ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৩
দ্য ফার্স্ট ম্যান
লুসি খামটার দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলেন, খুললেন না। তিনি এবং তার মা, কেউই পড়তে পারতেন না। কোনো কথা না বলে, এক ফোটা অশ্রু না ফেলে তিনি খামটা উল্টে পাল্টে দেখলেন শুধু। এই মৃত্যুর কথা তার কল্পনাতে কিছুতেই আসেনি; দূরে কোথাও যেন রহস্যময় কোনো রাতের গভীরে ঘটে গেছে এই মৃত্যু। তারপর তিনি খামটা তার অ্যাপ্রনের পকেটে রাখলেন। শিশুটির দিকে না তাকিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। দুসন্তান নিয়ে যে রুমে থাকতেন তিনি সেই রুমের দিকে চলে গেলেন। দরজা বন্ধ করে দিয়ে উঠোনের দিককার ঝাঁপও বন্ধ করলেন। বিছানায় অশ্রুহীন নীরবে পড়ে থাকলেন অনেক অনেক ঘণ্টা। পকেটের খামটা দুমড়ে মুচড়ে দিলেন। দুর্বোধ্য দুর্ভাগ্যের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
– মা, জ্যাক বলে উঠল।
তখনও তিনি ওই ভঙ্গিতেই রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন। জ্যাকের কথা শুনতে পাননি। জ্যাক তার কুঁচকে যাওয়া হালকা বাহু ছুঁয়ে দিলে তিনি হাসিমুখে তার দিকে তাকালেন।
– বাবার কার্ড, হাসপাতাল থেকে পাঠিয়েছিল।
– হ্যাঁ।
– মেয়রের কাছ থেকে এটা পেয়েছিলে?
– হ্যাঁ।
গোলার একটা অংশ তার মাথার খুলিতে আঘাত করেছিল। তাকে অ্যাম্বুলেন্স ট্রেনগুলোর একটাতে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়; সারা গায়ে খড়ের টুকরো আর ব্যান্ডেজ বাঁধা। ওই ট্রেনগুলো সৈন্যদের ব্যাপক নিধনশালা থেকে সেন্ট ব্রিউকের অপসারণ হাসপাতালের মাঝে যাতায়াত করত। তারপর জ্যাক আরো দুটো কার্ড খুঁজে বের করতে সক্ষম হলো। একটাতে লেখা: আমি আহত হয়েছি। এটা তেমন কিছু নয়। –তোমার স্বামী। তার কয়েকদিন পরেই তিনি মারা যান। আরেকটা কার্ডে সেখানকার একজন নার্সের লেখা: এটাই ভালো হয়েছে; বেঁচে থাকলে হয় অন্ধ, নয় তো পাগল হয়ে থাকতেন। তিনি খুব সাহসী ছিলেন। এরপরই মা গোলার সেই ভাঙা অংশ পেয়েছিলেন।
রাস্তা দিয়ে তখন এক সারিতে সসস্ত্র তিন প্যারাসুটের পরিক্রমণ চলছে। সব দিকেই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হচ্ছে। তাদের একজন কৃষ্ণাঙ্গ, লম্বা এবং সুস্বাস্থের অধিকারী; তার প্রতিভাসের ওপরের ফোটা ফোটা দাগের কারণে তাকে বিশাল কোনো প্রাণীর মতো দেখাচ্ছে।
তাদের উপস্থিতির কারণ ব্যাখ্যা করে মা বললেন, ডাকাতদের জন্য ওরা বের হয়েছে। তোর বাবার কবর দেখতে গিয়েছিলি শুনে খুশি হলাম। আমার কথা তো জানিস, কত বয়স হয়ে গেছে। আর জায়গাটাও তো অনেক দূরে। দেখতে সুন্দর নাকি?
– কী কবর?
– হ্যাঁ।
– হ্যাঁ, খুব সুন্দর। ফুল দেওয়া হয়েছে ওখানে।
– হ্যাঁ, ফরাসিরা খুব ভালো লোক।
মুখে যা বললেন তার বিশ্বাসও তাই। তবে তার স্বামীর প্রতি আর বেশি দূর চিন্তা এগুতে দিলেন না। অনেক দিন আগের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে সেও বিস্মৃতিতে পতিত হয়ে গেছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আগুনে পুড়ে যাওয়া সেই মানুষটার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই: না তার নিজের মধ্যে, না এই বাড়িটাতে। দাবানলে পুড়ে যাওয়া প্রজাপতির পাখার ছাই যতটুকু বোধ্য তার স্মৃতির রেশটুকুও যেন ঠিক ততটুকুই বোধ্য।
– চুলায় খাবার পুড়ে যাচ্ছে; একটু অপেক্ষা কর।
মা উঠে গেলে জ্যাক তার জায়গায় বসে রাস্তার দিকে তাকাল। এত বছর পরও সব যেন একই রকম আছে: দোকানগুলো একই রকম; সূর্যের তাপে কোথাও কোথাও রংচং একটু জ্বলে গেছে। তামাকের দোকানী তার জানালায় শুধু ফাঁপা নলখাগড়ার পর্দার বদলে বহুবর্ণিল লম্বা দাগটানা প্লাস্টিক ব্যবহার করেছে। ফাঁপা নলখাগড়া থেকে আগে একটা অদ্ভূত শব্দ তৈরি হতো। জ্যাকের কানের কাছে এখনও বাজে সেই শব্দ। খবরের কাগজ আর তামাকের চমৎকার গন্ধ পাওয়ার জন্য এবং ল’ইনট্রেপিডে কেনার জন্য যখনই সে দোকানের ভেতরে প্রবেশ করত তখনই সম্মান আর সাহসের কাহিনীর গন্ধে শিহরিত হতো।
রাস্তা এখন রবিবারের প্রাণবন্ত অভিজ্ঞতায় ভরপুর হচ্ছে। কর্মজীবী পুরুষেরা নতুন করে ধোয়া এবং ইস্ত্রী করা সাদা শার্ট পরে সামনে তাদের দু-তিনটা ক্যাফেতে কাজ করতে যেতে যেতে আলাপ আলোচনায় মত্ত। ক্যাফেগুলোর কথা মনে হতে জ্যাকের খেয়াল হলো, ছায়াচ্ছন্ন শীতল আবহ আর মৌরির গন্ধে ভরা থাকত ওই ক্যাফেগুলো।
কয়েকজন আরবকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে: গরিব মানুষ হলেও সবাই মার্জিত পোশাক পরিহিত। তাদের স্ত্রীরা এখনও বোরকা পরা, তবে পায়ে তাদের পঞ্চদশ লুইয়ের আমলের জুতো। মাঝে মাঝে কতক আরব পরিবারের সকল সদস্য নিজেদের সবচেয়ে ভালো পোশাক পরে চলেছে। এরকম একটা পরিবারের তিন সন্তান একজনের পর আরেকজন সারিবদ্ধভাবে চলেছে; তাদের একজনের পোশাক প্যারাস্যুটধারীদের মতো। ঠিক তখনই পরিক্রমণের প্যারাস্যুটধারীরাও রাস্তায় ফিরে এল। তাদের মধ্যে এখন ঢিলাঢালা ভাব। ঠিক তখনই বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। লুসি করমারি ফিরে এলেন জ্যাকের কাছে।
মনে হলো খুব কাছেই একটা বিশাল বিস্ফোরণ ঘটেছে যেন কম্পন থামছেই না। অনেকক্ষণ আগে শব্দ থেমে গেছে; তবু খাবার ঘরের বাল্বটা কাচের ঢাকনার ভেতরে তখনও কেঁপেই যাচ্ছে। জ্যাকের মা রুমে ফিরে এসেছেন ফ্যাকাশে মুখে। তার কালো চোখ দুটো যেন ভয়ে টইটম্বুর। তিনি ভয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না; পায়ের ওপর নিজেকে স্থির রাখতে পারছেন না।
তিনি বলতে লাগলেন, এখানে, কাছাকাছি কোথাও বিস্ফোরণটা হয়েছে।
– না, বলে জ্যাক দ্রুত জানালার কাছে এগিয়ে গেল। রাস্তায় লোকজন ছোটাছুটি করছে; কোথায় যাচ্ছে কে জানে। একটা আরব পরিবার রাস্তার ওপাশে জামা কাপড় সুচসুতার দোকানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে; বাচ্চাদের আগে তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
দোকানদার তাদেরকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে জানালার কাছে এসে রাস্তার অবস্থা দেখছে। ঠিক এই সময় প্যারাস্যুট বাহিনী দ্রুত ছুটে এল রাস্তার ওপারে। গাড়িগুলো তাড়াহুড়া করে ফুটপাতের ধারে দাঁড়িয়ে থেমে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে। আরেকটু ঝুঁকে জ্যাক দেখতে পেল, আরেকটা বড় ভীড় এগিয়ে যাচ্ছে মুসেট সিনেমা আর ট্রলিবাসস্টপের মাঝামাঝি জায়গাটার দিকে। জ্যাক বলে উঠল, দেখে আসি কী হয়েছে।
রিউ প্রিভোস্ট-পারাদোলের কোণে একদল লোক চিৎকার করছে।
ক্যাফের দরজার সঙ্গে এঁটে দাঁড়িয়ে থাকা একজন আরবের দিকে তাকিয়ে গেঞ্জিপরা একজন শ্রমিক বলে উঠল, শালার আবর্জনার জাত!
আরব লোকটা বলল, আমি এসব করি না।
তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে লোকটা বলে উঠল, তোরা সব চুতিয়া কুত্তির বাচ্চা, এক সঙ্গেই এসব করে বেড়াস।
অন্যরা তাকে আটকে রাখল। জ্যাক আরব লোকটাকে বলল, এসো আমার সঙ্গে। লোকটাকে জ্যাক ক্যাফের ভেতরে নিয়ে গেল। এটা এখন তার বাল্যবন্ধু এবং নাপিতের ছেলে জাঁ চালায়। জাঁ তখন ওখানেই ছিল। চেহারা আগের মতোই আছে তবে মুখটা কুঁচকে গেছে। চেহারার অবয়ব ছোট আর শরীরটা পাতলা হয়ে গেছে। জাঁর মুখ দেখে মনে হলো, সে হয়তো গোপন কিছু জানে, সতর্ক।
জ্যাক বলল, ও কিছু করেনি; তোর বাড়ির ভেতরে নিয়ে যা।
কাউন্টার মুছতে মুছতে জাঁ লোকটার দিকে তাকাল। এসো, বলে জাঁ লোকটাকে নিয়ে ক্যাফের পেছন দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
জ্যাক বাইরে গেল এবং শ্রমিক লোকটা তার দিকে ভ্রুকুটি করতে লাগল।
জ্যাক বলল, ও কিছু করেনি।
– ওদের সবাইকে মেরে ফেলা উচিত।
– রাগের সময় তো তোমরা এসবই বলো। ভালো করে ভেবে দেখো।
শ্রমিক লোকটা ঘাড় ঝাঁকি দিয়ে বলল, ওখানে গিয়ে দ্যাখো, ওরা কী বিশৃঙ্খল কাণ্ড করেছে। তারপর দ্যাখো, কী বলতে পারো।
অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বেজে যাচ্ছে। ক্রমেই জোরে আর দ্রুত হচ্ছে শব্দ। ট্রলিবাসস্টপের দিকে দৌড়ে গেল জ্যাক। বাসস্টপের খুব কাছের একটা খুঁটিতে বোমাটা বিস্ফোরিত হয়েছে। সুসজ্জিত পোশাকে অনেক লোক বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। পাশের ক্যাফেতে অনেক লোকের চিৎকার শোনা যাচ্ছে: কান্নার, না রাগের বোঝা যাচ্ছে না।
জ্যাক মায়ের কাছে ফিরে গেল। মা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন; মুখটা ফ্যাকাশে। টেবিলের পাশে মাকে এগিয়ে নিয়ে জ্যাক বলল, বসো মা। মায়ের পাশে বসে জ্যাক মায়ের হাত দুখানা নিজের হাতে নিয়ে নিল।
– এক সপ্তাহের মধ্যে দুবার হলো। বাইরে যেতেই ভয় লাগে।
– ও কিছু না, মা। ঠিক হয়ে যাাবে।
– হ্যাঁ, বললেন তিনি। তবে চাহনিতে দোদুল্যমান অবস্থা: একদিকে তার ছেলের বুদ্ধির প্রতি প্রগাঢ় ভরসা, অন্য দিকে তার নিজের বিশ্বাস– জীবন সামগ্রিকভাবেই একটা দুর্ভাগ্য। এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা যায় না, শুধু নীরবে সয়ে যেতে হয়।
মা বললেন, এখন বুড়িয়ে গেছি। আর দৌড়তে পারি না।
এখন তার মুখের ওপর রক্ত ফিরে আসছে। দূরে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শোনা যাচ্ছে, দ্রুত এবং সনির্বন্ধ। কিন্তু মা সে শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না। গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে নিজেকে আরেকটু শান্ত করলেন। তারপর ছেলের দিকে তাকালেন সাহসী হাসিমুখে। তার চারপাশের আর সবার মতো তিনিও বিপদ আপদের মধ্যে বড় হয়েছেন। বিপদ তার হৃদয়কে হয়তো ক্ষণিক মোচড়াতে পারে। তবে তিনি আর সব কিছুর মতো বিপদকেও সয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ আগে মায়ের মুখের ওপর মুমূর্ষু মানুষের চাহনির মতো যে বেদনার্ত চাহনিটা দেখেছে জ্যাক সেটা সহ্য করা তার পক্ষে কঠিন।
সে বলল, মা তুমি আমার সঙ্গে ফ্রান্সে চলো।
কিন্তু তিনি দৃঢ় বেদনার সঙ্গেই বললেন, না, ওখানে খুব শীত। অনেক বয়স হয়ে গেছে না আমার! আমি বাড়িতেই থাকতে চাই।
(চলবে)
এসএ/