ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৭
বিষাদ বসুধা
স্বাস্থ্যমন্ত্রী পাগলের মতো সাহেদ করিমকে খুঁজছেন। সাহেদ তাকে কথা দিয়েছিল যে, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মিডিয়াতে আর কোনো রিপোর্ট হবে না। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একের পর এক দুর্নীতির রিপোর্ট পত্রিকায় আসছে। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির রিপোর্ট। সারাক্ষণ তার মনের মধ্যে ভয়, এই বুঝি প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে পাঠালেন! এই বুঝি তাকে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বলা হলো! মন্ত্রী কারও কাছে মুখ দেখাতে পারেন না। বাসায় পত্রিকা লুকিয়ে রাখেন। বউ ছেলে মেয়েদের কাছে ছোট হয়ে যাওয়ার ভয় তার। কিন্তু পত্রিকা লুকালে কী হবে? টিভিগুলির কী করবেন? টিভিগুলো যেন আরেক ডিগ্রি সরেষ। সেখানে খবর তো প্রচার করেই। খবরের পর পরই শুরু হয় টকশো। সেই টকশো বড়ই টক লাগে মন্ত্রীর কাছে। সেদিন পরিবারের সবাই মিলে টিভিতে খবর দেখতে বসে বড় লজ্জার মুখে পড়লেন মন্ত্রী। সংবাদের শুরুতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির খবর! মন্ত্রীর হাতেই ছিল রিমোট কন্ট্রোল। হেডলাইন পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অন্য চ্যানেলে চলে গেলেন। এক পর্যায়ে বন্ধই করে দিলেন।
মেহেরুন্নেসা বললেন, কি হলো? খবরটা দাও না!
না।
কেন?
খবরটা তিতা।
মেহেরুন্নেসা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কোনো খবরটা তিতা তা মনে করার চেষ্টা করলেন। কোনো একটা দুর্নীতির খবর! না। মনে করতে পারছেন না। তিনি মন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, রিমোটটা আমার কাছে দাও তো।
না। এখন থাক।
মেহেরুন্নেসা আবারও বিস্ময়ের দৃষ্টিতে মন্ত্রীর দিতে তাকিয়ে রইলেন। বাচ্চারা টিভির সামনে থেকে উঠে চলে গেল। মেহেরুন্নেসাও কিছুক্ষণ পর অন্য ঘরে চলে গেলেন। মন্ত্রী বসে রইলেন। দুশ্চিন্তার বোঝা ভারী হয়ে তার মাথায় চেপে বসে। তিনি মনে মনে ভাবেন, এভাবে লুকিয়ে তিনি কতদিন ঠেকিয়ে রাখবেন! একদিন না একদিন তো পরিবারের লোকরা জানবেন। তখন তাদের কাছে তিনি কীভাবে মুখ দেখাবেন!
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ব্যাচারা লোক খারাপ না। নিরেট ভদ্রলোক। তিনি নিজে দুর্নীতি করেন না। কিন্তু তার মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি কিছুতেই ঠেকাতে পারছেন না। আসলে তিনি প্রশাসনিকভাবে শক্ত লোক না। কাউকে কিছু বলতে পারেন না। শুরুতেই তিনি যদি শক্তভাবে হাল ধরতেন তাহলে নিয়ন্ত্রণ হয়তো করতে পারতেন। তার অদক্ষতার কারণেই দুর্নীতি করার সুযোগ পাচ্ছে। আসলে শুধু সৎ ভদ্রলোক হলেই চলে না। তাকে দক্ষ হতে হয়। প্রশাসনকে শক্ত হাতে চালাতে হয়। সেই কথা বার বার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পছন্দ করেন বলে হয়তো এখনই চাকরিটা যাবে না। কিন্তু যেতে কতক্ষণ! তিনি আর যা-ই হোক, দুর্নীতি এবং দুশ্চরিত্র লোকদের দুই চোখে দেখতে পারেন না। কারও বিরুদ্ধে এই দুই ধরনের অভিযোগ উঠলে তার আর রক্ষা নেই। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি এক মুহূর্তও দেরি করেন না। এটা স্বাস্থ্যমন্ত্রী খুব ভালো করেই জানেন। তিনি এও জানেন, প্রধানমন্ত্রী পত্রিকার কাটিং নয়; প্রতিদিন পত্রিকার হার্ড কপি পড়েন। তার কাছে সবগুলো পত্রিকা যায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির রিপোর্টগুলো তার নজর এড়াবে না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী পত্রিকায় দুর্নীতির রিপোর্ট দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন, ইস! কয়েকদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী ডেকে করোনা মোকাবিলার জন্য বড় একটা বাজেট দিয়েছেন। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি ভাবেন, আমরা সবাই মিলে প্রধানমন্ত্রীর করোনার বাজেট নয়ছয় করছি! ছি ছি! এটা কোনো কাজ হলো!
কদিন ধরে দুশ্চিন্তায় মন্ত্রী ঘুমাতে পারেন না। তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা তাকে অস্থির দেখে বলেন, কী হয়েছে করিম? কী নিয়ে এত চিন্তা করছ? কোনো সমস্যা হয়েছে?
না। তেমন কিছু না।
তাহলে এমন করছ কেন?
কেমন করছি?
কেমন অস্থির লাগছে তোমাকে! মনে হচ্ছে, কোনো বিষয় নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করছ!
আমার কিছুই ভালো লাগছে না।
আমাকে খুলে বলো। কোনো অসুবিধা নেই। আমি তোমাকে হেল্প করব।
পরে বলব।
পরে কেন? প্রেমে ট্রেমে পড়নি!
মন্ত্রী এবার না হেসে পারলেন না। একটা ভয়ানক থমথমে পরিবেশকে মেহেরুন্নেসা হালকা করে দিলেন। কিছুক্ষণের পরেই তিনি বললেন, হাসছ কেন? তোমার এখন অনেক ক্ষমতা। সরকারের ডাকসাইটে মন্ত্রী! এখন তো দুধের মাছিরা তোমার কাছে ঘুরঘুর করবেই। আমি মেয়ে। তাই মেয়েদের আমি খুব ভালো করে চিনি।
মন্ত্রী নিজে আবার চিন্তার রাজ্যে ডুবে গেলেন। তিনি মনে মনে সাহেদ করিমকে খোঁজেন। চিন্তা করতে করতেই মোবাইল হাতে নিয়ে সাহেদ করিমকে ফোন করেন। না। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ফোন বন্ধ।
মন্ত্রী মনে মনে সাহেদ করিমকে গালমন্দ করেন। লোকটা একটা ভুয়া। কথা দিয়ে কথা রাখে না। বিপদের সময় পাশে থাকে না। আমার বিপদ থেকে সে বোধহয় কেটে পড়েছে। চরম বিরক্তি নিয়ে আবার টেলিফোনে সাহেদকে খোঁজেন।
কিছুক্ষণ পর মেহেরুন্নেসা আবার মন্ত্রীর কাছে গিয়ে বললেন, আজ পত্রিকা দেখেছ? স্ত্রীর কথা শুনে মন্ত্রী চমকে উঠলেন। বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি বললেন, পত্রিকা! সকালে কখন দেখলে তুমি পত্রিকা! কী লিখেছে পত্রিকায়!
মন্ত্রীর চেয়েও বেশি বিস্মিত হলেন মেহেরুন্নেসা। তিনি ভাবতেও পারেননি মন্ত্রী তার কথায় এতটা বিস্ময় প্রকাশ করবেন। তার মানে কী! গত কয়েকদিন ধরে পত্রিকা পাচ্ছিলাম না কী কারণে? মন্ত্রী নিজেই কি লুকিয়ে রেখেছিলেন?
কিছুক্ষণ পর মেহেরুন্নেসা আবার বললেন, পত্রিকার কথা শুনে তুমি ওমন বিস্ময় প্রকাশ করলে কেন?
মন্ত্রী কথা ঘুরানোর জন্য বললেন, না মানে তুমি পত্রিকা কখন দেখলে?
আমি আজ অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠেছি। জানো, গত কয়েকদিন ধরে পত্রিকা পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম আগে আগে উঠে আজ হকারকে ধরব। হাঁটতে যাওয়ার নাম করে নিচে হাঁটাহাঁটি করলাম।
মন্ত্রী আবারও বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, তারপর! হকারকে পেলে?
হুম। হকারের কাছে জানতে চাইলাম, পত্রিকা সে ঠিকঠাক মতো দেয় কি না-
কী বলল?
বলল, ঠিকমতোই দিয়ে আসছে। কোনো রকম ত্রুটি করেনি। তাহলে পত্রিকাগুলো কোথায় গেল?
যাকগে, ওসব কথা রাখো। পত্রিকায় কী লিখেছে সেটা বলো।
মেহেরুন্নেসা সাহেদ করিম বলার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী লাফিয়ে উঠলেন। বিস্ময় আর আতঙ্ক নিয়ে স্ত্রীর সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, সাহেদ কী করেছে!
এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? বলছি।
আচ্ছা আচ্ছা...
তোমাদের সঙ্গে সাহেদ কোনো চুক্তি করেছিল নাকি!
হুম। করেছিল। করোনার ফ্রি টেস্ট করানোর বিষয়ে চুক্তি।
রিজেন্ট হাসপাতাল তো!
হুম।
এই দেখ তাকে নিয়ে পত্রিকায় কী লিখেছে।
পত্রিকা হাতে নিয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে মন্ত্রী তাকিয়ে রইলেন।
গণমাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখির পর সাহেদ করিমকে গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সরকারের সিদ্ধান্তের কথা পুলিশ ও র্যাবের উপর মহলকে জানিয়ে দেওয়া হয়। শুরু হয় অভিযান। সারাদেশে পুলিশ ও র্যাব তৎপর। তৎপর মিডিয়াও। প্রতিদিনই তাকে নিয়ে নানা ধরনের কার্টুনসহ প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে, সাহেদেও পুরো ব্যবসাই দাঁড়িয়েছে মিথ্যার উপর। সে যে হাসপাতাল করেছে তার বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিলেও নিজের কোনো মিডিয়া নেই। অথচ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তার চলাফেরা, ওঠাবসা। তার দুই নম্বরি কাজকর্মেও খবর এখন পত্রিকায় উঠে আসছে। উঠে আসছে টিভির খবরের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। তাকে নিয়ে টিভিগুলোতে থাকছে টকশো। সে এখন টক অব দ্য টাউন থেকে টক অব দ্য কান্ট্রি হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে সর্বত্র আলোচনা। রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে, পাড়ায় মহল্লায় আলোচনার তুফান উঠছে। ছেলে-বুড়ো সবাই বলছে, দেশে এখন একটাই ইস্যু, সাহেদ।
বাংলাদেশে এই হলো আরেক সমস্যা। যখন যে ইস্যু আসে সেই ইস্যুটি তিতা না হওয়া পর্যন্ত কচলাতেই থাকে। দেশে যেন আর কোনো ইস্যু নেই। কেন? যখন ইস্যুটি তৈরি হচ্ছিল তখন কেন ধরা হলো না? আগে কেন সবাই সাহেদকে নিয়ে এতো নাচানাচি করল। অনেকে বলেন, সাহেদকে ছাড়া নাকি কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে টকশোই শুরু হয় না! বাপরে! এত ক্ষমতা সাহেদের! এখন সেই সাহেদ কোথায়?
সাহেদ করিমের সঙ্গে বড় সাংবাদিকদের ছবি গণমাধ্যম লুকোবার চেষ্টা করলেও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে মন্ত্রী-এমপিদের ছবিও। সেই ছবিগুলো ভাইরাল হয়ে যায়। অতি সাধারণ মানুষও জানে, সাহেদের সঙ্গে কারা ওঠাবসা করেছে। এখন গরু খোঁজার মতো সাহেদকে খোঁজা হচ্ছে। পেলেই তাকে সুলে চড়ানো হবে-এমন অবস্থা।
সাহেদ করিমের সৃষ্টি হলো কীভাবে সে কথা কিন্তু কেউ বলছে না।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>