ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৩
দ্য ফার্স্ট ম্যান
পুরুষ দুজনকে ঢুকতে দেখে আরব মহিলা চকিতে তাদের দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসি ছড়িয়ে দিল। তারপর আগুনের দিকে ফিরে তাকাল; এখনও তার হাতে এনামেল বেসিনটা। ক্যান্টিনের মালিক মহিলা তাদের দুজনকে দেখে আনন্দের সঙ্গে বলে উঠলেন, আপনার আর দরকার নেই ডাক্তার সাহেব। এমনি এমনিই হয়ে গেছে। মহিলা হাঁটুর ওপর বসে আবার কাজে ফিরে গেলে তারা দুজন দেখতে পায় রোগীর পাশে রক্তে ভেজা আকারহীন কী যেন স্থির অবস্থার মধ্যেই নড়াচড়া করছে আর চাপা চিঁহিচিঁহি স্বরে কানে আসে কি আসে না ধরনের মিহি আওয়াজ করছে অবিরত।
ডাক্তার বললেন, তা-ই তো বলছে সবাই। আশা করি আপনারা নাড়ী এখনো ছুঁয়ে দেখেননি।
মহিলা হাসতে হাসতে বললেন, না, আপনার জন্য কোনো একটা কাজ তো রেখে দিতেই হয়। তাই আমরা আপাতত এই কাজটা রেখে দিয়েছি।
মহিলা উঠে গিয়ে ডাক্তারের জন্য জায়গা করে দিলেন। ডাক্তার যেভাবে বসলেন তাতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা করমারির দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেল নবজাতক। করমারির মাথা উদোমই রয়ে গেছে। ডাক্তার মেঝে বসে পড়ে তার ব্যাগ খুললেন। তিনি আরব মহিলার কাছ থেকে বেসিনটা নিলে মহিলা আলোর এলাকা ছেড়ে উনানের পাশে আড়ালে এসে দাঁড়ালেন। ডাক্তার ভালো করে হাত ধুলেন। তার পেছন পাশ এখনও দরজার দিকেই। তার সদ্যো-ধোয়া দুহাতে একটুখানি মাদক ঢাললেন। গন্ধটা কিছুটা আঙুরের রসের মতো। সঙ্গে সঙ্গে গোটা রুম গন্ধে ভরে উঠল। এই মুহূর্তে স্ত্রী মাথা তুলে তাকিয়ে তার স্বামীকে দেখতে পেল। ক্লান্ত সুন্দর মুখটাতে চমৎকার তৃপ্তির একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল।
করমারি জাজিমের কাছে এগিয়ে এল। করমারিকে উদ্দেশ করে নবজাতকের দিকে ইঙ্গিত করে নিঃশ্বাসের মতো হালকা সুরে তার স্ত্রী বলল, এসে গেছে। তারপর শিশুটির দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিল।
ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, এসে গেছে। কিন্তু আপনি এখন একটু চুপচাপ থাকুন।
প্রসূতি ডাক্তারের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল।
করমারি জাজিমের পায়ের দিকটায় দাঁড়িয়ে তার স্ত্রীর দিকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করে বলল, চুপ করে শুয়ে থাকো।
সে আবার শুয়ে পড়ল। টালির পুরনো ছাদের ওপর বৃষ্টি আরো বার দুয়েক জোরালো শব্দে বয়ে গেল। ডাক্তার কম্বলের নিচে কাজ করতে এগোলেন। সোজা হয়ে বসে সামনে কী যেন ঝাঁকাতে লাগলেন। মৃদু একটুখানি কান্নার শব্দ হলো।
ডাক্তার বলে উঠলেন, ছেলে হয়েছে! বাহ, চমৎকার স্বাস্থ্যবান ছেলে!
হ্যাঁ, নতুন বাড়িতে উঠে সুন্দর জীবন শুরু হতে যাচ্ছে, বললেন ক্যান্টিনের মালিক মহিলা।
এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা আরব মহিলা হাসতে হাসতে দুবার হাততালি দিয়ে উঠল। করমারি তার দিকে দৃষ্টি ফেরালে মহিলা কিছুটা বিব্রত বোধ করে একটূখানি সরে গেল।
ডাক্তার বললেন, ঠিক আছে, কয়েক মুহূর্তের জন্য আমাদের একটু নিরিবিলি কাজ করতে দিন আপনারা।
করমারি তার স্ত্রীর দিকে তাকাল। তার চাহনি তখনও শিশুটির দিকে কাত হয়ে আছে। মোটা কম্বলের ওপর তার একটা হাত আলগোছে ফেলে রাখা। স্ত্রীর হাত দেখেই করমারির মনে পড়ে গেল, একটু আগে হতভাগা রুমটা আলোয় ভরিয়ে তুলেছিল তার স্বর্গীয় হাসি। মাথায় হেলমেট পরে করমারি দরজার দিকে এগোল।
ক্যান্টিনের মালিক মহিলা করমারির উদ্দেশে বললেন, ছেলের নাম কী রাখবেন?
মহিলার দিকে তাকিয়ে করমারি বলল, জানি না। আমরা এখনও ঠিক করিনি। তবে ওর জন্ম উপলক্ষে আপনি যেহেতু এসেছিলেন তাহলে ওর নাম রাখা যেতে পারে জ্যাক।
মহিলা উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়লেন। করমারি বাইরের দিকে পা বাড়াল। আরব গাড়োয়ান তখনও চট মাথায় দিয়ে আঙুর গাছের তলায় অপেক্ষমাণ। সে করমারির দিকে তাকাল। তবে করমারি কিছু বলল না। চটের এক কোণা এগিয়ে দিয়ে গাড়োয়ান বলল, এখানে আসুন; এটার নিচে দাঁড়ান।
করমারি চটের তলায় এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধের কাঁধের সঙ্গে তার নিজের কাঁধ লেগে গেছে টের পেল সে। লোকটার গায়ের কাপড় থেকে তামাকের গন্ধ আসছে। তাদের দুজনের মাথা ঢেকে রাখা চটের ওপরে বৃষ্টি পতন টের পেতে থাকে সে। সঙ্গীর দিকে না তাকিয়েই করমারি বলে ওঠে, ছেলে হয়েছে।
বৃদ্ধ খুশিতে বলে ওঠে, সকল প্রশংসা আল্লাহর। আপনি একজন বড় কর্তা। হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে আসা পানি তাদের পায়ের কাছে কয়লার কুচির ওপরে পড়তে থাকে; বৃষ্টিতে সৃষ্ট ছোট গর্তের ওপরে, আর দূরের আঙুর ক্ষেতের ওপরে গড়িয়ে পড়তেই থাকে। আঙুর ক্ষেতের মাচাগুলো বৃষ্টির ফোঁটায় মাঝে মাঝে চকচক করে ওঠে। বৃষ্টির এই ধারা পূর্ব দিকের সমুদ্রে যাবে না; গোটা দেশ, নদীর ধারের জলাভূমি, আশপাশের পাহাড় পর্বত আর প্রায় জনবসতিহীন এই বিশাল ভূখণ্ডকে সিক্ত করে দেবে। বিশাল সিক্ত ভূখণ্ড থেকে চমৎকার একটা গন্ধ ভেসে আসছে। একটা চটের নিচে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মানুষের কাছে তখন তাদের পেছনের দিক থেকে ভেসে আসছে ক্ষীণ কান্নার আওয়াজ।
রাত গভীর। করমারি তার স্ত্রীর জাজিমের পাশে বিছানো আরেকটা জাজিমের ওপর অন্তর্বাস আর গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে ঘরের ছাদে উনানের আগুনের নাচ দেখছে। রুমটা এখন মোটামুটি পরিপাটি করে গোছানো মনে হচ্ছে। তার স্ত্রীর আরেক পাশে কাপড়-চোপড় রাখার বড় একটা ঝুড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে আছে তাদের শিশু সন্তান। কোনো সাড়া শব্দ নেই। তবে মাঝে মাঝে গলার ভেতর থেকে মৃদু গড়গড় আওয়াজ আসছে। তার স্ত্রীও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিছুটা খোলা মুখটা তার দিকে ফেরানো। বৃষ্টি থেমে গেছে। আগামীকালই কাজে যোগ দিতে হবে। তার খুব কাছেই পড়ে আছে তার স্ত্রীর ক্লান্ত হাত; দেখতে এমনই শুকনো মনে হয় কাঠের তৈরি। হাত দেখেই তার মনে পড়ে যায় এই হাত দিয়ে এযাবৎ কত কাজ করা হয়েছে। নিজের হাত এগিয়ে নিয়ে স্ত্রীর হাতের ওপর আলতো করে রেখে মাথাটা আরেকটু পেছনের দিকে নিয়ে করমারি আরামে চোখ বন্ধ করে।
(চলবে)