ফুটপাতে জুতা বিক্রেতা, শিশুদের ফ্রি ফুটবল কোচ
অখিলেশ পালের গল্প নিয়ে সিনেমা হতে চলেছে। বখে গিয়ে আবার ফিরে এসেছেন তুমুল সংগ্রামে। গৃহহীনদের বিশ্বকাপে, ভারতীয় জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। সত্যি কাহিনীটি লিখেছেন ওমর শাহেদ
এক সময় স্থানীয় অপরাধীদের দলপতি ছিলেন-তাকে ‘ডন’ বলা হতো। তার বিপক্ষে ৪৫টি মামলা ছিল। পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছিল সাজা দেবার জন্য, আইনের মুখোমুখি করতে। এখন তিনি পুরোপুরি ভিন্ন একজন মানুষ। বস্তিগুলোতে বাস করা শিশুদের ফুটবল খেলা শেখান, অপরাধপ্রবণ বিপদজনক এলাকাগুলোতেও তার সেই কাজ চলে। মোটে আট বছর বয়সে বস্তির এই শিশুটি বাজে অভ্যাস যেমন সিগারেট খাওয়া ও জুয়া খেলা শিখে নেন। বাবা ছিলেন একজন পিয়ন, চাকরি করতেন ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের নাগপুর শহরের নাগপুর সরকারী হাসপাতালটিতে। মা একজন গৃহবধু ছিলেন। দুটি বড় বোনের সঙ্গে থাকতেন তিনি। পুরোপুরি কঠিন একটি জীবন ছিল সেই বয়সের ছেলেটির নাগপুরের আজানি বস্তিতে। ছোট শিশুটি বাজে নেশা ও জীবনের ফাঁদে পড়ে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতো, বস্তির ওই ছেলেগুলো এসব উপভোগ করতে কীভাবে টাকা যোগাড় করছে। তার কৌতুহলই তাকে তাদের বন্ধু বানালো। ছয় ক্লাসের পর লেখাপড়া ছেড়ে দিলো অখিলেশ পাল। কুখ্যাত ছেলেদের দলটিতে যোগ দিল সে।
আস্তে, আস্তে অনুভব করলো এবং দেখলো, এই ছেলেগুলো বাজে কাজ করতে ডাকাতিসহ নানা ধরণের সামাজিক অন্যায়েও যুক্ত হয়ে গিয়েছে। তারা এভাবে সহজে টাকা কামাচ্ছে ও তাদের ভাষায় উপভোগ করছে তার চোখে পড়লো। অন্যদিকে সে দেখলো, তার বাবা সারাদিন-রাত খেটেও পরিবারের খাবারের চাহিদা মেটাতে পারছেন না। অন্যসব টিনএজার বা কিশোরের মতোই সহজে টাকা কামানোর দিকে আগ্রহী হয়ে পড়লো, ঝুঁকে গেল অখিলেশ। সে কাজ করতে শুরু করলো আবাসন অধিপতি ও রাজনীতিবিদদের হয়ে; তাদের সে মানুষকে ভয় দেখানো এমনকি আঘাত করতেও সাহায্য করতো। এরপর তার জীবনে এলেন ভিজয় বার্সে। মনে পড়ে অখিলেশের-‘আমাদের কাছে তিনি ছিলেন একজন পুলিশের মতো। ফলে যখন তিনি আমাকে ও আমার বন্ধুদের ডাকলেন; তাদের মধ্যে যারা রাস্তার পুরোটা জুড়ে সিগারেট খাচ্ছিল ও জুয়া খেলছিল; আমাদের মধ্যে সন্দেহ থাকলেও যেতে বাধ্য হলাম।’
যখন অখিলেশ পাল বার্সেকে জিজ্ঞাসা করলো, কেন তিনি তাদের ডেকেছেন, তিনি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তারা যদি বলটি নিয়ে খেলে তাহলে সে কী খেলবে? সে ও তার বন্ধুরা এতে ভীষণ অবাক হয়ে গেল। তারপরও তারা তাকে জিজ্ঞাসা করলো, খেললে কী তিনি তাদের পয়সা দেবেন। উত্তরে মাথা নাড়লেন এই বিখ্যাত ফুটবল কোচ, খেলার জন্য তিনি তাদের প্রত্যেককে পাঁচ রুপি করে দেবেন।
তারা প্রথমে তার সঙ্গে মজা করলো ও এরপর মনে করলো, কেবল খেলার জন্য পাঁচ রুপি করে দেওয়া কোনো মন্দ চুক্তি নয়। এরপরের ১৫টি দিন ছেলেদের খেলা ও বিনিময়ে পয়সা নেওয়া রুটিনে পরিণত হলো। সময় বাড়লো খেলার অনেক, তাদের আগ্রহ ও ভালোবাসা তৈরি হলো ফুটবলের দিকে। ফুটবল খেলাকে তারা অন্যসব কাজের চেয়ে জরুরি বানিয়ে ফেললো। তবে ১৫ দিন পেরুনোর পর বাসে তাদের বলটি দেবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। কেননা, তার কাছে আর পয়সা নেই। তবে ফুটবলে আসক্ত হয়ে পড়া ছেলের দল টাকা ছাড়াই ফুটবলটি পেতে ব্যাগ্র হয়ে গেল।
‘এই ১৫ দিনে অনুভব করলাম, আমরা আমাদের সব বাজে অভ্যাস থেকে দূরে সরে গিয়েছি ও একটি নতুন অভ্যাসে পড়েছি-সেটি হলো ফুটবল। আমরা আমাদের পুরোনো কাপড়গুলো ও কাগজ দিয়ে বান্ডিল বানিয়ে ফুটবল তৈরি করতাম। সেগুলো দিয়ে খেলতাম। তবে এই সত্যিকারের ফুটবল পাওয়ার পর আমরা সেটিতে খেলার জন্য প্রাথনা করতাম-এভাবেই ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার কথা মনে পড়লো অভিলেশ পালের।
ইতিমধ্যে অপরাধজগত ও পুলিশের অনুসরণে পড়লো অখিলেশ। প্রায় ৪৫টি মামলা আছে তার নামে তখন। নিজেকে একটি কবরখানাতেও সে ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ১৫ থেকে ২০ দিন কোনোরকমে, না খেয়ে না দেয়ে লুকিয়ে রাখলো। ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে সাধারণত সে ভিক্ষুকদের সঙ্গে ঘুমাতো। কোনো সময় তাদের খাবারও ছিনিয়ে খেত। এরপর তাদের হাত থেকে বাঁচতে দৌড়ে পালাতো কবরখানায়। যে রাজনীতিবিদ ও বড় আবাসন ব্যবসায়ীদের জন্য সে কাজ করেছে, তাদের কেউই তাকে এই জীবন থেকে বাঁচতে সাহায্য করেননি।অবশেষে যখন অখিলেশ পাল বুঝতে পারলেন, নিজের জীবনকে তিনি ধ্বংস করে ফেলছেন; পরিবার ও এক বন্ধুর সাহায্যে পুলিশের কাছে আত্মসমপর্ণ করলেন। বিচারককে যখন অঙ্গীকার করলেন, এখন থেকে তিনি একজন বদলে যাওয়া মানুষ হবেন, জামিন পেলেন তিনি। নিজের নতুন জীবন শুরু করলেন। আদালতের বিচারক তাকে সূয ওঠার আগেই তাকে তার এলাকা ছেড়ে যেতে হবে ও অন্ধকার নামার পর ফিরে আসতে পারবেন-এই আদেশ দিলেন। ফলে তাকে তার বাড়ি ছাড়তে হলো। তবে ভালো জীবনের দেখা পাচ্ছিলেন না অখিলেশ।
একদিন তিনি দেখলেন, কটি ছেলেমেয়ে একটি সাইকেলে যাচ্ছে, পিছু, পিছু ছুটছে, হাসাহাসি করছে। তারা তাকে পেরিয়ে যাচ্ছিল। তারা খুব খুশি হয়ে ছুটছে দেখে অখিলেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছো?’ উত্তর দিলো, ‘আমরা পাশের একটি মাঠে প্রতিদিন খেলি। এখন খেলতে যাচ্ছি।’ কথাটি তাকে তার পুরোনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিলো। ফলে আবার তিনি খেলতে শুরু করলেন ভিজয় বাসের সংগঠন ‘স্লাম সকার’-এ।
সেখানে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন। এর সুবাদে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিকভাবে খেলার সুযোগ পেলেন। তবে ওই অতীত তখনো তাকে তাড়া করে ফিরছিল। আগের অপরাধ রেকর্ডগুলোর জন্য অখিলেশ পাল পাসপোর্ট পাচ্ছিলেন না। তবে তার একাগ্রতা দেখে আগের প্রতিষ্ঠানের মালিক জয়সাওয়াল আদালতে আপিল করলেন ও তাকে পাসপোট পেতে সাহায্য করলেন।
ব্রাজিলে গৃহহীনদের বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার জন্য ভারতীয় দলের সঙ্গে গেলেন অখিলেশ পাল। যাবার আগে ভারতীয় দলটি একটি প্রেস কনফারেন্স করলো। ‘আমি সত্যিই খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। নিজের অতীত বলা আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে গেল সেখানেও। সেসব নিয়ে বলতে এখনো আমার খারাপ লাগে। এই বিষয়ে বলতে গিয়ে যেভাবে একটি চাকরি পেতে ও পাসপোর্ট পেতে আমার কষ্ট হয়েছে তেমনটি হবে-এই প্রস্তুতি নিলাম মনের গভীরে। তবে অবাক হয়ে গেলাম, এই মানুষগুলো আমাকে নিয়ে গর্বিত হয়ে গেলেন। আমাকে গৃহহীনদের ফুটবল বিশ্বকাপের ২০০৯ সালের ভারতীয় দলের অধিনায়ক ঘোষণা করা হলো। এই প্রথম নিজেকে নিয়ে আমার ভালো লাগলো’-বলেছেন অখিলেশ পাল।
গৃহহীন ফুটবল বিশ্বকাপে ভারতীয় জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক এত ভালো খেললেন যে বিখ্যাত ব্রিটিশ ফুটবল দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নামকরা কোচ ডেভিড ময়ইজ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এরপর তিনি কী করবেন? তবে ব্রিটেনের বিশ্বখ্যাত ফুটবল লীগে খেলা হলো না তার। নামকরা দলের প্রতিও কোনো আগ্রহ বোধ করলেন না অখিলেশ পাল। কেননা, তিনি সবসময় চেয়েছেন, চারপাশের সামাজিক অবস্থাগুলোর কারণে যেসব শিশু তার মতো ভুল পথে চলে গিয়েছে, তাদের প্রশিক্ষণ দেবেন, ওদের ফুটবল খেলা শেখাবেন।
এখন তিনি লিভিং হোপ বা আশায় বাঁচছেন নামের একটি এনজিওর সঙ্গে কাজ করছেন এবং তাদের মাধ্যমে নাগপুরের অত্যন্ত অপরাধ প্রবণ এলাকার শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছেন। এই কাজের শুরুটিও তার জন্য খুব কঠিন ছিল, ‘এই মানুষগুলোকে বোঝানো কঠিন ছিল। কেননা, তাদের মায়েরাও তারা যে ব্যবসাগুলো করেন, সেগুলোতে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতে ক্রমাগত চেষ্টা করে চলছিলেন। তবে সেই সংগ্রাম আমার জীবনভরের একটি অভিজ্ঞতা। সবসময় ভেবেছি, আমার একটি ক্ষত-বিক্ষত অতীত আছে কিন্তু এই শিশুদের কজন একদিন আমাকে জানালো, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-অভিভাবক মিটিংয়ে তাদের মায়েরা ভিন্ন লোকদের নিয়ে আসলেন, শিক্ষকরা তাদের বাবা সম্পকে জিজ্ঞাসা করার পর বোকার মতো ওরা বলে ফেললো, এমনকি বাবা কে তাও তারা জানে না। এটি ছিল হৃদয়বিদারক ঘটনা। আমি সত্যিই তাদের এই ব্যথাবিধুর ঘটনাগুলো থেকে বের করে আনতে চেয়েছিলাম, তাদের মধ্যে ক্ষমাশীলতা তৈরি হলো খেলার মাধ্যমে।’
তবে কোথাও ফুটবল খেলা শেখানোর জন্য কোনো টাকা নেন না তিনি। ফুটপাতে জুতা বিক্রি করে রোজগার করেন। তবে এই টাকা তার ও পরিবারের জন্য যথেষ্ট নয়। তার ও স্ত্রী কবিতার ছেলে ইমানুয়েল পালকে নিয়ে বড় স্বপ্ন আছে। ছেলেটি এখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। লেখাপড়ার অভাবে কোনো চাকরি জোটাতে পারেননি তার বাবা। ফলে তিনি চান, তার ছেলে সবচেয়ে ভালো বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলোতে পড়ুক।
এই উজ্জলতা ছড়িয়ে যাওয়া ভারতীয় তারকার গল্প দেশটির সব তরুণদের জন্য প্রেরণা। তার জীবনের গল্পটি অনেক জায়গায় লেখা হয়েছে। এখন বলিউডে ছবি হতে চলেছে। তবে এখনো পরিবারের মুখে গ্রাস তুলে দিতে তাকে সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে। তারপরও তিনি আশা করেন, তার প্রতিভাগুলো সঠিক জায়গায় চলে যাক এবং দেশের প্রতি সম্মান বয়ে আনুক। নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অখিলেশ বললেন, “যখন আমার ছেলের বিদ্যালয়ের ফিগুলো দিতে পারি না আমি আশাহত হতে পড়ি। যাই হোক-এটিও আমাকে আমার মতো আরো অনেকের জীবন বদলে দেওয়ার লক্ষ্যটিকে আঘাত করে না। প্রত্যেককে আমি কেবল একটি কথাই বলতে চাই এবং তাদের সবাইকে, যারা খারাপ অভ্যাসের ফাঁদে পড়ে আছেন-‘আপনার যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞা থাকে, তাহলে যেকোনো বয়সে, যেকোনো পরিস্থিতিতে এবং যেকোনো মূল্যে নিজেকে বদলাতে পারবেন’।”
(ইন্টারনেট থেকে অনুবাদ)