একজন মুকিত মাস্টারের একাত্তরের জীবন
পৃথিবীর সব মানুষই নিজের আবাস,আত্মীয় স্বজন, আর নিজের দেশকে নিয়ে একটি ভালবাসার বলয় করার স্বপ্ন দেখে।
তাই এই দেশের ভাগ,ঘরের ভাগ কাউকে দিতে চায়না।
এমন কি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঐ ভিটে মাটি আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়।
সেই একাত্তরের দিনগুলিতে বেশির ভাগ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেড়িয়ে পড়লেও অনেকেই থেকে গিয়েছিলেন এক মায়া ও মোহে।
অনেকেই পাক হানাদার বাহিনী আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত জান নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেননি ...আমার চোখে দেখা কত মা -বোনের ,ভাইয়ের, বাবা মার বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে ঐ বুলেটের আঘাতে ...কেউ কেউ আল্লাহর রহমতে বেঁচে যেতেন।
মুকিত আলী একজন পঞ্চাশ ঊর্দ্ধ এক স্কুল মাষ্টার ছিলেন।
সাহসী ও বুদ্ধিমান বলে সবাই চিনতেন।
১৯৭১ সনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর ঐ পাকিদের ভয়ে পরিবারের সবাইকে দূরে এক গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে একাকী রয়ে গেলেন নিজের বসত ভিটাতে।
গাঁয়ের স্কুলের সহজ সরল নিপাট এক ভদ্র শিক্ষকের যাপিত জীবনে মানুষটির চিন্তা ভাবনা ছিল কি করে মুক্তিযুদ্ধে যাবে?
এই চিন্তায় উনার ঘুম হারাম হয়ে যায়। আর তা সম্ভব না হলে কোথাও পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেবে।
কিন্তু তাঁর মন চাইছে না এই মাতৃভূমি, খেত খামার, পাড়া প্রতিবেশী, স্কুল ছেড়ে কোথাও না যেতে। সেবার হেমন্তে অনেক ধান চাষ হয়েছিল।
প্রতিটি পর্বের সেই শুভকামনা রইলো সাত সকালে ঘুম ঢেকির শব্দ, বাড়ি গমগম করে রাখা,রাতের নিস্তব্ধতায় শিশুর কান্নার রোল,
স্বামী স্ত্রী ঝগড়া-- বিবাদ সব শূন্য করে কই চলে গেল সবাই?
রাতে কুকুরের কান্না মুহিতের চোখে এক অজানা সংকেতে বুক কেঁপে ওঠে .. কখন কার লাশ দেখবে?
শিয়ালে কুকুরে খাচ্ছে যাদের, কারো কিছু বলার নেই, করার নেই ..যে বাড়ি ঘর, উঠোন জুড়ে ছিল আনন্দ আর উল্লাস সেই বাড়িতে এখন ঘুঘু চড়ে বেড়াচ্ছে, আর সকাল থেকে সন্ধ্যা যেন ফিঁকে এক গাঁ।
আকাশে বাতাসে ভেসে আসতো এক প্রতিবাদের সুর।
নিষ্ঠুর, ঘৃণ্য আর নির্লজ্জ আক্রমণের প্রতিবাদে মাষ্টার মূর্ছনা যেতো প্রায়।
এমনি এক ম্লান বিষন্ন বিকেলে মনোকষ্টে বদনা ও গামছা হাতে নিয়ে ওজু করার উদ্দেশ্যে সদর রাস্তার পাশের পুষ্করিণীর দিকে আল্লাহর নামে রওনা দিলেন।
কয়েক কদম হেঁটে ডানে মোড় নিতেই তিনি দেখলেন একদল পাক হানাদার বাহিনী তাদের দোসর রাজাকারদের নিয়ে তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে ।
হতভম্ব মুকিত আলী স্যার বুট জুতার শব্দে একেবারে নিশ্চল হয়ে গেলেন।
কখন এরা দল বেঁধে ঐ বাড়িতে এসে হানা দিয়েছে তা টেরই পাননি।
তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চিন্তিত হয়ে ,মনে মনে বললেন যে, " হায় আল্লাহ কি আজ এদের হাতেই মৃত্যু লিখে রেখেছেন?
----- না হলে আমাদের এই জাত শত্রুদের নিষ্ঠুর, অত্যাচারী, বুটের ও পায়ের শব্দ মোটেও শুনতে পারলাম না কেন?
যখন ওরা বন্দুক তাক করে উঁচু করলো; তখন মুকিত আলী মনে মনে সাহসী আর সজাগ হয়ে উঠলেন।
বুদ্ধিমান মুকিত আলী সামান্য উর্দু ভাষা দিয়ে প্রার্থনা করলো, "হুজুর ,( বদনা গামছা দেখিয়ে)
মাগরিবের ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার জন্য ওজু করতে যাচ্ছিলাম!!
তোম মুসলমান, হাম মুসলমান, ম্যায় নামাজ পরঙ্গে--- দয়া করে আমাকে শেষ বারের মতো নামাজ আদায় করার সুযোগ দিন হুজুর খান সাব।"" অনেক কাকুতি মিনতির পর এদিক- ওদিক চেয়ে উর্দু তে, বললো "" ঠিক হ্যায়,but জলদি করতা হ্যায়,,সামাস্তে লাড়কা!!
"জো হুজুর "
পিঠের পেছনে উদ্যত বন্দুকের নল উঁচিয়ে মুকিত আলী ধীরে ধীরে ঐ পুষ্করিণীর ঘাটে নেমে গেলেন। চার কিংবা পাঁচ সেকেন্ড পর,হানাদার বাহিনী ঐ শীতের রাতে ঠান্ডা পানিতে কার যেন ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ শুনলো ।
----- এরপর এক অভাবনীয় মজার কান্ড দেখতে পেলো শত্রু বাহিনীরা যে ," পুষ্করিণীর মাঝে কে যেন মাথা একবার পানির ওপর তুলছে, ফের নামাচ্ছে!
এভাবে ক্রমাগত চলে যাচ্ছে পুষ্করিণীর ওপারে ঘন অন্ধকার পাট ক্ষেতের দিকে কার যেন ছায়া আলো- আঁধারিতে দেখতে পেয়েই দিগ্বিদিক হয়ে ওদের বন্দুকের নল গর্জে উঠলো ... ঠিক সেই মুহূর্তে একজন খাঁটি দেশ প্রেমিক, সাহসী ও বুদ্ধিমান সাধারণ স্কুলের মাষ্টার বলে অনেকেই ভাবি যারা---- সেই মুকিত আলী মাষ্টার ওপাশের ঘন অন্ধকার পাটক্ষেতে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই সত্যিকার একজন মুকিত বজ্রকণ্ঠস্বরে বললো " তোম বোকা হ্যায় জান কোরবান ন্যাহি করেঙ্গা!!
সব চেষ্টা তোদের বৃথা।
ওজু শেষে আমি ঠিক মনে মনে নামাজ আদায় করেছি ঐ পানিতে ডুবেই ...
আর কখনো এই একজন একাত্তরের বুদ্ধিমান সাহসী মুকিত আলী মাষ্টারকে কস্মিনকালেও ফিরে পাবিনা!
---- আমরা বীরের জাতি---- কখনোই তোদের সামনে মাথা নত করবোনা।
আমরা নদীতে সাঁতার কেটে ভাসতেও জানি,আবার ডুবতেও জানি----- তোরা যে পানিকে ভয় পাস তার প্রমাণ একজন মুকিত আলী তাক লাগিয়ে দিল.... জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ....বলতে বলতে সে আর এক অজানা গাঁয়ের পানে রাতের নির্জনে ভেজা কাপড়েই
গন্তব্যবিহীন পথে পা বাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো...ভেতো বাঙালি দের ও বুদ্ধি আছে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন একজন মুকিত আলী মাস্টার...
মোহাম্মদপুর,ঢাকা
ডিএসএস/