একাত্তরের শরণার্থীরা কেন মুক্তিযোদ্ধা নয়

আমি মুক্তিযুদ্ধের জন্য এতো ত্যাগ স্বীকার করলাম, ভাই হারালাম,মা মেয়ে হারালাম, তিনমাস বয়সী নাতনি হারালাম, দেশের বাড়িঘর, গরু, ছাগল, ধান, মাছ, গাছ, সহায় সম্পত্তি সব হারালাম। নিঃস্ব হলাম। ক্যাম্পে যেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করলাম। বিশ্ববিবেককে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করলাম। মুক্তিযুদ্ধের জন্য এতো কিছু ত্যাগ করলাম। নিজে নিঃস্ব হলাম। তবুও আমি কেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত হতে পারব না। কেন এই লাইনে আমার দাঁড়ানোর অধিকার নেই।
কথাগুলো বলছিলেন দক্ষিণবঙ্গের শেষ প্রান্তের গ্রাম জেলেখালি চান্নির চক এর মুক্তিযুদ্ধের জন্য সব হারানো একজন মানুষ সুরেন বাবু। সুরেন বাবু ছিলেন ঐ গ্রামের একজন জমিজমাওয়ালা বিত্তশালী ও প্রভাব প্রতিপত্তিশালী লোক। হিন্দু মুসলিম অধ্যুষিত বড় গ্রামের বিচার শালিসেও তিনি থাকতেন প্রধান ভূমিকায়। হিন্দু মুসলিম সবাই তাকছ শ্রদ্ধা করতো। তার ছোট ভাই নগেন বাবুও ছিল স্থানীয় ব্যবসায়ী ও এলাকার প্রভাবশালী। এলাকায় দুই ভাইয়ের প্রভাব প্রতিপত্তি ও মানুষের প্রতি আন্তরিক ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট সুনাম ছিল। সবাই তাদের ভালোবাসতো।
তখনও তাদের ছিল যৌথ পরিবার। দুইভাইয়েরই ছেলে মেয়ে বিয়ে দিয়েছে। পরিবারে সদস্য ও কৃষাণ-মাহিন্দার, ঝি-চাকরসহ বাড়িতে প্রায় ২৫ /৩০ জন লোক। তরপর তো আত্মীয়-স্বজন, অতিথি লেগেই আছে। প্রতি ওয়াক্তে সবমিলিয়ে প্রায় ৪০/৫০ জন লোকের রান্না হতো। তাদের পরিবারকে ছোটখাটো একটা মজলিস বাড়ি বললেও অত্যুক্তি হবে না।
প্রায় ৮০ বিঘার মতো পৈত্রিক ধানী জমি। ৩ বিঘার উপর বিশাল বাড়ি। এক বিঘার উপর বিরাট পুকুর। পুকুর ভরা মাছ। গোয়াল ভরা ৩০/৩২ টা গরু। ৭/৮ টা দুধের গাভি। উঠানে ২/৩ টা গোলায় ভর্তি ধান। গ্রামের অভিজাত পরিবার বলতে যা বোঝায় তা তারা।
তখন দেশে চলছে একটা অরাজক অবস্থা। সুরেণ বাবু সবসময় দেশকে নিয়ে ভাবতো। তার এমনি ভাব ছিল যে, দেশের ভালোর জন্য সে সব বিলিয়ে দিতে পারে।
এসে গেল ১৯৭১ সাল। দেশে শুরু হলো স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন। হটাও পাক বাঁচাও দেশ শ্লোগানে মুখর হলো সারা বাংলা। ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিলেন "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। তোমাদের যার যা আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো"।
ভাষণটি সুরেণ বাবুর পরিবার মনোযোগ দিয়ে রেডিওতে শুনলেন এবং মানসিকভাবে যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিলেন।
২৫ শে মার্চ কালো রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার আগেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন। ২৬ শে মার্চ ঘোষণাপত্রটি বঙ্গবন্ধু্র পক্ষে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন জন পাঠ করলো। সেটাও সুরেণ বাবু শুনলেন।
শুরু হয়ে গেল স্বাধীনতা যুদ্ধ।
গ্রামে গ্রামে গঠিত হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর কমিটি। সুরেণ বাবু তার নিজ গ্রামের মুক্তিবাহিনীর প্রধান হলেন । যুদ্ধে যাওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। কিন্তু বাধ সাধল গ্রামের কিছু পাকিস্তানি দোসর মুসলিম রাজাকার, আলবদর, আল শামসরা। তারা সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ির উপর এসে বিভিন্ন হুমকি ধামকি দিতে লাগলো। বৌ, মা-বোনদের তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিলো। লুটপাট, ছিনতাই ও বাড়িঘরদোর জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিলো।
ভয় পেয়ে গেল হিন্দুরা। তারা জন্মভিটা ছেড়ে
শরনার্থী হয়ে পার্শ্ববর্তি দেশ ভারতে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
অগত্যা পরিবারের কথা ভেবে সুরেণ বাবুও সেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন।
সুরেন বাবু যখন সিদ্ধান্ত নিলেন তার পরিবার নিয়ে ভারতে শরণার্থী হবে তখন তার গরুবাছুড় সহায় সম্পদ স্থানীয় চেয়ারম্যান ঘনিষ্ঠ বন্ধু সৈয়দ সানার হেফাজতে রাখার চিন্তা করলেন।
সেই মোতাবেক সৈয়দ সানার কাছে যেয়ে বললেন, দেখে বন্ধু আজ সময়ের বড় বেরহম। নিজের জন্মভিটা, জন্মভূমি, জন্মমাটি ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে পরবাসে। জানিনা ভাগ্যে কি আছে? আমার এই গরু বাছুড়, সহায় সম্পদ, বাড়িঘর সব তোমার হেফাজতে রেখে গেলাম। দেখো!
যদি কখনও দেশ স্বাধীন হয় আর বেঁচে ফিরে আসতে পারি, সেদিন আবার দেখা হবে।
তারপর জন্মভিটের একদলা মাটি নিয়ে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে নিজের কপালে তিলক এঁকে দিলো। বললো হে মাটি তোমাকে ছেড়ে চললাম নিরুদ্দেশে। যদি বেঁচে থাকি আর যদি ভাগ্য সহায় হয় আবার ফিরে আসব।
সব ফেলে নিঃস্ব হয়ে পাড়ি জমালেন ভারতের উদ্দেশ্যে।
বাড়ির সকল সদস্যকে তুলে দিলেন নৌকায়। আর তারা দুইভাই তাদের বোন ও বোনজামাইকে সাথে নেওয়ার জন্য গেলেন ডাঙাপথে। কিছুদুর যেতেই পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়লো দুই ভাই। ব্রাশফায়ারের জন্য অন্যদের সাথে দুজনকেও লাইনে দাঁড় করিয়ে দিলো।
সুরেন বাবু সেখান থেকে কোনোমতে পালিয়ে বেঁচে গেলেও ছোট ভাই নগেন বাবু আর পালাতে পারলো না। পাক আর্মিদের ব্রাশফায়ারে শহীদ হলো সে।
সুরেন বাবু কোনোমতে বেঁচে পরিবারের সাথে নৌকায় যোগ দিলো। সেদিন শরণার্থীদের পদে পদে ছিলো বিপদ।
কিছু দুর যেতেই এবার আবার নৌকাসহ পাক আর্মিদের আক্রমণে পড়লো। পাকদের তাড়া খেয়ে নৌকা থেকে যে যার মতো ছুটে পালালো। সুরেন বাবুর বড় পুত্রবধূ ভয়ে দৌড়াতে গিয়ে কোঁচড় থেকে তিন মাসের শিশু কন্যাটি কখন যে পড়ে গেল ঠিক পেলো না। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে কিন্তু আর পাওয়া যায়নি।
পুত্রবধূটি পাগলির মতো কাঁদতে কাঁদতে চললো তাদের সাথে।
অবশেষে অনেক কষ্টে যেয়ে পৌঁছালো শরণার্থী শিবিরে।
অস্থায়ী একটা তাঁবুতে স্থান হলো তার পরিবারের। ঘিঞ্চি পরিবেশ। শুধু লোক আর লোক। কেউ তাঁবু খাটিয়ে, কেউ একচালা টিনের ছাবড়া বানিয়ে, কেউ কেউ স্কুল কলেজের বারান্দায়, কেউবা সিমেন্টের বড় পাইপের মধ্যে অবস্থান নিয়েছে।
ঘন জনসমাগমে তৈরি হয়েছে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বস্তির চেয়েও খারাপ অবস্থা।
নেই কোনো পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। একটা কাঁচা পায়খানায় শতাধিক লোক পায়খানা করছে। নেই স্নানের ব্যবস্থা। নদীর ময়লা নোংরা জলে পায়খানা ভাসছে সেই জলে সব ডুব মেরে স্নান করছে। খাওয়া দাওয়ার পরিবেশও অস্বাস্থ্যকরকর। রোগবালাই, মহামারী লেগে আছে। প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু বৃদ্ধ যুবা মারা যাচ্ছে বিভিন্ন রোগে।
এরমধ্যেই সুরেন বাবু পরিবার নিয়ে কোনোমতে দিনাতিপাত করছে। হঠাৎ আশ্রয়কেন্দ্রে কলেরা মহামারী আকার ধারণ করলো। তার মা ও বড় মেয়ে কলেরায় মারা গেল।
এতো কিছুর মাঝেও যারা এদেশ থেকে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে গিছিল সুরেন বাবু তাদের বিভিন্নভাবে সাধ্যমতো সহযোগিতা করলো। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিলো, খাবার ব্যবস্থা করলো, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে গেলো ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাইহোক নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলো। শরণার্থীরা সব দলে দলে দেশে ফিরে আসতে থাকলো। সুরেন বাবুও পরিবার নিয়ে দেশে ফিরে আসলেন।
বাড়িতে ফিরে এসে দেখলেন এক বিরাণভূমি। ধানের গোলাগুলি ভাঙাচোরা। তাতে নেই কোনো ধান। ঘরে আসবাবপত্রসহ কিচ্ছুটি নেই। একেবারে ফাঁকা। পুকুরে মাছ নেই। বাড়ির বড় বড় গাছগুলো সব কেটে নিয়ে গেছে। সৈয়দ সানার কাছে গরু চাইতে গেলে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ফিরিয়ে দিলো।
এখন তার পরিবার একেবার নিঃস্ব।
স্বাধীনতার কিছুদিনের মধ্যেই গ্রামে গ্রামে শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি।
মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম ওঠানোর জন্য সব লাইন দিলো।
সুরেন বাবুও সেই লাইনে দাঁড়িয়ে গেলেন।
চেয়ারম্যান সাহেব সুরেন বাবুর কাছে এসে প্রশ্ন করলেন,
তুমি লাইনে দাঁড়িয়েছো কেন? তুমি কি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলে?
সুরেন বাবুর স্পষ্ট জবাব, শুধু যারা যুদ্ধ করেছিল তারাই কি মুক্তিযোদ্ধা? যারা যুদ্ধে সহযোগিতা করেছিল তারা? স্বাধীনতাকে দ্রুত পাইয়ে দিতে যারা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল তারা? তারা কি মুক্তিযোদ্ধা নয়?
আচ্ছা চেয়ারম্যান সাহেব জানা আছে কি
সেসময় এই শরণার্থীরাই স্বাধীনতার জন্য বিশ্ববিবেককে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিল?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই শরণার্থীদের দুর্বিষহ জীবন বিবেচনা করে দ্রুত স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য বিশ্ব সংঘকে চাপ প্রয়োগ করেছিল।
আমি তো মনে করি এই শরণার্থীরাই অর্ধেক স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। স্বাধীনতার জন্য শরণার্থীদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তবুও কেন তারা মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবে না।
সেদিনের অনেক রাজাকার আলবদর আল শামসকে দেখছি মুখের খোলস বদলে এই লাইনে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা বনে যাচ্ছে।
অথচ আমি স্বাধীনতার জন্য এতো ত্যাগ করার পরও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারব না? কেন পারব না বলতে পারেন?
এই বলে আক্ষেপের সুরে উপরের কথাগুলো বলছিলেন সুরেণ বাবু।
এ কথাগুলো শুধু সুরেন বাবুর নয় এ কথাগুলো আমাদের সকলের। এ কথাগুলো বিশ্ব বিবেকের।
ডিএসএস/
