা থেকে এল?’
‘আল্লাহর কথা স্মরণ করে। কবরের আযাব, হাশরের ময়দানের বিচার, দোযক-বেহেশতের কথা মনে করে। এ জীবনে আর কী আছে? সবই তো পরকালের জন্যে। আল্লাহর রাস্তায় আমি নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করে যেতে চাই। আল্লাহর পথে চলা মানুষজনের জন্যে মাথা গোঁজার ঠাই করে যেতে চাই। আর আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন।’
‘খবিশদের নিঃশেষ না করা পর্যন্ত আমাদের দোম নেই।’
‘দোম, শান্তি, আরাম, ঘুম ওসব এখন আমাদের কাছে হারাম। আমাদের এক এবং একমাত্র ফরজ কাজ হল, রাখাইনকে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র বানানো। শরিয়তের শাসন কায়েম করা।’
‘দেখ, নবী, তুই যেমন তোর পরিবারকে হারিয়েছিস, ঠিক তেমনই আমার পরিবারও আজ কোথায়— আমি জানি না। তারা আদৌ বেঁচে আছে না মরে গেছে, সে আল্লাহই জানেন। আমাদের মতো লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গারা আজ দেশ ছাড়া, আত্মীয়স্বজন ছাড়া। তারা কেউ খড়কুটোর মতো করে বেঁচে আছে, কেউ লজ্জা সম্মান হারিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। তাদের জন্যে আমাদের জেহাদ। তাদের মুক্তির জন্যে আমাদের জেহাদ। আল্লাহ সহায় থাকলে, বিধর্মী জান্তাসেনাদের নিঃশেষ করবই, ইনশাল্লাহ।’ রাগে ক্ষোভে গনগন করে জ্বলে উঠল আতিফ।
‘যাক, এবার কাজের কথায় আসা যাক। ওদিককার খবর বল।’ গলার স্বর নিচু করল নবী।
‘এই মাত্র বার্তা পেলাম, আজ রাতেই এক আই এস আই চর এখানে আসছেন। বাকি প্ল্যানিং উনিই বলবেন।’
‘আমাদের কি পরশু নেপাল যেতে হবে?’
‘এক্ষনি কিছু বলা যাচ্ছে না। গাফফার ভাই না ফেরা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। আমাদের স্বপ্ন সফল করতে গেলে যেমন আই এস আই এর সাহায্য লাগবে ঠিক তেমনি আই এস’রও হেল্প প্রয়োজন। দেখ, শুধু মনের বল থাকলেই তো হবে না। অস্ত্র যেমন লাগবে ঠিক তেমনি টাকাও লাগবে। আমাদের হাজার হাজার রোহিঙ্গা ছেলেদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে, বার্মা বাহিনীর সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। তাদের দেহ মন থেকে মৃত্যুভয় হারাম করে দিতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে, একজন রোহিঙ্গা মানে একটা মারণ অস্ত্র।’
‘আমি ‘বালুখালি চৌকি’র একটা কমপ্লিট ম্যাপ বানিয়ে নিয়েছি। কতজন সেনা থাকে, কখন কীভাবে পাহারায় থাকে, কটা গেট, পাঁচিলের উচ্চতা কত, নদী থেকে কত দূরে অবস্থিত সব খুটিনাটি সংগ্রহ করেছি।’
‘মাসআল্লাহ!’ ধেই করে উঠল আতিফ। ‘এত নেকির কাজ আর এজন্মে পাওয়া যাবে না। ‘কুখ্যাত বালুখালি চৌকি’ উড়িয়ে দিতে পারলে, শয়তানের একটা আখড়া ওড়ানো হবে। জাহলিয়েতের জাহান্নাম। আর বার্মা সেনাবাহিনীও বুঝবে ঠাপের নাম বাবাজী।’ টগবগ করে উঠল আতিফ। তারপর দুম করে জিজ্ঞেস করল, ‘সাদ্দামের খবর কী?’
‘ও ফোন করেছিল, বলল, কুতুপালংয়ে কাজ ভালো এগোচ্ছে। অনেককেই রাজি করানো গেছে। আপাতত বিশজনের একটা টিম পাঠাচ্ছে।’
‘বাহ!, ভেরি গুড। ওরা এলেই কাজ শুরু করে দিতে হবে। ট্রেনিং-ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিবি। একদম দেরি করা যাবে না।’
‘আমার তো টার্গেট আছে, গোটা দশেককে ‘স্যুইসাইড অ্যাটাকার’ বানাব। মায়ানমার সেনা এটাও জেনে রাখুক, একজন রোহিঙ্গা মানে একটা ‘আত্মঘাতী বোমা’। একটা মিসাইল। চোখ দিয়েই আমরা চোখ তুলব।’
‘তোকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই, নবী! তুই সেই হ্যালাফেলা ভীতুর ডিম নবী আজ আর জে এফ’এর হাইর্যাংকের কমান্ডার!’
‘আর তুই? তুই তো পড়াশোনার বাইরে কিছুই বুঝতিস না? যাকে বলে বইপোকা। আর সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার, তুই তো ব্যাটা পাক্কা অহিংসবাদী ছিলি। সুর করে মহাত্মা গান্ধীর বুলি আউড়াতিস, চোখের বদলে চোখ এই যদি নীতি হয় তাহলে একদিন এই পৃথিবীই ধ্বংস হয়ে যাবে! বুদ্ধের নাতি! ন্যাকামু।’
কী আর করবে? মানুষ যে ঠেকে শেখে। আতিফ মেধাবী স্টুডেন্ট। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল। আচমকা দাঙ্গা লেগে গেল। তখন সে পড়াশোনার কাজে রেঙ্গুনে। বাড়িতে ফোন করলে, বাড়ির লোক জানালো, তুই গ্রামে আসিস নে, গ্রামের অবস্থা খুউব খারাপ। আমরা কোনোরকমে জান হাতে নিয়ে বসে আছি। তুই পারলে অন্য কোনো দেশে পালিয়ে যা। মায়ের কণ্ঠে আকুতি ঝরে পড়েছিল। অন্য কোন দেশে! আতিফের মনে খটকা বাঁধল, নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে কেন পালাব? এটা কি আমার দেশ নয়? যে দেশের জলহাওয়া খেয়ে বড় হলাম, সে দেশ আমার পর! আমার দেশ আমার কাছেই জাহান্নাম হয়ে উঠছে! পরিস্থিতি আঁচ করে রেঙ্গুনেই আত্মগোপন করল আতিফ। সে যেদিন হোস্টেল ছাড়ল, তার পরের দিনই একদল বার্মা সেনা এসে হোস্টেল থেকে সমস্ত রোহিঙ্গা ছাত্রদের তুলে নিয়ে গেল। গোপন জায়গা থেকে সে শুনতে পেল, বার্মিজ জান্তা একের পর এক রোহিঙ্গা গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দিচ্ছে। নৃশংসভাবে হত্যা করছে, হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে। মেয়ের সামনে মা’কে, মা’এর সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করছে। রেহাই পাচ্ছেনা কোলের শিশুও। তাদেরকে তলোয়ার দিয়ে কেটে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। গর্ভবতী মা’র পেট থেকে ভ্রূণ কেটে বের করে পা দিয়ে দলে দিচ্ছে। আরও কয়েকদিন পর বাড়িতে ফোন করে সে যা শুনল, তাতে তার রক্ত শিরা-ধমনি দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইল, শয়তান মায়ানমার সেনা তার মেজভাবী লতিফা আর ভাইপো রফিককে পাশবিকভাবে হত্যা করেছে। নিরীহ সাদামাটা আতিফের মাথা বিগড়ে গেল! তাকে কুরে কুরে খেল কিছু প্রশ্ন, এভাবে কাপুরুষের মতো লুকিয়ে থেকে কী লাভ? ইতিহাস তো বলছে, রোহিঙ্গারা হাজার হাজার বছর ধরে এখানে বাস করছে, তাহলে কোন যুক্তিতে আমরা ভিনদেশি? বেছে বেছে মুসলমান রোহিঙ্গাদেরই হত্যা করা হচ্ছে, তার মানে কি এই নয় যে, তাদের আসল টার্গেট ইসলাম? মানুষ মানুষকে এত নৃশংসভাবে হত্যা করলে, সেইসব পিশাচদের কি যুতসই শিক্ষা পাওয়া উচিৎ নয়? অসহায়, সহায়সম্বলহীন, নিরন্ন মানুষের জন্যে যদি কিছু নাইই করতে পারি, তবে এ জীবনের আর মূল্য কী? জীবনকে শূলীতে চড়িয়ে, জাতিসত্ত্বার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়াটাই এখন ধর্ম। ফরজ কাজ। মন ঘুরে গেল আতিফের। তার শরীরের নিরীহ সাদামাটা রক্ত মাংসে একটু একটু করে জন্ম নিতে লাগল নেকড়ে, গোখরো আর দন্তকওয়ালা কুমির। সে মানুষ থেকে হয়ে উঠতে লাগল তলোয়ার। তার সারা শরীর কামড়ে উঠল, যতক্ষণ না এই কাফের জান্তা সরকারকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছি, ততক্ষণ দোম নেই।
হোস্টেল বন্ধু নবীর সঙ্গে যোগাযোগ করল আতিফ। নবী হোস্টেলে থাকাকালীনই তাকে বেশ কয়েকবার আর জে এফ’এর কথা বলেছে। নবী হোস্টেলে থাকাকালীন অবস্থা থেকেই তলে তলে গোপনে আর জে এফ অর্থাৎ ‘রোহিঙ্গা জেহাদি ফৌজ’ এর হয়ে কাজ করত। আর জে এফ’এর লক্ষ্য হল, স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামিক রাখাইন বানানো। অবশ্য তারা রাখাইন নামটা আর রাখবে না, তাদের প্রস্তাবিত নাম হল, স্বাধীন ইসলামিক আরাকান। প্রস্তাবটায় ঘোর আপত্তি ছিল আতিফের। সে অখণ্ড মায়ানমারের পক্ষে। অখণ্ড মায়ানমার তার হৃদয়। মায়ানমার ভাঙা মানে তার হৃদয় ভাঙা। এ নিয়ে জোর তর্কবিতর্ক হয়েছে নবীর সঙ্গে। বাকবিতণ্ডায় রাত কাবার হয়ে গেছে। আতিফ এতটুকুও মচকায়নি। সে বুক ফুলিয়ে বলত, আমি প্রথমে বার্মিজ তারপরে মুসলমান। নবী তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, বার্মিজ সেনা তৈরিই হয়েছে রাখাইন থেকে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে। বার্মিজ জান্তা হল বার্মিজ জাতীয়তাবাদ এবং থেরাভেদা বৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী। আর এদের উদ্দেশ্যই হলো রোহিঙ্গা মুসলমান হত্যা। আতিফ পাল্টা জাতীর পিতা আং সানের কথা কোট করেছে, ‘বার্মা তো সব জাতির একটি ইউনিয়ন, যেখানে বর্মণরা এক কায়েতের অধিকারী হলে অন্যরাও এক কায়েতের অধিকারী’। সুতরাং সংবিধানে তো আমাদের রক্ষাকবজ রয়েছেই। তুই স্মরণ কর, শাও সোয়ে আইকএর কথা, যিনি স্বাধীন মায়ানমার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। তিনি ৪৭ সালে কী বলেছিলেন— বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা যদি স্থানীয় আদিবাসী না হয়, তাহলে আমিও নই। এ কথা শুনে নবী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল, তাহলে ১৯৮২ সালের নয়া আইনে কেন আমাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হল? আতিফের মুখে কোনো কথা ছিল না। আসলে সে কোনোভাবেই দেশভাগ চাইছিল না। তাকে ঠেস মেরে নবী বলেছিল, তোর তো কোনো দেশই থাকছে না, তো দেশ ভাগের কথা আসছে কোত্থেকে! যখন মেজভাবীদের খুনের কথা শুনল, যখন দেখল, রোহিঙ্গাদের কচু কাটা করে গ্রাম কে গ্রাম আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে বার্মা সেনা, তখন আতিফের বিশ্বাসে জোর আঘাত লাগল, তার এতদিনের ভাবনাচিন্তা কাঁচের মতো ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। সে একটু একটু করে তেতে উঠতে লাগল। ভাবল, মরতে তো হবেই, স্বাধীনতার জন্যেই মরব। রাখাইনকে স্বাধীন করেই ছাড়ব। মরব, মেরেই মরব। এ জীবন আল্লাহর পথে উৎস্বর্গ করব। এখন আমার ফিঁদাইন জেহাদি হতেও আপত্তি নেই।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/