ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৭
বিষাদ বসুধা
মোহিনী অফিসে চলে যান। আনোয়ারা বেগম মোহিনীর শোবার ঘর গোছগাছ করে রাখেন। কাজের লোক দিয়ে ভালো করে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করান। বিকেলে মোহসীন আহমেদ বাসায় এসে জানতে পারেন যে, মোহিনী নিজের বাসা ছেড়ে চলে এসেছে। তখন তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে বলেন, সে কি! ও চলে এসেছে মানে! কেন চলে এসেছে? ওদের কি কোনো সমস্যা হয়েছে?
আনোয়ারা বেগম তাকে জানান, আরেফিন বিদেশে গেছে। বিদেশে যাওয়া নিয়ে সম্ভবত ওদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়েছে।
বলো কি! আমি আগেই বলেছিলাম, ওই ছেলের সঙ্গে মোহিনীর বনিবনা হবে না। ওই ছেলের মনমানসিকতা সুবিধার মনে হয়নি। কেন যে ছেলেটাকে মোহিনী পছন্দ করল!
আনোয়ারা বেগম বললেন, তুমি আবার এসব কথা মোহিনীর সামনে বোলো না। ওকে বুঝতেও দিও না তুমি কিছু জানো।
না না। তুমি পাগল হয়েছ! আচ্ছা, মোহিনী কখন ফিরবে?
সন্ধ্যার মধ্যেই হয়তো ফিরে আসবে। তুমি চলো তো, আমরা বাজার করে আসি। মাছ, মাংস, তরিতরকারি কিছু নিয়ে আসি।
বাসায় এলাম। চা খাওয়াবে না?
হ্যাঁ। চা খেয়েই যাবো। তুমি ড্রেস পরিবর্তন করবে না? এই ড্রেসেই যাবে?
আমি অন্য ড্রেস পরে আসছি।
মোহসীন আহমেদ নিজের ঘরে যান। আনোয়ারা বেগম হালিমাকে ডাকেন। তাকে চা নাশতা টেবিলে দেয়ার জন্য বলেন। হালিমা তড়িঘড়ি করে টেবিলে নাশতা দেয়। চা দিয়ে বলে, খালাম্মা টেবিলে নাশতা দিছি। তাড়াতাড়ি আহেন।
আনোয়ারা বেগম খাবার টেবিলে গিয়ে বসেন। তিনি হাফপ্লেটে নাশতা বেড়ে মোহসীন আহমেদকে ডাকেন। তোমার হয়েছে? তাড়াতাড়ি আসো। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
মোহসীন আহমেদ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন। চেয়ার টেনে বসেই নাশতা খাওয়া শুরু করলেন। স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি খাচ্ছো না?
আমি শুধু চা খাবো।
কেন?
আমি ডায়েটে আছি।
এই বুড়ো বয়সে আর ডায়েট করে কি হবে?
এই! তুমি আমাকে বুড়ো বললে কেন? আমি কি বুড়ো হয়ে গেছি?
না না! এখনো তরুণীই আছো। হা হা হা!
নাহ! তোমার হাসিটা ভালো লাগছে না।
সিরিয়াসলি বলছি, ডায়েট করে তুমি বয়স কমিয়ে ফেলেছ।
ফেলতেই হবে। তা না হলে তো চলবে না। কি বলো?
হুম। কথাটা মন্দ বলোনি।
জানি তো! পুরুষ জাতিকে আমার চিনতে বাকি নেই। তারা সব সময় তাদের স্ত্রীদের তরুণী দেখতে চায়। কি ঠিক না?
নিজের স্ত্রীকে তরুণী দেখতে চাওয়া নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ নয়। যদি এমন হতো যে তরুণী বিয়ে করার জন্য পাগল হতাশ তাহলে বলতে পারতে।
আনোয়ারা বেগম চোখ বড় করে মোহসীন আহমেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার সাহস তো কম না!
মোহসীন আহমেদ হাসলেন। তারপর বললেন, চলো এবার বাজারে চলো।
আনোয়ারা বেগম মোহসীন আহমেদের পেছনে পেছনে এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গুলশান দুই থেকে ইউনিমার্ট বেশি দূরে নয়। ইউনিমার্টে ঘুরে ঘুরে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনলেন। মোহিনীর পছন্দের বিভিন্ন মাছ, দেশি মুরগী এবং খাসির মাংস কিনলেন। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ততক্ষণে মোহিনীও বাসায় এসে হাজির হয়েছে। তাকে দেখে মোহসীন আহমেদ ভীষণ খুশি। তিনি মহা উচ্ছ¡াসের সঙ্গে বললেন, আমার আম্মু যে!
কেমন আছো মামনি?
আমি ভালো আছি বাবা। তুমি কেমন আছো?
আমিও ভালো আছি। চীনের খবর শুনে তো মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।
কেন বাবা? চীনের কি খবর শুনেছ?
আমাদের তো কিছু ব্যবসা আছে চীনের সঙ্গে তুই জানিস সেটা। কয়েকজন চীনা নাগরিক আমাদের সঙ্গে কাজও করে। ওরা জানাল, চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে নভেল করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। বেশ কিছু মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।
মোহিনী বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, তাই নাকি!
হুম। ভাইরাসটি প্রাণী থেকে মানবদেহে ঢুকেছে। একে বলা হচ্ছে কভিড-১৯; বা করোনা ভাইরাস। এটি মারাত্মক ছোঁয়াচে। এই ভাইরাস বহনকারী আরেকজনের কাছাকাছি গেলেই সংক্রামিত হবে। তাকে ছোঁয়ারও দরকার নেই। কাজেই একজন মানুষের কাছ থেকে হাজার জনে ছড়িয়ে যেতে পারে। ভয়ঙ্কর। উহান শহরে বাংলাদেশের মানুষের ব্যাপক যাতায়াত আছে। আবার ওখান থেকে এখানেও বিপুল সংখ্যক চীনা কাজ করছে। ফলে আমাদের দেশে ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তাছাড়া আমাদের দেশের সংস্কৃতি হচ্ছে, করমর্দন, কোলাকুলি। একজন আরেকজনের সঙ্গে করমর্দন না করে পারেই না! এভাবেই বেশি ছড়াবে। কারণ, কে করোনা বহন করছে তা তো কেউ জানতে পারছে না। অজানা ভাইরাস। অজানা আতঙ্ক।
কথাগুলো শুনে মোহিনী যেন নিভে গেলেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, আরেফিন তো উহান শহরেই গেছে। ওর কি হবে? কি কি ভালো আছে? ওখানে যাওয়ার পর কিছুই তো জানাল না। হয়তো দুএকদিনের মধ্যেই জানা যাবে। ও যে কেন আমার কথা শুনল না? নিজে যা বোঝে তাই করে। আমার কথার কোনো মূল্য নেই ওর কাছে। ও যদি আক্রান্ত হয়।
মোহিনীকে চুপ থাকতে দেখে মোহসীন আহমেদ বললেন, কিরে মা, কি ভাবছিস?
মোহিনী দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, না বাবা। কিছু না।
মোহিনী মন খারাপ করে নিজের কক্ষের দিকে গেলেন। তার মন খারাপ দেখে মোহসীন আহমেদ চিন্তায় পড়লেন। মনে মনে বললেন, মেয়েটার আবার কী হলো!
রাতে মা বাবার সঙ্গে খেতে বসেন মোহিনী। মোহিনীকে আনোয়ারা বেগম খাবার তুলে দেন। মোহসীন আহমেদকেও তুলে দিয়েছেন। মোহসীন আহমেদ খাওয়া শুরু করেছেন। কিন্তু মোহিনী খাচ্ছেন না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। তার সামনে যে খাবার দেয়া হয়েছে তাও সে টের পেয়েছে কি না সন্দেহ। মোহসীন আহমেদ মেয়ের দিকে তাকান। আনোয়ারা বেগমও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, মোহিনী শুরু কর না মা। কি এতো চিন্তা করছিস?
মোহসীন আহমেদও মোহিনীর কাছে তার মন খারাপের কারণ জানতে চান। তারপরও মোহিনীর ঘোর কাটছে না। নানারকম নেতিবাচক চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খায়। আরেফিন যদি ওখানে আক্রান্ত হয়! তাহলে তো মহাবিপদে পড়বে! কে দেখবে ওকে? ও তো আমার সঙ্গে একটু যোগাযোগ করতে পারে। আমাকে নিশ্চিন্ত করতে পারে। ও এমন কেন! আমার কিছু ভালো লাগে না।
মোহসীন আহমেদ আবারও মেয়েকে উদ্দেশ করে বলেন, হ্যা রে মা! কি হয়েছে তোর?
বাবা, চীনের উহানে যেখানে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি; আরেফিন সেখানেই তো গেছে। ওর যে কি অবস্থা খোদা তায়ালাই জানেন। আমি এতো করে বললাম, যেও না। আমার কথা শুনল না। এখন কি হবে?
হুম। আমিও বিষয়টা নিয়ে ভাবছি। গভীরভাবে ভাবছি। ওখানে করোনাভাইরাস যেভাবে ছড়িয়েছে! মাই গড! আচ্ছা, আরেফিন কি টেলিফোন করে? তোর সঙ্গে কোনো কথাবার্তা হয়?
মোহিনী চুপ করে আছেন। তিনি কী বলবেন? কোনো রকম কথাবার্তা তো হয় না। আরেফিন মোহিনীকে একটা ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। সেই নম্বরে একবারও মোহিনী তাকে পাননি। আরেফিন ফোন দিলেও দুদিন পর হয়তো একবার দুই মিনিটের জন্য ফোন করেন। মোহিনীকে চুপ থাকতে দেখে মোহসীন আহমেদ বললেন, তার মানে তোকেও সে ফোন করে না? এটা কি কোনো কথা হলো?
আনোয়ারা বেগম বললেন, আসলে ছেলেটা এতো বেশি আত্মকেন্দ্রিক এবং আত্মবিমুখ; ওকে ঠিক বুঝতে পারি না। মোহিনী ওকে কতটুকু চিনেছে জানি না। তবে ওকে চেনা খুব সহজ ব্যাপারও নয়।
মোহিনী চুপ করেই আছেন। কোনো কথা বলছেন না। তিনি যে দ্রুত খেয়ে উঠবেন তাও পারছেন না। খাবার যেন ওর গলা দিয়ে নামছে না। অল্প করে ভাত মুখে দিয়ে এপাশ ওপাশ করেন। দাঁতের শক্তিও যেন হ্রাস পেয়েছে। মাঝেমধ্যে পানি দিয়ে গিলে ফেলেন।
মোহিনীর অবস্থা দেখে দুশ্চিন্তায় পড়েন মোহসীন আহমেদ ও আনোয়ারা বেগম। তারা উভয়েই মোহিনীকে নিয়ে ভাবেন। এক পর্যায়ে পরিস্থিতিটা অন্য দিকে নেয়ার জন্য মোহসীন আহমেদ বলেন, একটা ভালো ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। মোহিনী ওর ব্যবসায় বেশ মনোযোগ দিয়েছে। মনোযোগটা আরো বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।
তোমাকে এই খবর কে দিল বাবা? মোহিনী জানতে চাইলেন।
মোহসীন আহমেদ হাসলেন। তিনি যে ধারনা করে কথাটা বললেন তা প্রকাশ না করে বললেন, তোর অফিসের লোকজনই আমাকে জানালো।
বাহ! তাহলে তো খুব ভালো খবর! আনোয়ারা বেগম বললেন।
মোহিনী বললেন, আমি সত্যি সত্যিই মনোযোগ বাড়াতে চাচ্ছি। কিন্তু পারছি না। বার বার আরেফিনের কথা মনে পড়ে। ওর জন্য খুব খারাপ লাগছে। ওর যদি কিছু হয়ে যায়!
মোহসীন আহমেদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, আসলে জীবনে একবার ভুল করলে তার মাশুল সারাজীবন দিতে হয়। মোহিনী নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পেরেছে যে, ও কী ভুল করেছে! তুমি ওর সঙ্গে বেশি বেশি গল্প কোরো। ওকে সময় দাও।
আমি চেষ্টা করছি। নানাভাবে ব্যস্ত থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়!
খাওয়া শেষ করে মোহসীন আহমেদ নিজের ঘরে গিয়ে টিভি দেখেন। টিভিতে উহানের খবর দেখে মেয়েকে ডাকেন। মোহিনী, মোহিনী!
মোহিনী দৌড়ে এসে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেন, কি বাবা! কি হয়েছে!
দেখ দেখ! টিভিতে উহানের খবর দেখাচ্ছে। প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ার কথা বলা হচ্ছে। আমাদের দেশেও করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষের যাতায়াত!
শুধু বাংলাদেশের কেন বলছ বাবা! সারা দুনিয়ার সঙ্গে চীনের যে যোগাযোগ তাতে এই ভাইরাস সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। শুনলাম, ভাইরাসটা ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে। একজন মানুষ যদি হাজার মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে তাহলে এর ভয়াবহতা তো সহজেই বোঝা যায়! এই গ্রহের কোনো দেশ আর বাদ থাকবে না!
বিস্ময় আর হতাশার সঙ্গে আনোয়ারা বেগম বললেন, হায় হায়! একটা ভাইরাস এতো ভয়ঙ্কর! মোহসীন আহমেদ বললেন, হুম। বড় বিপদ আমাদের সামনে। এখনই দেখছ না! বাজারে আগুন! হঠাৎ হঠাৎ বাজার থেকে চাল উধাও! ডাল উধাও! লবন উধাও! আরো কত কী! সুযোগ পেলেই কিছু কুলাঙ্গার ব্যবসায়ী জোট বেঁধে বাজারে শর্টফল করে। ওমনি শুরু হয় নাই নাই! আর মানুষ হাহাকার করতে থাকে। করোনায় যে কত মানুষকে বিপদে ফেলবে তা ভেবে আমার মাথা খারাপ অবস্থা!
আনোয়ারা বেগম ও মোহিনীর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
চলবে..
আরও পড়ুন