ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৩
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
দুজনে বেশ খানিকটা সামনে গিয়ে রাস্তার দুপাশে দাঁড়ায়। দুজনেই বুঝতে পারে যে গাড়িটা আসতে বেশ সময় লাগবে। দূরত্বটা এখনও অনেক।
মারুফ মনে মনে স্বস্তি বোধ করে। সময় লাগাই ভালো, তাহলে আসমানীকে পরিস্কার করে ফেলতে পারবে ওর মা। গর্ভের পানি ও রক্তে ভিজে আছে ও। আহারে আসমানী! সবার জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো আজ। সন্তানটির জন্ম ও মৃত্যু ঘটে গেল মাটিতে এবং আকশের নিচে। এই স্মৃতি মৃত্যু পর্যন্ত কেউ ভুলবেনা। দূর থেকে দেখতে পায় আসমানীকে অন্য একটি শাড়ি পরাচ্ছে ওর মা।
সময় পেরিয়ে যায়। গরুর গাড়ি এগিয়ে আসছে। চারদিকে তাকালে পথ-প্রান্তর দেখে মন ভরে যায় রবিউলের। জোরে জোরে বলে, কি সুন্দর আমার দেশ। মনে হচ্ছে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে রাখি।
- না, আব্বা আমরা যুদ্ধ করব। আমি শুধু শরণার্থী হব না। আপনাদেরকে ক্যাম্পে রেখে আমি ট্রেনিং নিতে যাব।
- ঠিক বলেছিস বাবা। আমিতো ভেবেছিলাম ছেলেটার মৃত্যু তোকে বসিয়ে দেবে।
- ওর মৃত্যু বুকে নিয়ে যুদ্ধ করব। যুদ্ধ শুরু না হলেতো ছেলেটার জন্ম রাস্তায় হতোনা। ঠিকমতো কবর দিতে পারলামনা।
কথা শেষ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ও। রবিউলের চোখও পানিতে ভরে যায়। মাথা নিচু করে বসে থাকে। মনে হয় মৃত্যুর হৃদয়-ভাঙা কান্না স্তব্ধ করে ফেলেছে দুজনকে। চারদিকে বাসাতের শোঁ- শোঁ শব্দ। খোলা প্রান্তর জনশূন্য।
পাখিদের ওড়াউড়ি মাথার ওপর থেকে ভালোবাসার পরশ বুলোয়। রবিউল বিড়বিড়িয়ে বলে, আমাদের যুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা
- তোরা আমাদের পাশে থাকিস পাখিরা।
ততক্ষণে গরুর গাড়ি এগিয়ে এসেছে। দুজনে মাথার উপর হাত তুলে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে। গরুর গাড়ি কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে নামে ওয়াজেদ মিয়া। জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে আপনাদের?
- আমরা আপনাদের সাহায্য চাই।
- কি হয়েছে?
রবিউল কাঁদ কাঁদ কন্ঠে বলে, আমার মেয়েটি গর্ভবতী ছিল। এই যে মারুফ আমার মেয়ের জামাই।
মারুফ বলে, আমরা গরুর গাড়িতে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটাও খোঁজ পাইনি। শেষে হেঁটে রওনা করি। ওই যে সামনের বট গাছের নিচে আমার শাশুড়ি আর বউ বসে আছে।
রবিউল কাঁদতে কাঁদতে বলে, ওই বট গাছের নিচে আমার মেয়েটি একটি সন্তানের জন্ম দেয়। ছেলেটি জন্মের পর মরে গেছে।
- কি করেছেন আপনারা?
- ওকে কবর দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় মেয়েটি হাঁটতে পারবে না বলে আপনাদের সাহায্য চাই। গাড়িতে যদি জায়গা থাকে ওকে গাড়িতে তুলে নেন।
- জায়গা বের করব। চলেন বটগাছের কাছে যাই। ওখানে গাড়ির সবাইকে নামিয়ে জায়গা ঠিক করব। আমি গাড়িতে উঠবনা। আপনাদের সঙ্গে হাঁটব।
মারুফ ঝট করে ওনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
রবিউল জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কি রে ভাই?
- মোবারক। আমি সাতগাঁ গ্রামে থাকি। ঠিক করেছি বউ-ছেলেমেয়েকে শরণার্থী ক্যাম্পে রেখে আমি ফিরে এসে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হব। ওরা যা করতে বলবে তাই করব।
- বাব্বা, তুমিতো অনেক চিন্তা করেছ।
মোবারক গরুর গাড়ির চালককে বলে, সামনে এগোও। আমাদের সঙ্গে চলো। ওই বটগাছের কাছে গিয়ে থামবে।
গরুর গাড়ির সঙ্গে স্বামী আর মেয়ের জামাইকে আসতে দেখে আকাশী বুঝে যায় যে আসমানীর যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। পোটলাগুলো পথের পাশে এনে জড়ো করে রাখে। আসমানীর দুহাত ধরে বলে, মা ওঠ। ওই দেখ ওরা গরুর গাড়ি জোগাড় করতে পেরেছে। দরকার হলে শুধু তোকে ওঠাব। আমরা সবাই হেঁটে যাব।
- আমার উঠতে কষ্ট হচ্ছে মা। আমি গরুর গাড়িতে বসতে পারবনা। তাহলে আমি যাব না।
- না গেলে এখানে কি করবি?
- মরে যাব। তারপর ছেলের সঙ্গে মাটির নিচে শুয়ে থাকব।
- কি বলছিস মারে। এটা কোনো কথা হলো। দেশ স্বাধীন হলে মনে রাখবি তোর ছেলে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে। ও আমার শহীদ নাতি।
- মাগো, তুমি এইভাবে বলতে পারলে?
- কেন পারবনা? এটাইতো সত্য। যুদ্ধের সময় না হলে আমরাতো পথে নামতাম না।
আসমানী কেঁদে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দিলে। সম্মানের শিক্ষা দিলে। সবার কাছে এভাবেই বলব।
- হ্যাঁ, বলবি, বলবি। আজীবন তোর স্মরণে এইকথা থাকবে।
- ওই দেখ গরুর গাড়ি কাছাকাছি এসে গেছে। চল রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়াই।
পা টেনে হেঁটে রাস্তার কাছে যায় আসমানী। একটু পরে গরুর গাড়ির এসে থামে। মোবারক এগিয়ে এসে বলে, আমার বউ বাচ্চারা আছে। আমি আসমানীকে নিতে পারব গাড়িতে। মোবারক বউ সাফিয়াকে বলে, মেয়েটার বাচ্চা হয়ে মরে গেছে। ও হেঁটে যেতে পারবেনা। ওকে গাড়িতে নিতে হবে।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিব। আস মা আস।
গাড়িতে আছে মোবারকের দশ-পনেরো বছরের তিনজন ছেলেমেয়ে। ওরা একসঙ্গে বলে ওঠে, আমরাও মাঝে মাঝে হাঁটব। বুবুকে গাড়িতে উঠান। দেখি কতদূর হেঁটে যেতে পারি।
সবাই গাড়ি থেকে নেমে আসে। আকাশী এগিয়ে গিয়ে সাফিয়াকে বলে, আমি ওর মা। ওকে গাড়িতে একটু জায়গা দেবেন। আমি হেঁটে যাব।
- চলেন, ওকে গাড়িতে উঠাই। আয় মা। দুজনে আসমানীকে গাড়িতে উঠায়। ও গাড়িতে উঠেই গুটিসুটি হয়ে
শুয়ে পড়ে। বসে থাকার সাধ্য ওর নেই।
সাফিয়া বলে, মাগো এই বালিশটা মাথার নিচে দে। আমি গাড়িতে শোব বলে বালিশ রেখেছি। কাঁথা রেখেছি।
- আমিতো বিছিয়ে রাখা কাঁথার উপরে শুইলাম। নে, বালিশ দিচ্ছে তোর মাথার নিচে। আমরা দুজন তোর দুই পাশে বসব। আমার ছেলেমেয়েরা
হাঁটুক। যখন ওরা হাঁটতে পারবেনা, তখন ওরা গাড়িতে উঠে বসবে, আমরা দুজন নেমে যাব।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। তাই হবে।
মোবারক গাড়োয়ান শফিককে বলে, তুমি আগাও। পথ একটাই। এদিক-ওদিক যেতে হবে না।
- আচ্ছা, সালাম হুজুর।
গরুর গাড়ি চলতে শুরু করে। ছেলেমেয়েরা দৌড়াতে শুরু করে। কিছুদূর গিয়ে থামে। মারুফও ওদের সঙ্গে দৌড়ে ওদের কাছে থাকে। বাবুল বলে, আপনি কেন
এসেছেন মারুফ ভাই?
- তোমরা যেন এদিক-ওদিক চলে না যাও সেজন্য। আমরা এখানে এখন দাঁড়িয়ে থাকব। তোমাদের বাবা এলে, আমার বাবা এলে, গরুর গাড়ি এলে
আমরা একসঙ্গে যাব।
- আচ্ছা তাই হবে। তাহলে আমরা এখানে বসি।
- তোমাদের নাম বল আমাকে।
- আমি বাবুল, আমি সবার বড়। আমি নজরুল, আমি মেজো। আমি আমিনা সবার ছোট।
- চলো ওই ঘাসের উপর বসি। কি সুন্দর চারদিক। সবাই মিলে ঘাসের ওপর বসে। আমিনা জিজ্ঞেস করে, এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে মারুফ ভাই?
- যেদিন আমরা পাকিস্তান সেনাদের এই দেশ থেকে তাড়াতে পারব সেদিন। যেদিন দেশ স্বাধীন হবে সেদিন। বাবুল জিজ্ঞেস করে, মারুফ ভাই আপনি
বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন।
- তিনি যেদিন মার্চ মাসের সাত তারিখে রমনা রেসকোর্সে ভাষণ দিয়েছিলেন সেদিন আমি তাঁকে মঞ্চে দেখি। আর কোনোদিন দেখিনি।
- আমরাতো দেখতে চাই। কিভাবে দেখতে পাবো?
- যুদ্ধ শেষ হলে আমি তোমাদেরকে ঢাকায় নিয়ে যাব।
- সত্যি, সত্যি, সত্যি মারুফ ভাই।
- হ্যাঁ রে সত্যি। গাড়ি এসে গেছে। চল, আমাদের যেতে হবে। উঠে দাঁড়িয়ে তিনজনে দৌড়াতে শুরু করে। কিছুদূর দিয়ে আবার দাঁড়িয়ে থাকে। মারুফ ওদের সঙ্গে যায়নি। ও গরুর গাড়ির পেছনে সবার সঙ্গে চলে।
মোবারক বলে, আমার ছেলেমেয়ে তিনটি এমনভাবে দৌড়ায় যে আমি ভয় পাই।
- ভয় পাবেন না চাচা। এরপরে আমি ওদেরকে আমার সঙ্গে ধরে রাখব। ওদেরকে আর দৌড়াতে দেব না। তাহলে হয়রান হয়ে যাবে।
- ঠিক বলেছ। চলো এগোই।
(চলবে)