চিত্রাপাড়ের জোৎস্নায়
ফয়সালকে আজ সকালেই ধরে আনা হয়েছে। মেজর শওকতের রুমে এনে রাখা হয়েছে। মেজর শওকত তখন ঘুম থেকে নাস্তা করছিলেন। কয়েকজন সেনা তাকে মেজরের সামনে নিয়ে দাড় করায়। মেজর শওকত তার দিকে একবার তাকান। তারপর আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেন। খাওয়া শেষ করে তিনি ফয়সালের দিকে তাকান। যদিও তিনি বাংলা মোটামুটি জানেন, ফয়সালে সাথে মেজর শওকতের কথাবার্তা হলো ইংরেজিতে।
’তোমার নাম?’
’ফয়সাল।’
’শুধু ফয়সাল? পদবী-টদবী কিছু নেই?’
’যুদ্ধ শুরুর আগে মনে ছিল। এখন সেটা বলার প্রয়োজন মনে করছি না।’
’কেন?’
’জানিনা।’
’মিলিটারী দেখে ভয় পেয়েছো?”
একথা বলেই মেজর শওকত হাসতে থাকেন। ’তোমাদের বাঙালিদের বিচি খুব ছোট হয়। অল্পতেই ভয় পাও। প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে। এই যে তুমি আমার সামনে দাড়িয়ে আছো, তোমার পা ভয়ে কাঁপছে। দ্যাখো, প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলো না। তোমাকে কিছু করবো না। তোমাকে মারার জন্য আনা হয়নি। অন্তত যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবো এ গ্যারান্টি দিচ্ছি। মেজর শওকত যা বলে তা থেকে নড়চড় হয় না। তাছাড়া তোমার ইয়ে পরিস্কার করার মতো কেউ নেই এখানে।’ বলেই আবার জোরে জোরে হাসতে থাকেন মেজর শওকত।
’তুমি জানো তোমাকে কেন আনা হয়েছে?’
’না।’
’তুমি আমার দোভাষীর কাজ করবে। যাদের ধরে আনা হবে তাদের কথা বুঝিয়ে বলবে। মাসে মোটা বেতন পাবে। খাওয়া দাওয়া পাবে। আরও একটা কাজ করতে হবে মাঝে মধ্যে। আমাকে একটা করে ফ্রেশ মেয়ে দিতে হবে প্রতি রাতের জন্য। এর জন্য আলাদা বকশিশ পাবে। আমার পরে চাইলে তুমিও ওর সাথে কাটাতে পারো। আদারওয়াইজ তুমি এখন আমাদেরই লোক। দালালরা যাদের ধরে আনছে তারা ফ্রেশ না। অনেকে তো পাগল টাগলও সাপ্লাই দিচ্ছে। আমি অত খারাপ রুচির মানুষ না। আমার আরও ফ্রেশ দরকার। আমি নিজেও খুব ফ্রেশ মানুষ। আমার সাথে থাকলেই বুঝতে পারবে।’
’এখন বলো তুমি রাজী? যদিও এ প্রশ্ন তোমাকে করা অর্থহীন। কারণ তুমি রাজী না হলেও কাজ করতেই হবে। তোমার পরিবার আমাদের বন্দুকের নলের সামনে দাড়িয়ে। কোনো রকম গাঁইগুই করবে না।’
’আমি দোভাষীর কাজ করতে রাজী। কিন্তু ঐ মেয়ের ব্যাপার থেকে বাদ দিতে হবে।’
আচ্ছা এখন যাও। পরে দেখা যাবে। ফয়সাল মেজরের সামনে থেকে বেরিয়ে আসে। তাকে অন্য একটি রুমে নেওয়া হয়। এখানেই তার থাকার জায়গা করা হয়েছে। এটা একটা স্কুল ঘর। তাকে যে রুমে রাখা হয়েছে সেটি ক্লাস নাইনের বিজ্ঞান বিভাগের রুম। ফয়সাল এই ক্লাসেই ক্লাস করেছে। ফয়সালের গ্রামের নাম চিত্রাপুর। গ্রামের পাশ দিয়ে চিত্রা নদী বয়ে গেছে। নদীর নাম থেকেই গ্রামের নাম। ফয়সালের বাড়ি চিত্রা নদীর পাড়ে। এই স্কুলের নাম চিত্রাপুর উচ্চ বিদ্যালয়। এই স্কুলের হেডমাষ্টার সাধু নারায়ণ বাবুকে গ্রামের ঢোকার দিনই স্কুলেই গুলি করে মেরেছে। সেই সাথে স্কুলের হেডপন্ডিতকেও মেরেছে। ছাত্রছাত্রী ছিল না অনেক আগে থেকেই। কয়েকজন পুরাতন শিক্ষক আবেগ প্রবণ হয়ে স্কুলে এসে সময় কাটাতেন। হেডমাষ্টারের এ বছরই অবসর নেওয়ার কথা ছিল। অনেকেই বলেছিল ওপার চলে যেতে। হেডমাষ্টার সাহবের এক কথা, নিজের দেশ রেখে সে কোথাও যাবে না। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই রুমের সাথে। ওর ঘনিষ্ট বন্ধু মিজান,শহীদ,শাবু আর হিরেনের মধ্যে কেবল মিজান এখনো গ্রামেই আছে। বাকিরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে। ফয়সালেরও কিছুদিনের মধ্যেই যাওয়ার কথা। মাঝে অসুস্থ হওয়ায় যাওয়া হয়নি। ওকে দিয়ে পাকিস্তানীদের খবরাখবর সংগ্রহ করার কথা ছিল। এর মধ্যেই ওকে ধরে আনে। ফয়সাল দোভাষির কাজ করে যেতে লাগলো। যাদের ধরে এনে ক্যাম্পে নির্যাতন করা হতো তাদের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। এটা ছিল ফয়সালের জন্য জঘণ্য মানসিক নির্যাতন। একটা কাটারি মতো ধারালো অস্ত্র নিয়ে একজন দাড়িয়ে থাকতো। মেজরের ইশারা পেলেই একটা লোহার বাক্সে হাত ঢুকিয়ে এক কোপে কেটে ফেলা হতো। সেই সময় বন্দী যে তীব্র গগন বিদারী চিৎকার দিতো সেই চিৎকার দিন-রাত ফয়সালের কানে বাজতো। ওর ধারণা ওকে মানসিকভাবে নির্যাতন করার জন্যই এটা করতো। ওর সামনেই গ্রাম থেকে মেয়েদের এনে নির্যাতন করা হতো। ফয়সালের কিছুই করার ছিল না। গোপনে পালানোর সুযোগ খুঁজছিল। সেদিন রাতে ফয়সালকে ডেকে পাঠালো মেজর।
’হ্যালো ইয়ং ম্যান। হাউ আর ইউ?’
ফয়সাল কিছু না বলে চুপ করে থাকলো।
’তুমি শুধু প্রতিদিন মেয়েদের সাথে আমি কি করি সেটা দ্যাখো। আজ নিজেও আমার সাথে থাকতে হবে। তুমি স্বেচ্ছায় থাকবে না জানি। কিন্তু তোমাকে থাকতে হবে। কিছু না করো দেখবে। বসে বসে দেখবে। মজা পাবে। আর না হলে কি হবে সেটাও জানো। তোমার হাতের আঙুলগুলো নিশ্চয়ই হারাতে চাও না। ফয়সাল চুপ করে থাকে। ও বোঝার চেষ্টা করছে ঠিক কি ঘটতে যাচ্ছে। খারাপ কিছু যে ঘটছে সেটা বুঝতে পারছে কিন্তু সেটা কি সেটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু কতটা খারাপ তা বুঝতে পারলো একটু পরে। ওরা ফয়সালের বোন অরুকে ধরে এনেছে। অরুকে চেনা যাচ্ছে না। মনে হয় মারধর করেছে। ভালোভাবে তাকাতেও পারছে না। মুখ ফুলে আছে। ফয়সালের দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। তারপর মুখ নামিযে নেয়। ডুকরে কেঁদে ওঠে। সেই কান্নার শব্দ বের হয় না। ফয়সালের মুখের অবস্থা দেখেই মেজর বলে উঠলো, আমি জানি তুমি কি ভাবছো? কিন্তু তুমি কিছুই করতে পারবে না। আমি তোমাকে দোভাষির কাজ ছাড়াও একটা দায়িত্ব দিয়েছিলাম কিন্তু তুমি তা পালন করোনি। বলতে পারো তার শাস্তিস্বরুপ তোমার বোনকে এখানে আনা হয়েছে। এতদিন যাদের রেপ করেছি তাদের আর কেউ পাশে ছিল না। আমি দেখতে চাইছি যদি তারা সামনে থাকে তখন কি অনুভূতি হয়। বলেই মেজর হাসতে থাকে। তখন তাকে হায়েনার মতো দেখায়। ফয়সাল একদলা থু থু ফেলে। থু থু ফেলে লাভ নেই মিষ্টার ফয়সাল। তার আগে আমরা একসাথে ড্রিংকস করবো। সেই মদের গ্লাস সার্ভ করবে তুমি। আপত্তি আছে? ফয়সাল আপত্তি করে না। আপত্তি করার সুযোগও নেই। ফয়সাল মদের গ্লাস আনতে চলে যায়। এটাই সুযোগ অরুকে বাঁচানোর। তারপর মেজরের সাথে ড্রিংকস করতে বসে। মদ খাওয়া শেষে শেষ হলে দু’জন সৈনিককে ফয়সালকে চেয়ারে বেঁধে ফেলতে নির্দেশ দেয় মেজর। ওরা ফয়সালকে বেঁধে দেয়। অরুকে ছেড়ে ওরা বাইরে বেরিয়ে যায়। মেজর অরুর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
’মেজর শওকত?’
ফয়সালের ডাকে চমকে ওঠে মেজর। ঘুরে তাকায়। ফয়সাল হাসতে থাকে। মেজর অবাক চোখে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে থাকে।
’শোনো মেজর। তুমি চাইলেও আমার বোনের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। শুধু অরুর না, তুমি কোনোদিন কোনো মেয়েকেই ছুঁতে পারবে না। কারণ একটু আগে তোমাদের জন্য যে মদের গ্লাস এনেছিলাম তার ভেতর বিষ মেশানো ছিল। আমাকে ধরে আনার দিনই আমি সাথে এনেছিলাম তোমাকে খাওয়াবো বলে। কিন্তু এতদিন সুযোগ পাইনি। আজ যখন আমার হাতে মদ খেতে চাইলে তখনই সেটা কাজে লাগিয়েছি। একেবারে মোক্ষম সময়! কি বলো? বাইরে সবাই ইতিমধ্যেই বিষের যন্ত্রণায় ছটফট করার কথা। মেজর কিছু একটা বলতে গিয়ে টেবিলের ওপর পরে যায়।’
বাইরে তখন রাত নেমেছে। কিন্তু ওদের পথ চলতে অসুবিধা হয় না। কারণ বাইরে আজ আকাশ ভেঙে জোৎস্না নেমেছে। চিত্রার পাড় দিয়ে দু’জন হেঁটে চলেছে। সেই জোৎস্নায় সমুদ্র ভেঙে দুই ভাইবোন বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, পাবনা
ডিএসএস/