ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৯
বিষাদ বসুধা
আবদুল করিম সবজান্তা শমশের। কী জানেন না তিনি? জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান। কোন দেশের কি সমস্যা, কোনো দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি কেমন তা পটাপট বলে দিতে পারেন তিনি। তিনি পত্রপত্রিকা, বই পড়েন। বিতর্কে তাকে হারাতে পারেন এমন লোকের সংখ্যা ঢাকা শহরে কমই আছে।
অনেকে বলেন, টিভি টকশোতে গেলে তিনি ফাটায়ে দেবেন। কিন্তু তিনি যান না। যারা টকশোতে অংশ নেন তাদের তিনি মূর্খ মনে করেন। তিনি প্রায়শ বলে থাকেন, যার যে বিষয়ে জ্ঞান নেই তিনি সে বিষয়ে কথা বলেন। এ এক আজব দেশ! বাংলাদেশেই বুঝি এটা সম্ভব। আর যিনি বক বক বেশি করতে পারেন তিনিই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হন। যিনি চুপচাপ থাকেন তার কোনো ভাত নেই। এটাই যেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি। যার যোগ্যতা কম কিন্তু চাপার জোর বেশি তার কদরও এদেশে বেশি।
আবদুল করিমের অফিসের লোকেরা তাকে বলেন, জ্ঞানী জৈল সিং। কেউ কেউ তাকে বলেন, তিনি এক জীবন্ত ডিকশনারি। কেউ বলেন, তিনি জ্ঞানের ভান্ডার, জ্ঞানের আঁধার। কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে আবদুল করিমের কাছে ছুটে যান। আবার ঈর্ষা করারও লোকের অভাব নেই। তাদের কেউ কেউ তিরস্কার করে বলেন, এতো জ্ঞান নিয়ে ঘুমান কী করে করিম ভাই!
আবদুল করিম মোহিনীর অফিসে চাকরি করেন। তিনি বৈদেশিক বাণিজ্য দেখভাল করেন। কিন্তু কোনো বিষয়ে সমস্যায় পড়লে মোহিনী সর্বপ্রথম আবদুল করিমকেই ডাকেন। তার পরামর্শ নেন। জ্ঞানগরিমায় এগিয়ে থাকার কারণে মোহিনী তাকে বেশ গুরুত্ব দেন।
সঙ্গত কারণেই আবদুল করিম মোহিনীকে সৎ পরামর্শ দেন। মোহিনী কোনো পরামর্শ চাইলে তিনি হুটহাট পরামর্শ দিয়ে বসবেন তা নয়। তিনি ভেবেচিন্তে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এখন পর্যন্ত তিনি যে পরামর্শগুলো দিয়েছেন তার সবগুলোই ইতিবাচক হয়েছে। ব্যবসার জন্য ভালো হয়েছে। ফলে আবদুল করিমের ব্যাপারে মোহিনীর এক ধরনের মোহ তৈরি হয়েছে। এই মোহটা হচ্ছে একজন ভালো মানুষের কিংবা একজন মুরুব্বির প্রতি যে মোহ।
উহানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর মোহিনী আবদুল করিমকে ডেকে পাঠিয়েছে। তার কাছ থেকে সে ধারণা নেবে। ভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানবে। পরে তিনি জানতে পারলেন, ব্যবসায়িক কাজে আবদুল করিম উহান গিয়েছিলেন। উহান থেকে দেশে ফেরার পর তিনি সেলফ কোয়ারেন্টিনে নিজ বাসায় আছেন। মোহিনী জানেন না, আক্রান্ত দেশ থেকে দেশে ফিরলে তাকে কমপক্ষে চৌদ্দ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। মোহিনী যখন জানতে পারেন আবদুল করিম উহানে গিয়েছিলেন তখন তিনি কৌতূহলী হন। তিনি মনে মনে বলেন, করিম সাহেবের কাছ থেকেই উহান সম্পর্কে জানা যাবে। তিনি অপারেটরকে বললেন করিম সাহেবকে ফোনে ধরিয়ে দিতে। অপারেটর যথারীতি তাকে বাসার ফোনে ধরিয়ে দেন।
মোহিনী হ্যালো বলতেই টেলিফোনের অপাশ থেকে আবদুল করিম বললেন, স্লামুআলাইকুম ম্যাম।
ওলাইকুম আসসালাম। কি অবস্থা বলেন তো?
জি ভালো ম্যাম। আপনি কেমন আছেন?
আমি তো ভালোই আছি। আপনি অফিসে আসছেন না?
আমি কি আসবো ম্যাম?
কেন আসবেন না? কোনো বিশেষ কারণ আছে?
না মানে, আমি তো উহান থেকে এসেছি।
ওহ তাই নাকি?
জি ম্যাম। আপনি অনুমতি দিলে আসব। কিন্তু...
কিন্তু কি বলেন তো!
উহানে নভেল করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) বিপুল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। আমার শরীরে ভাইরাস আছে কি না তা তো বুঝতে পারছি না। ওরা জানাল, আক্রান্ত হলে ধরা পড়তে দুই সপ্তাহ সময় লাগে।
তাই? এসব কিছু তো জানিও না! আচ্ছা ঠিক আছে। দুই সপ্তাহ আপনার আসার দরকার নেই। এরমধ্যে ধরা না পড়লে আপনি অফিসে এসে আমাকে সবকিছু ব্রিফ করবেন।
জি ম্যাম।
মোহিনী ফোন রেখে মনে মনে ভাবেন, আরেফিন ওখানে কেমন আছে? কি করছে? ও তো কোনো কিছুই আমাকে জানাচ্ছে না। কেন জানাচ্ছে না? ওখানে ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে বিশ্বের গণমাধ্যমে খবর হচ্ছে! আর ও চুপচাপ বসে আছে? না, আমার কিছুই ভালো লাগছে না। ভীষণ অস্থির লাগছে।
মোহিনী রুমের মধ্যে পায়চারি করেন। আরেফিনকে নিয়ে নানা চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে। মোহিনী ‘সেলফ মোটিভেটেড’ একজন মানুষ। যে কোনো দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার অসামান্য ক্ষমতা তার। তিনি বুঝতে পারেন কখন কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু আরেফিনকে বিয়ে করা এবং বিবাহপরবর্তী আরেফিনের কর্মকাণ্ডে তিনি এতোই বিরক্ত যে, তার সেলফ মোটিভেশনও কাজ করছে না।
মোহিনী এখন নিজের অফিসে অনেক বেশি সময় দিচ্ছে। একা থাকার কৌশল রপ্ত করছেন। আরেফিন চীনে যাওয়ার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ওর সঙ্গে আর নয়। কিন্তু উহানের ঘটনা তাকে ভাবিয়ে তুলছে। আরেফিনের জন্য তার খুব খারাপ লাগছে। আরেফিনের অনুপস্থিতিতে তিনি নিঃসঙ্গ বোধ করছেন। তার মনে হচ্ছে, এ মুহূর্তে আরেফিনের সঙ্গে কথা বলতে পারলে তার মন ভালো হতো। তার ভালোমন্দ জানতে পারলে তিনি স্বস্তিবোধ করতেন। কিন্তু জানার উপায় কি? আরেফিন কি একবারও যোগাযোগ করবে না?
উহান থেকে দেশে ফেরার ঠিক চৌদ্দ দিন পর অফিসে এলেন আবদুল করিম। মোহিনীর অফিসে তিনিই একমাত্র সিনিয়র মানুষ। বয়স ষাট পার করেছেন। অফিসে এসেই তিনি ফাইলপত্র নিয়ে মোহিনীর দপ্তরে এসেছেন। তার সঙ্গে দেখা করবেন। মোহিনীর পিএস তাকে জানিয়েছে, হাতের কাজ শেষ করেই আপনাকে ডাকবেন। আপনি পাঁচ মিনিট ওয়েটিং রুমে বসুন।
আবদুল করিমকে পাঁচ মিনিটও অপেক্ষা করতে হয়নি। চার মিনিট পরই তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন মোহিনী। আবদুল করিম মোহিনীর রুমে পা রাখামাত্র তিনি হাসি হাসি মুখ করে বললেন, আসেন আসেন করিম সাহেব। কেমন আছেন আপনি?
জি ম্যাম আমি ভালো আছি। আমি নিয়ম পালন করেই বাসা থেকে বের হয়েছি।
ভালো করেছেন। আপনার কারণে অন্যরা আক্রান্ত হবে তা তো হয় না।
জি জি।
তারপর, কি অবস্থা বলেন তো! ওখানকার অবস্থা কি দেখলেন?
আবদুল করিম বললেন, আমার মনে হয়, উহানের অবস্থা খুবই খারাপ। পুরো শহরে লকডাউন। কেউ বাসা থেকে বের হতে পারছে না। কোনো যানবাহন চলছে না। দোকান, শপিং কমপ্লেক্স সব বন্ধ। মানুষ খাবার পাচ্ছে না। পাগলের মত মানুষ ছুটছে খাবারের জন্য। টাকা আছে কিন্তু খাবার নেই। মনে হচ্ছিল, দুর্ভিক্ষ লেগে গেছে। সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা!
এটা কবে থেকে শুরু হলো। মোহিনী জানতে চাইল।
জানুয়ারি থেকেই শুরু হয়েছে। কিন্তু তখন তারা কাউকে বুঝতে দেয়নি। খবরটা কঠিনভাবে চেপে রেখেছে। ফেব্রুয়ারি থেকে এটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। তখন আর চেপে রাখার কোনো উপায় ছিল না। তবে উহান শহরে যখন একের পর এক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছিল তখন কিন্তু একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নতুন ভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু কেউ তার কথায় গা করেনি। সবাই অবহেলা করেছে। পরে ভাইরাসটি আস্তে আস্তে ছড়াতে থাকে। কেউ যেহেতু জানে না, ভাইরাসটি ছোঁয়াচে, তাই দ্রুতই একজনের কাছ থেকে হাজার জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
ধরুন আমি যদি আক্রান্ত হই তাহলে আমি কিভাবে বুঝব?
চলবে….