ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৯
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
হরেন্দ্রনাথ বেরিয়ে যায়। দোকান থেকে চিড়া, মুড়ি, গুড়, বিস্কুট ইত্যাদি অনেক কিছু কিনে নিয়ে আসে। তিনভাই ছুটে যায় বাবার কাছে। পোটলাটা নিয়ে বলে মা গুছিয়ে দাও এই পোটলা আমাদের কাছে থাকবে। মায়ারাণী ওদের দিকে তাকিয়ে হাসে। চারটি নদী পার হয়ে কত দুর্গম পথে যেতে হবে ছেলেদের চিন্তায় এসব নেই। ওদের বোঝার বয়স নেই। ওরা মায়ের কাছে পোটলাটা দিয়ে বলে, বাবা বোধহয় অনেককিছু কিনেছে মা। আমাদেরকে দেখাও।
–দরকার নাই। খুব সুন্দর করে বেঁধে দিয়েছে যে খুলবনা। নৌকায় ওঠার পর তোদের কাছে রাখিস।
–আচ্ছা, আচ্ছা, আচ্ছা।
ওরা উঠোনে ছুটোছটি করে বারান্দায় উঠে বাবাকে ঘিরে বসে। মায়ারাণী বড় এক পাতিল ভাত রান্না করে বীথিকাকে বলে, এগুলোকে পান্তাভাত বানাব। নৌকায় বসে দুপুরে ও রাতে খেতে হবে।
–হ্যাঁগো মা, ঠিকই আছে। বেশি করে লবণ নিয়ে নিচ্ছি, আর কাঁচামরিচ। তরকারি না থাকলে মরিচ-লবণ দিয়ে পান্তা খাব আমরা। একদিকে নদীর পানিতে ভেসে যাওয়া, আর একদিকে ভাতপানিতে পেট ভরানো। দারুণ হবে। নতুন রকমে দিন কাটবে।
খিলখিলিয়ে হাসে বীথিকা।
রাত হয়ে গেলে সবাই ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ে। সকালে সবার আগে ওঠে মায়ারাণী। পোটলাগুলো বারান্দায় গুছিয়ে রাখে। সকালে সবাই মিলে পান্তাভাত খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। এমন সময় পাকিস্তানি দালাল পাঁচজন বাড়ি লুট করতে আসে। ওদের সবাইকে চেনে মায়ারাণী। বেঁটে মোহসিন আলী সবার সামনে। ও বারান্দার একটি পোটলা ধরে টান দিয়ে মাথায় উঠালে মায়ারাণী ধানের গোলার নিচ থেকে গাছকাটা দা নিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে তাড়া করে ওদের। মোহসিন আলীর কাঁধে দায়ের কোপ মারে। মাথা থেকে পোটলা পড়ে যায়। মায়ারাণী রুদ্রমূর্তিতে অন্যদের তাড়া করলে বাকি সবাই দৌড়ে পালায়।
ওরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজায় তালা দিয়ে হরেন্দ্রনাথ বলে, চলো এক্ষুণি বেরিয়ে যাব। সবাই মিলে পোটলাগুলো মাথায় উঠায়, হাতে নেয়। তারপর দ্রুতপায়ে নদীর ধারে এসে পৌঁছায়। অজয় মাঝি তৈরি ছিল। সবাই উঠলে নৌকা ছেড়ে দেয়। মায়ারাণী পোটলাগুলো গুছিয়ে একপাশে রাখে। হরেন্দ্রনাথ হাত-পা ছড়িয়ে বসে। বারবার গ্রামের দিকে তাকায়। এখন পর্যন্ত কোথাও আগুন দেখা যায় না। নিজের বাড়ির কথা ভেবে আস্থির থাকে হরেন্দ্রনাথ।
–বাবাগো, কি সুন্দর লাগছে নৌকায় করে যেতে। আমরা কতদূর যাব বাবা?
–অনেকদূর। ভদ্রা নদীর পরও তিনটা নদী পার হতে হবে আমাদেরকে। এখন চুপ করে বসে থাক তোমরা। আর কথা বলবে না।
হরেন্দ্রনাথ চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পায় সামনে-পেছনে আরও বেশকিছু নৌকা আছে। সবাই বোধহয় শরণার্থী হবে। সব নৌকায় পরিবার আছে। এমন সময় দেখতে পায় দূর থেকে আসছে গানবোট। হরেন্দ্রনাথ আজয় মাঝিকে বলে, তুমি একদম নদীর ধারে চলে যাও। দরকার মনে করলে আমরা তীরে নেমে যাব।
অজয় মাঝি দ্রুত নৌকা চালিয়ে নদীর কিনারে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে খেয়াল করে গানবোট থেকে গুলি করছে। পেছন থেকে আসা দুটো ছোট নৌকার সবাই গুলিবিদ্ধ হলে নৌকা ডুবে যায়। পানিতে ডুবে যায় লাশ।
এই দৃশ্য দেখে মায়ারাণী কেঁদে ফেলে। বুকের ভেতরে হাহাকার ছোটে। চোখের সামনে মৃত্যু দেখা জীবনে এই প্রথম। বীথিকাও ডুবতে থাকা লাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। হরেন্দ্রনাথ ভাবে, আমার হাতে বন্দুক থাকলে ওদেরকে গুলি করতাম। শয়তানগুলো এভাবে মানুষ মারছে।
–আহ থাম। মায়ারাণী হাত চেপে ধরে।
–থামব কেন? ওরা আমাদেরকে মারবে, আর আমরা সবাই শুধুই মরব।
–তোমারতো অস্ত্র নাই। ট্রেনিং নাই। এসব থাকলে বলতাম যুদ্ধ কর।
–দেখি ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিতে পারি কি না।
অজয় মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে বলে, আপনারা আমার লম্বা নৌকায় শুয়ে পড়েন। দূর থেকে যেন আপনাদের দেখা না যায়।
–ঠিক বলেছ অজয়। এই শুয়ে পড়ছি সবাই।
বীথিকা ভাইদের শুইয়ে দেয়। তারপর নিজেও শুয়ে পড়ে। হরেন্দ্রনাথ, মায়ারাণীও গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ে। দূর থেকে তাদেরকে সরাসরি দেখা যাবে না। অজয় মাঝি ভদ্রা নদী পার হয়ে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া শিবসা নদীতে ঢোকে। সুন্দরবন দেখে উঠে বসে বীথিকা। এই বন দেখা মানে ওর প্রাণের টান পূরণ করা। বিকেলের নরম আলোয় চারদিক ফুলের মতো ফুটে আছে। হঠাৎ ও খেয়াল করে তীব্র গতিতে গানবোট চালিয়ে দিলে যাত্রীবাহী ছোট নৌকা ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে যায়। পাকসেনারা কোনো কোনো নৌকা গুলি করে ডুবিয়ে দেয়। নদী দিয়ে ভেসে আসতে থাকে লাশ।
বিথীকা শব্দ করে কেঁদে ফেলে। হরেন্দ্রনাথ আর মায়ারাণী মাথা তুলে বলে, কি হয়েছে রে?
–নদীর স্রোতের সঙ্গে লাশ ভেসে আসছে।
–ওহ –শব্দ করে দুজনে মুখ ঢাকে।
একটুপরে মায়ারাণী বলে, অজয় আমাদের নৌকা নদীর ধারে রাখ। আমরা বনে নামব।
–হ্যাঁ, খুব ভালো হবে। নামেন।
অজয় মাঝি নেমে নৌকাটা একটি ছোট গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে। সবাই মিলে নেমে যায়। ভাত-তরকারির হাঁড়ি নামানো হয়। থালা-গ্লাস জলের জগ নামিয়ে সবাই এক জায়গায় বসে। বীথিকা দাঁড়িয়ে বলে, আমি একটু বনের ভেতর থেকে ঘুরে আসি।
–দিদির সঙ্গে আমরাও যাব।
–না, তোরা এদিকে যাবিনা। তোরা ওইদিকে যা। আমি একা যাব।
–আচ্ছা। আমরা যাচ্ছি।
তিনভাই একসঙ্গে দৌড়ে বনে ঢুকে যায়। বীথিকা মাকে বলে, মা তুমি আমার সঙ্গে আস। আমি আড়াল করে দাঁড়ালে তুমি পেসাব করবে।
–হ্যারে চল।
মায়ারাণী উঠে দাঁড়ায়। হরেন্দ্রনাথ বলে, তোমরা এলে আমি যাব। আমি খাবারগুলো পাহারা দিচ্ছি।
–হ্যাঁ, তুমি থাক। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব। বীথিকা মায়ের হাত ধরে বনে ঢুকে যায়। পায়ের নিচে ঝরাপাতার মচমচ শব্দ হয়, মাথার ওপর সবুজ পাতার ছাউনি আর পাখিদের কূজন যুদ্ধের সমান্তরাল হয়ে ওঠে। দুজনেই ভাবে, এই সুন্দরবন আমাদের। এখানে সেনাবাহিনী ঢুকতে পারবেনা। ঢুকলে মেরে ছারখার করা হবে। কিন্তু কিভাবে? সে ভাবনা দুজনের মাথায় আসে না। দুজনে ভাবনা থেকে আড়াল হয়ে যায়। ভাবে অকারণ ভাবনায় কাজ হবে না।
(চলবে)
এসএ/