ফরিদ কবির
প্রিয় ১০ কবিতা
সাপ-লুডু
সাপ-লুডু বেশ বিপজ্জনক!
খেলতে গেলেই দেখি, সাপগুলি জ্যান্ত হয়ে যায়
ছোবলের ভয়ে আমি লুডুর এ-ঘর থেকে অন্য ঘরে
ক্রমাগত ছুটতে থাকি!
ওপরে যাওয়ার জন্য মইগুলি খুঁজি
একটু আগেও পড়ে ছিল, যত্রতত্র
কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেউ একজন
সিঁড়িগুলি সরিয়ে ফেলেছো
আমি যে ধরবো, নেই তেমন একটা হাতও
অথচ পাশেই ছিলে তুমি
অথবা তোমার মতো অন্য কেউ!
সাপগুলি আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলেছে চারপাশ থেকে
আর, আমি ছোবল খাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকি!
আয়না
আমি দেখি?
নাকি আয়নাই আমাকে দেখায়?
নিজেকেই দেখছি হয়তো
যদিও সামনে যাকে দেখি—দেখতে আমারই মতো
কিন্তু আমি নই
কেননা, আমি তো মৃত
বিধ্বস্ত আমার মুখ, ভয় দুই চোখের পাতায়
আয়না রহস্যময়, ভার্চুয়াল আরেক দুনিয়া
সেখানে আমার বিম্ব বরাবর ঝকঝকে, জীবন্ত
বরং কিছুটা স্মার্ট
যেমন আজ সে বাইরে এসেই
আমাকে পাঠিয়ে দিল আয়নার ভেতরে
আয়নার ওপাশে ভয়ানক অন্ধকার
অথচ এপাশ থেকে সব সময় উজ্জ্বল দেখায়!
ফুল
ঘ্রাণেই সম্পূর্ণ স্নান, তবু খোঁজো তুমি জল-সাবানের ফেনা
কী আছে রোমাঞ্চ স্নানঘরে
চামড়ার নিচে যদি রয়ে যায় অন্ধকার
আর, কালো ময়লার স্তূপ
সহস্র বুদবুদ থেকে ফিরে
কিভাবে নিজেকে ভাবো তুমি শতভাগ পরিষ্কার
যে-কারণে বলি, ফুলই প্রকৃত সমুদ্র
কেননা, তাকেই আমি ঘ্রাণসহ বর্ণিল রেখেছি
কাঁটার সংঘাতে যদি ঝরে কিছু রক্তের গরম
তুমি কাটো সাঁতার গোলাপে
আর, পাপড়ির বর্ণে করো জন্মোৎসব
আজ বলি, ঘ্রাণের জন্যই
এতকাল পুষ্পপূজা নিষিদ্ধ করিনি!
পাখি
উড়লেই পতনের ডাক, তবু উড়ে যাও
তুমি পাখি ভাবছো নিজেকে
মাটি দখলের পর রক্তচিহ্ন এখনো ডানায়
আজকে নেমেছো তুমি আকাশ দখলে
শিরোস্ত্রাণে হেসে উঠছে নক্ষত্রমণ্ডলী
আকাশকে পাখিমুক্ত রেখে তুমি কেবল ঘুমোবে
আর, জেগে উঠে প্লাস্টিকের স্বপ্ন সাজাবে টেবিলে
প্রকৃত তোমার স্বপ্ন এতকাল পাখিরাই বহন করেছে
নিজেকে যতই ভাবো দীর্ঘ, আজ বলি—
পাখিদের চোখে তুমি সর্বদাই ছোট
নিজেকে জানার জন্য মাঝে-মধ্যে তোমার বাড়িতে
তাদেরকে নিমন্ত্রণ কোরো!
নদী
নদীকে সরিয়ে দিয়ে তুমি বিছিয়ে দিয়েছো রাস্তা
যত দূর দৃষ্টি যায় মাইল-মাইল ধুধু পথ
গাড়ি চলছে পালতোলা নৌকোর বদলে
এখন খুঁজছো ঢেউ, নদীকুল রাস্তায় রাস্তায়
কে না জানে পথের মহিমা
পথই মানুষকে নিয়ে যেতে পারে যে-কোনো রাস্তায়
এখন পথের সব পৃষ্ঠা বসে বসে মুখস্থ করছো
সন্ধান করছো নদীতীর, ঢেউয়ের আক্ষেপ
রাস্তা চেনে সব পথ, যেতে পারে যে-কোনো ঠিকানায়
নদীর ঠিকানা শুধু জানা নেই তার
এখন রাস্তায় বসে কাঁদো ঢেউয়ের আশায়!
পাতা
গাছের নিঃশ্বাস আটকে আছে
আজ তার মৃত্যু ঠেকাবে কে?
সমস্ত শরীর তার কেঁপে উঠছে পাতার সন্ত্রাসে!
তাকে ঘিরে আছ তুমি চারপাশ থেকে
শুষে নিচ্ছ রোদের উত্তাপ
তীব্র ঝড়ও থমকে গেছে তোমার ইঙ্গিতে
এখন বুঝতে পারি, গাছ নয়, পাতাই আসল
সমস্ত গাছের নাম লেখা আছে পাতার সবুজে!
ঘ্রাণ
তোমার ঘ্রাণেও আছে আলাদা সৌন্দর্য
সামান্য কথার পর সমুদ্র-দূরত্বও যেন নিমিষে উধাও
আর, সেই ঘ্রাণ এসে মিশে যায় আমার শরীরে
দ্বৈত গন্ধ নিয়ে আমি উন্মাতাল
যেন এইমাত্র শেষ হলো সম্পূর্ণ সঙ্গম
তোমার রঙিন ঘ্রাণ টের পায় এত দূরে গাছের পাতাও
আজ বুঝি—রূপে নয়, ঘ্রাণে আছে সকল রহস্য
এর টানে ফুলের কাছেই
বারবার ফিরে যায় সকল মৌমাছি
নিজেকেও মৌমাছি বলেই মনে হচ্ছে আজ
ঘ্রাণ থেকে খুলে নিচ্ছি অসামান্য মধু!
খুন
করো চলাফেরা ধমনিতে, উপশিরায়, শিরায়
এই স্রোত চলুক নির্জনে
আমাকে রঞ্জিত করে আপাদমস্তক তুমি বয়ে চলো
টগবগ ফুটতে থাকো হৃদয়ে, মস্তিস্কে
আমাকে পুড়িয়ে দাও তোমার গরমে
বলো, কেন হলে তুমি এতটা আগ্রাসী!
মিশে যাচ্ছ রক্তের প্রচণ্ড লালে, শুভ্র কণিকায়
ছুটে যাচ্ছ শরীরের আনাচে-কানাচে!
তোমাকে ছিনিয়ে নিতে এখন তৎপর
ভয়ঙ্কর আলপিন, ঘাতক ছুরিও…
গোপনে তোমাকে বলি—
তোমার একটা ফোঁটাও আমি কাউকে দেব না!
স্পর্শ
স্পর্শ এক অদ্ভুত ভ্রমণ
নৈকট্য লাগে না
সমুদ্রের এপার থেকেও পাওয়া যায়
হুবহু বাতাস, ওপারের
পড়ে নেয়া যায় আদ্যোপান্ত
আকাশের সাতটি পৃষ্ঠাই
কী করে এমন হয় বলো—
স্পর্শ করি, তোমাকে না ছুঁয়েই!
এলোমেলো করে দেই
শরীরের স্বাভাবিক ঢেউ
তোমাকে স্পর্শের পর মনে হয়
শরীরের এক শো সাতটি গলি
ঘুরে দেখা সম্পন্ন করেছি!
শরীর
বন্দি নয়, তোর হাত নিজে এসে আশ্রয় নিয়েছে
এই করতলে
তোর কাছে নিরাপদ নয় কোনো কিছু
তোর হাত, হাতের আঙুল
সামান্য যে গাছ, সেও অরক্ষিত রাখে না পাতাকে
তুলে ধরে যতটা সম্ভব শূন্যে, স্পর্শের বাইরে
যে কারণে পাতা থাকে নিতান্ত সবুজ
স্পর্শাতীত কিছু নেই তোর
যে রকম হাতের ইশারা বুঝে তোর হাত
ঢুকে পড়ে আমার মুঠোয়
কথা হয় আঙুলে আঙুলে
শরীরও যথেষ্ট জ্ঞানী তোর
ভাষা বোঝে আরেক দেহের!