‘চাষা-ভূষার টং’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাস্ট) চালু হয়েছে ‘চাষা-ভূষার টং’। বানিয়েছেন, সবকিছু রেখেছেন; বেচা-কেনা, রান্না সবই করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও ছাত্ররা। তাদের সঙ্গে আলাপ করে লিখেছেন নুরুল ইসলাম রুদ্র, ছবি তুলেছেন নাজমুল হুদা
ছাত্র, ছাত্রীদের অনন্য মানবতা
অন্যরকমের এই দোকানটি চালু হয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সাস্ট)’র অ্যাকাডেমিক ভবন-বি’র সামনে। দোকানের পেছনে সব টাকা, পয়সা ছাত্র; ছাত্রীদের পকেটের। তারা যে যা পেরেছেন চাঁদা দিয়েছেন। কেবল তাই নয়, মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়েছেন ক্যাম্পাসের ছোট্ট এই দোকানটি। চারপাশে বেঁধে দিয়েছেন নিজেদের নকশা করা হাঁড়ি, পাতিল; তাতে আবার গাছ আছে ছোট, ছোট। শখের দোকানে আছে ফুল আঁকা বাহারের হাতপাখা। একপাশে বাঁশের বেড়া দিয়েছেন। অন্যপাশ খোলা। বাঁশের তাক রেখেছেন নানা কিছু সাজিয়ে রাখার জন্য। আছে চা পাতার বাক্স, বিস্কিটের ডিব্বা, ফিরনির পাতিল, দইয়ের হাড়ি, রুটির প্যাকেটগুলো ইত্যাদি। নীচে চুলা, পানি গরম হচ্ছে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত। সারাদিন চা খাওয়ার জন্য অনেক ছাত্র, ছাত্রীর পা পড়ে এখানে কেবল একটি কাজেই। তবে কাজ করছেন কোনো দোকানদার নন। ছাত্র, ছাত্রীরাই; তাও আবার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বাংলাদেশের সেরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের।
চা বানাচ্ছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরই (সাস্ট) ছাত্রী সুমাইয়া আফরিন। কেন এই দোকান? উত্তরে বলেছেন, ‘আমাদের সাস্টে অন্যসব ক্যাম্পাসের মতো এই টং দোকানগুলোই আড্ডার মূল আখড়া। এখানেই আমাদের আলাপ ও সময় কাটে। কম দামের এই খাবারগুলোই তিন বেলার পেট ভারি করে খাওয়ার বিকল্প। অনেকের সারাদিনের খাওয়াও বটে। নিজেদের মধ্যে ভাবনার বিনিময় ঘটে। তবে আমাদের সাস্টের প্রশাসন-শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে এই টং দোকানগুলোকে বন্ধ করে রেখেছেন। তাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। ফলে এই যে ভিসি স্যার বিরোধী আন্দোলন, তার অংশ হিসেবে আমরা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবী পূরণ করেছি। এই দোকানটি আমরা নিজেরাই বানিয়ে চালু করেছি।’
নামটি কেন ‘চাষাভূষার টং’?
এজন্য চলে যেতে হবে গেল মাসে। ১৯ জানুয়ারি, ২০২২। উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে যখন ব্যস্ত ছাত্র, ছাত্রীরা; তারা আমরণ অনশনেও গিয়েছেন; সেই সময়গুলোতে এই দিন তাদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ ও অসদাচরণ’র অভিযোগ করলেন খোদ শিক্ষকদের একটি অংশ। তারা মানববন্ধনও করেছেন। সাস্টের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক লায়লা আশরাফুন সেখানে বলেছেন, ‘আমরা চাষা-ভূষা নই যে যা খুশি তাই বলবে। আমাদেরও সম্মান আছে। আমরা বুদ্ধিজীবি শ্রেণীটিকে ধারণ করি।’ শিক্ষকের কাছ থেকে এমন কথা শুনে আরো ক্ষেপে ওঠেন ছাত্র, ছাত্রীরা। তারা আন্দোলনে নেমে পড়েন। এরপর তাদের এই নিয়ে আরো আলাপ হয়। তারপর ‘আমরা সবাই সাস্টিয়ান, চাষাভুষার সন্তান’ শ্লোগানটিতে প্রতিবাদ শুরু করেন তারা। ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। সাস্ট ক্যাম্পাসেই চাষীদের প্রতি সম্মান জানাতে ও নিজেদের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ব্যতিক্রমী উদ্যোগটিতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের টং দোকান আবার চালু করেন। তাদের একজন পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র শাহরিয়ার আবেদীন। বলেছেন, “ভিসি স্যারের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন চলার সময় আমাদের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. লায়লা আশরাফুন ম্যাডাম তার এক বক্তব্যে বাংলাদেশের চাষা-ভূষা নামের কৃষক শ্রেণীকে অপমান করেছেন। অথচ, তিনিও জানেন, তারাই সভ্যতার বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন। তাদের প্রতি সম্মান জানিয়েই আমরা এই টংটির নাম ‘চাষা-ভূষার টং’ রেখেছি।”
বেচা-কেনার গপ্প
এই দোকানের উদ্বোধনের দিন তারা আশপাশের সব ছাত্র, ছাত্রীকে বিনা মূল্যের ফিরনি খাইয়েছেন। ছাত্রীরা নিজেরাই রেঁধেছেন। চালু করেছেন এই বুধবারে আগের বুধবার সন্ধ্যায়। এখানে আলাদা কোনো বিক্রেতা নেই। নিজেরাই কেনা-বেচা করছি বলে জানিয়েছেন-লোকপ্রশাসনের ছাত্রী নাফিজা আনজুম ইমু। বলেছেন, ‘আমরাই এই দোকানটির বিক্রেতা। চা, বিস্কুট, রুটি, খিচুড়ি, সিঙ্গারা, সমুচা ইত্যাদি খাবার আমরা তৈরি করছি। সবই কিনতে ও খেতে পাওয়া যাবে।’
ওএস।