সরেজমিন ঢাকা মেডিকেল
‘রোগীর আগে ওয়ার্ডে দায়িত্বরতদের চিকিৎসা জরুরি’
‘রোগীদের চিকিৎসার আগে ওয়ার্ডের দায়িত্বরতদের জরুরি চিকিৎসা দরকার। তারা লোভী ও অসৎ মানসিকতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। না হলে মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে কখনোই তারা বাণিজ্য করতে পারতেন না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাচ্ছি, ওই ব্যবস্থাপকদের আগে চিকিৎসা দেন। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। রোগীরা স্বাচ্ছন্দ্যে ওয়ার্ডে থেকে চিকিৎসা নিতে পারবে।’
এই বক্তব্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে সেবা নিতে আসা একজন রোগীর স্বজনের। নামপ্রকাশ না করার শর্তে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন, এখন আপনি রিপোর্টে আমার নাম লিখলে আমার রোগীকে বের করে দেবে।
অথচ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষের চিকিৎসার সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল। কিন্তু এই হাসপাতালের অনিয়ম, ভোগান্তি ও স্বেচ্ছাচারিতার শেষ নেই। ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা কিছু অসাধু কর্মচারী ও বহিরাগতরা রোগীদের নিয়ে বাণিজ্য করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ঢামেকের নিউরোসার্জারি বিভাগে রোগীদের চাপ সবসময় বেশি। সারাদেশ থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন এখানে। এই বিভাগে বিছানার চেয়ে রোগীর সংখ্যা তিনগুন বেশি। পাঁচটি ইউনিট নিয়ে গঠিত বিভাগটি নিয়ন্ত্রণ করেন পাঁচজন অধ্যাপক। একটু ভাল চিকিৎসার জন্য দূরদূরান্ত থেকে এই হাসপাতালে এসে চিকিৎসার নামে ভোগান্তির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ রোগী ও তাদের স্বজনদের।
সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন হাসপাতালের পুরাতন ভবনের নিউরোসার্জারি ১০০, ১০৩, ২০০, ২০১ ও ২০৪ নম্বর ওয়ার্ড নিউরোসার্জারি শিশু-মহিলা ও পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মাত্রাতিরিক্ত রোগী। কোথাও জায়গা নেই। বেড, বারান্দা, মেঝে সব জায়গায়ই রোগীতে ঠাসা। মেঝেতে থাকা রোগীদের কারণে ওয়ার্ডে হাঁটাচলার উপায় নেই। নিয়ম শৃঙ্খলারও কোনো বালাই নেই।
সরেজমিন দেখা যায়, বয়স্ক মুমূর্ষু রোগীকে অক্সিজেন লাগিয়ে ফ্লোরে রাখা হয়েছে। ওই ওয়ার্ডগুলোতে রোগীতে গিজগিজ করছে। সেখানে দায়িত্বরত নার্স, ওয়ার্ডবয় ও অন্যরা ডিউটি করলেও কর্তব্যরত চিকিৎসকদের পেতে নিচতলায় যেতে হয়। প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫ ইউনিটের রোগী ভর্তি থাকে। একেকটা ইউনিটের চিকিৎসক আলাদা। চিকিৎসক খুঁজতেই রোগীর স্বজনদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। খোঁজাখুঁজির পর চিকিৎসকের দেখা পেলেও রোগীর কাছে নিয়ে যাওয়া যায় না। আসছি বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু তাদের দেখা মেলে না।
ওয়ার্ডগুলোতে কয়েকজন রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ওয়ার্ডে সমস্যার শেষ নেই। একজন বলেন, ‘সমস্যার কথা বলব, আপনি নাম লিখে দেবেন। তারা কালকে আমাকে ওয়ার্ড থেকে রোগীসহ বের করে দেবে।’
অপর এক রোগীর স্বজন নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এই সব ওয়ার্ডে টাকা না দিলে কোনো কাজ হয় না। বিছানা পেতে গেলে টাকা, ওয়ার্ডের ভেতর ফ্লোরে জায়গা পেতে হলে টাকা, ক্যাথেটার লাগাতে গেলে টাকা। স্যালাইন বন্ধ ও চালু করার কাজেও টাকা লাগে! টাকা দিলে ওয়ার্ডের ডিউটিতে থাকা লোকজন সুন্দরভাবে কাজ করেন। আর যদি টাকা না দেই, তাহলে রোগীর ১২টা বেজে যায়। সকালের কাজ করবে রাতে, আবার রাতের কাজ করবে পরের দিন বিকেলে। তাও আবার অমানুষিক আচরণ করে। তারা শুরুতেই আচরণ খারাপ করে বুঝিয়ে দেয় যে, আমাকে টাকা দাও, ভালো ব্যবহারের পাশাপাশি সেবাও পাবে ভালো।
তিনি আরও জানান, এখানে রোগীর অবস্থা আপনারা দেখছেন। লোকজন তার রোগী একটু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার জন্য একটা সিটের চেষ্টা করবেই। রোগীর স্বজনদের এই সরলতার সুযোগ নিয়েই ওয়ার্ডে থাকা কিছু অসৎ কর্মচারী ও বহিরাগত লোকজন বাণিজ্য করে। কোনো রোগীর আগে ছুটি হবে, সেটা ওয়ার্ডের লোকজনই জানে। সে কারণে রোগীর স্বজনরা অগ্রিম তাদের হাতে টাকা দেয়। যে টাকা বেশি দেয় তাকে সিট দেওয়া হয়।
রোগীর স্বজন আরও বলেন, ওয়ার্ডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা লোকজনের কারণেই আজকে রোগীরা অসহায়। রোগীর আগে এই লোকজনদের জরুরি চিকিৎসা দরকার। এরা লোভী ও অসৎ মানসিকতার মানুষ। তা না হলে রোগীদের নিয়ে বাণিজ্য করতেন না।
নিউরোসার্জারির বিভাগের মাস্টার আবুল হোসেন এক বাক্যে এ সব অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, টাকার বিনিময়ে রোগীদের বিছানা পাইয়ে দেওয়াসহ অন্যান্য কাজ আগের তুলনায় অনেক নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আমরা সব সময় মনিটরিং করে থাকি। এ ছাড়া ওয়ার্ডে প্রতিদিন বহু রোগী ভর্তি হয়। এ জন্য ওয়ার্ডগুলোতে প্রতিদিনই রোগীর ব্যাপক চাপ থাকে।
অপরদিকে, নিউরোসার্জারির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার জানান, ওয়ার্ডে ৫ ইউনিটের তত্ত্বাবধানে রোগী ভর্তি হয়। সেখানে প্রতিদিনই রোগী ভর্তি হয়। এ জন্য সব সময়ই রোগীর চাপ বেশি থাকে। ওয়ার্ডে কিছু অসাধু ব্যক্তি রোগীকে জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে থাকে, বিষয়টি সত্য।
তিনি আরও বলেন, ভর্তি রোগীকে ট্রলিতে করে হাসপাতালের অন্য কোথাও পরীক্ষার জন্য নিয়ে যেতেও টাকা দিতে হয়। রোগী বা তাদের স্বজনরা এজন্য টাকা না দিলে তারা কাজ করতে চায় না। এক কথায় তারা রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যথাযথ চেষ্টা করছে এ সব অনিয়ম বন্ধ করার।
ডা. অসিত চন্দ্র বলেন, নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে মোট বেড সংখ্যা সাড়ে ৪০০। কিন্তু রোগী আছে ১২০০ থেকে ২৩০০। তার জন্য অনেক রোগীকে ফ্লোরে থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। আমাদের কিছু করার নেই। তবে আমরা রোগীদের চিকিৎসা করে যাচ্ছি। রোগীরা যদি কষ্ট করে থাকে তা হলে চিকিৎসা পাবে।
এ ব্যাপারে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক জানান, এরকম অভিযোগ আমাদের কানেও আসে। কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। আমরা কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। প্রমাণসহ কেউ অভিযোগ দিলে, তার পরিচয় গোপন রেখে ওয়ার্ডে থাকা ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আমরা অ্যাকশনে যেতাম। তবুও আমরা সব সময় চেষ্টা করে যাচ্ছি হাসপাতালে রোগীরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা পায়।
আএইচ/এনএইচবি/আরএ/