ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ২০
বিষাদ বসুধা
আসিফ আহমেদ নিজের কক্ষে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছেন। ছাঁটাইয়ের চাপ জগদ্দল পাথরের মতো তার মাথার ওপর চেপে বসেছে। ছাঁটাই বন্ধ করার উপায় খুঁজছেন তিনি। দিন-রাত তার এক চিন্তা। ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? কি বললে কর্তৃপক্ষ ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে তা নিয়ে তিনি ভাবেন। বিকল্প প্রস্তাবগুলো তো ভালো ছিল। কেন তারা সেগুলোকে গ্রহণ করছে না? কেন সেগুলোকে যৌক্তিক মনে করছে না? কেন তারা ভাবছেন, ছাঁটাই-ই তাদের একমাত্র সমাধান? যাদের ছাঁটাই করতে চাচ্ছে সেই লোকগুলো বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করেছে। প্রতিষ্ঠানকে তারা অনেক দিয়েছে। দিন নেই রাত নেই গাধার খাটুনি খেটে তারা প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড় করিয়েছে। অথচ বিপদের দিনে সেই প্রতিষ্ঠানই তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে! না না! এটা মানা যায় না।
আসিফ মনে মনে বললেন, আমি আমার কথা বলে যাব। তালিকা চাইলে বলব, আমার পক্ষে তালিকা করা সম্ভব না। ছাঁটাই করার মতো কাউকে দেখছি না। প্রয়োজনে বেতন কমিয়ে দিন। সেটাও মানা যায়। এই বিপদের দিনে ছাঁটাই কেন? এরা যাবে কোথায়?
আসিফ আহমেদের ভাবনাগুলো মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তার কক্ষে কয়েকজন বিভাগীয় প্রধান এল। তাদের দেখে আসিফ আহমেদ নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। তাদেরকেও বসতে বললেন। পিয়ন এসে সবাইকে চা-নাশতা দিতে শুরু করে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই চুপচাপ। আসিফ বললেন, কি হলো, চা নাও!
বিজ্ঞাপন বিভাগের নুরুজ্জামান চায়ে চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলের ওপর রাখল। তারপর বলল, কিছু করতে পারলেন?
এমডি সাহেব ছাঁটাইয়ের বিকল্প কিছু দেখছেন না।
কেন? আমাদের প্রস্তাবগুলো পছন্দ হয়নি!
না। উনি বললেন, এসব দিয়ে হবে না। তালিকা করে আনেন। ছাঁটাই ছাড়া বিকল্প নেই। এত লোক আমার কোনো প্রয়োজন নেই। কাগজের ভলিউম কমে গেছে। লোকও কমাতে হবে। যখন ভলিউম বাড়বে তখন লোক বাড়াব। নতুন লোক দিয়ে চালাব! আমার প্রস্তাবগুলো পড়েও দেখল না। আচ্ছা অন্যরা কি করছে? কোনো খবর পেলে?
এখনো কেউ ছাঁটাইয়ে যায়নি। তবে ছাঁটাইয়ের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। নুরুজ্জামান বলল।
সুনির্দিষ্ট করে বলো না! কোন কোন পত্রিকা ছাঁটাই করতে পারে?
প্রথম আলো, ইত্তেফাক, সমকাল, ডেইলি স্টারসহ অনেকেই। বেশ কিছু পত্রিকা তো বন্ধই হয়ে গেছে। অনেক সাংবাদিক বেকার হয়েছে।
কিন্তু বড় কাগজগুলো এখনো ছাঁটাইয়ে যায়নি, তাই না?
নুরুজ্জামান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। এরমধ্যেই মামুন রশিদ হন হন করে সম্পাদকের কক্ষে এসে হাজির হলো। এসেই সে বলল, কোনো পত্রিকাই ছাঁটাই করছে না। আমাদের কেন ছাঁটাই করতে হবে আসিফ ভাই? আপনি এমডি সাহেবকে বুঝিয়ে বলেন। প্রয়োজন হলে আমাদেরকে নিয়ে চলেন।
আমি স্পষ্ট করেই তোমাদের বলছি, ছাঁটাই করতে হলে আমি নাই। প্রয়োজন হলে আমি পদত্যাগ করব। তবু ছাঁটাই করতে পারব না। আমি কারো পেটে লাথি দিতে পারব না।
ঠিক আছে আসিফ ভাই। আপনার এই সিদ্ধান্তকে স্যালুট জানাই।
না মানে আমার নিজস্ব একটা নীতি তো আছে! নীতি-নৈতিকতার বাইরে আমি কিভাবে যাব? আমি নীতি বিসর্জন দিতে পারব না। অন্যরা পারতে পারে। আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি যদি ভাবি, অন্যদের ডুবিয়ে দিয়ে আমি নিজে বাঁচব। তাহলে তা সম্ভব হবে না। কোনো দিনও হবে না। একা বাঁচা যায় না। এটা যদি কেউ ভাবে, তাহলে তা ভুল।
ধন্যবাদ আসিফ ভাই। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি আসি।
কথা শেষ করেই মামুন রশিদ চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। এ সময় তার বেতনের কথা মনে পড়ে। আচ্ছা আসিফ ভাই, আরেকটা কথা ভুলে গেছি বলতে। বেতনের কি অবস্থা আমাদের?
নুরুজ্জামানের সঙ্গে সে বিষয় নিয়েই কথা বলছিলাম। বিজ্ঞাপনের তো কোনো টাকাই পাচ্ছি না। কিছু টাকা পাওয়া গেলে নিচের দিক থেকে শুরু করা যেত। চেষ্টা করছি। দেখা যাক।
কেন আমাদের কর্তৃপক্ষ কোনো টাকা দেবে না? মামুন রশিদ জানতে চাইল।
কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা বার বারই বলছে, আমরা কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারব না। তারা নিজেদের বিজ্ঞাপনের টাকাটাও যদি দিত তাহলেও কিন্তু আমাদের কোনো সংকট থাকত না। তারা বিজ্ঞাপন করবে কিন্তু টাকা দেবে না। এ এক আজব জায়গা!
মামুন রশিদ আর দাঁড়াল না। আসিফ আহমেদ নুরুজ্জামানকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি সর্বোচ্চ চেষ্টা কর। আমি যাদেরকে ফোন করলাম তারা কি কোনো চেক দিয়েছে?
রেডি করছে। শিগগিরই দেবে বলেছে। আপনি একটু চেয়ারম্যান সাহেবকে বলেন না; আমাদের বিজ্ঞাপনের টাকাও যদি এই বিপদের সময় দিত!
বলেছি। অনেকবার বলেছি। উনি বললেন, আমি এমডিকে বলে দিচ্ছি। এমডি সাহেব সেদিক ডেকে নিয়ে বলল, আপনাদের বেতনের বিষয়ে চেয়ারম্যান সাহেবকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি দেখছি কি করা যায়। আর তাকে কেনই বা বলেন, বুঝি না! তাকে বললে কি সমাধান হবে?
নুরুজ্জামান বলল, বিপদের সময় যদি বেতনটাও ঠিকমতো না দেওয়া যায়!
দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে আসিফ আহমেদ বললেন, হুম। আচ্ছা, তুমি তাহলে যাও। চেষ্টা কর। সর্বোচ্চ চেষ্টা কর। আমরা দেখি কতদূর কি করতে পারি।
জি। ঠিক আছে।
নুরুজ্জামান চলে যেতে না যেতেই প্রশাসন বিভাগের রাকিব এসে বলল, স্যার এমডি স্যার নাকি বলছে, করোনার মধ্যে যারা অফিস করে না; তাদের বেতন কাটতে!
কে বলেছে তোমাকে?
স্যার, অ্যাকাউন্টস থেকে বলছে।
কি বলেছে?
বলেছে, করোনাকালীন কে কয়দিন অফিস করেছে তার তালিকা দেন। বেতন হওয়ার আগেই দিতে হবে।
আমরা তো অনেককে বাসা থেকে অফিস (হোম অফিস) করার জন্য বলেছি। তারা বাসায় থেকে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাচ্ছে। অনলাইনে সাপোর্ট দিচ্ছে। তাদের কি হবে? আমাদের লোকবল তো এমনিতেই কম। করোনার মধ্যে প্রতিদিন পত্রিকাটা বের করতে হয়। কাজ না করলে কিভাবে বের হয়? করোনার মধ্যে সবাই কষ্ট করে অফিসে আসে। আমরা কাউকে গাড়ি সাপোর্টও ঠিকমতো দিতে পারি না।
জি স্যার। রাকিব বলল।
তুমি বলো, আমাদের সবাই অফিস করছে। অফিসের নির্দেশেই অনেকে বাসা থেকে অফিস করছে। কারণ, সবাইকে অফিসে টেনে আনলে আরও বিপজ্জনক কিছু ঘটলে পত্রিকা বের করাই সম্ভব হবে না। আর ওরা আমার সঙ্গে কেন কথা বলে না?
স্যার, আমি বলেছি আপনার সঙ্গে কথা বলতে।
ঠিক আছে তুমি যাও।
রাকিব চলে যাওয়ার পর আসিফ আহমেদ আয়-ব্যয়ের হিসাবের ফাইলে চোখ রাখে। আর কোন কোন খাত থেকে খরচ কমানো যায় তা ভালো করে দেখে। পত্রিকার প্রেস, হিসাব বিভাগ এবং সাধারণ বিভাগে লোকবল অনেক বেশি। সেখানে বাড়তি প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা খরচ হয়। এই খরচের কথা মুখে আনা যায় না। তা ছাড়া প্রতিমাসে গ্রুপের বিজ্ঞাপন বাবদ বিশ থেকে পঁচিশ লাখ টাকার বিল হয়। ওই বিলও প্রতি মাসে পাওয়া যায় না। ওই বিষয় নিয়ে কথা বলাই মানা। তার মানে ন্যূনতম ষাট লাখ টাকা বাড়তি খরচের বোঝা!
আসিফ আহমেদ মনে মনে ভাবেন, কেন এই খরচের বোঝা আমি বহন করব? কেন আমাকে বলা হবে, লোক কমাও লোক কমাও! এই এক গীত তো শুরু থেকেই শুনে আসছি। কত লোক চলে গেল! নতুন লোক তার পরিবর্তে কয়জন নেওয়া হয়েছে? লোক না থাকলে পত্রিকা বের করব কাদের দিয়ে? ভালো পত্রিকা বানাতে চাই ভালো লোক। পত্রিকা চাইবে প্রথম আলোর মতো! আর লোক দেবে মানবকণ্ঠের মতো! তাহলে ভালো পত্রিকা কীভাবে হবে?
আরেকটা বিষয় আসিফের মাথায় ঘুরপাক খায়। পত্রিকার মালিকরা পত্রিকা বের করার সময় বলেন, আমি ভাই প্রথম আলোর মতো একটা পত্রিকা চাই। কিন্তু প্রথম আলোর মালিকের মতো আমরা হতে পারব না। ওটা সম্ভব নয়। আমরা পত্রিকা চালাব আমাদের মতো করে। আপনারা আমাদের নির্দেশ মোতাবেক পত্রিকা করবেন। ভালো পত্রিকা করার জন্য যে পেশাদার লোক লাগে সেটাও তারা বুঝতে চান না। অথচ প্রতিদিন প্রথম আলোর সঙ্গে তুলনা করেন। কথায় কথায় বলেন, ওরা পারলে আপনারা কেন পারছেন না?
আসিফ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, দিনের পর দিন আপোস করবেন না তিনি। কিছুতেই তিনি মেরুদণ্ডহীন প্রাণীতে পরিণত হবেন না। নিজের নীতি-নৈতিকতা, সত্ত্বাকে তিনি বিকিয়ে দেবেন না। সম্পাদকগিরিই তার কাছে বড় নয়। বড় হচ্ছে মানবিকতা। একজন মানুষ মানবিক না হলে সে আর মানুষ থাকে না। নিজের স্বার্থে সেই মানবিকতা তিনি জলাঞ্জলি দেবেন না। সবকিছু জলাঞ্জলি দেওয়া যায় না। তাহলে আর কিছু থাকে না।
আসিফ আহমেদের ভাবনাগুলো মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তার মোবাইলে ফোন আসে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখেন, এমডি সাহেবের ফোন। ফোন তুলে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল অচেনা এক কণ্ঠস্বর। আসিফ ভাবে, এটা তো এমডি সাহেবের কণ্ঠস্বর নয়! দুদিন আগেও তার কণ্ঠস্বর এমন ছিল না। তার মানে কী!
শাহবাজ খান রাশভারী কণ্ঠে বললেন, আমি শাহবাজ খান বলছি। তালিকা বানিয়েছেন? ছাঁটাইয়ের তালিকা! বুঝতে পারছেন? তালিকাটা নিয়ে কালই আমার সঙ্গে দেখা করেন। বেতন পারপাস কত যেন কমাতে বলেছিলাম? মনে আছে নিশ্চয়ই। অ্যাকাউন্টস নিয়ে বসেন। ভালো করে হিসেব কষে তালিকাটা বানান। আমি কালই তালিকাটা চাই।
কথা বলা শেষ করে শাহবাজ খান ফোন কেটে দিলেন। আসিফ আহমেদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। হতাশায় ডুবে যান তিনি।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/