ফিনল্যান্ডের মানুষরা সবচেয়ে সুখী কেন?
বহু বছর ধরে জাতিসংঘের সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ড। কেন? তারা কীভাবে লাভ করেন? সুখই বা কী-লিখেছেন আহমেদ সজীব
ব্যাকুল সুখের লাগি
সুখ কী? জীবনমুখী আলোচনায় এ এক প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। এমন এক বিমূর্ত ও সারাজীবনের সাধনা; যাকে মুখের কোনো ভাষায় বা পাতায় লিখে দেওয়া কোনো শব্দে প্রকাশ করা যায় না। কোনো পরম বা অ্যাবসুলেট সংজ্ঞাও নেই। এ যে এক পরম পাওয়া। তবে আমি বলি সুখ একটি আপেক্ষিক বিষয় কী ঘটনা বা মনের বিশেষ কোনো অবস্থা। সুখ আসলে ব্যক্তিনিভর। একেকজনের কাছে একেক রকম। শব্দের অর্থ মিলিয়ে সুখের ধারণা দেওয়া গেলে বলতে হয়Ñসুখ আমাদের মনের সন্তুষ্ট; অন্য কোনোকিছুতে বিক্ষিপ্ত না হওয়া বিরল অবস্থা। নানা কারণে, বিভিন্নভাবে আমরা সবাই সুখী হই। বাংলাদেশের এত পরিশ্রমী জনগোষ্ঠী-যারা এত ব্যাকুল সুখের লাগি; তাও কেন সুখের দেখা পান না?
ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস
ফিনল্যান্ডের মানুষ জাতিসংঘের সুখের বৈশ্বিক সূচকে প্রথম স্থান দখল করে রয়েছেন দিব্যি। ফিনিশীয়দের সুখী হওয়ার গোপন রহস্য কী? পাশাপাশি আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট দেশটি ভুটান, যারা মোট দেশজ সুখের মাধ্যমে জাতীয় উন্নতির বিস্ময়কর হিসেবটি করেন; তারা কেন সুখী দেশের তালিকায় প্রথমে নেই? তাহলে তো জটিল মনে প্রশ্ন ভাসে-বৈশ্বিক সুখ বা ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস বলতে আদতে কিছু আছে কি?
জাতিসংঘ বলছে
জাতিসংঘের সুখের পরিমাপক নীতিতে পযাপ্ত সামাজিক সুযোগ-সুবিধাগুলো; ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের সামাজিক উদারতা, মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, গড় আয়ু, দেশের গড় জিডিপি ও দুর্নীতির মাত্রা স্ট্যান্ডার্ড বা সূচক হিসেবে কাজ করে। সূচকগুলো নিয়ে করা তালিকার প্রথম দেশটি ফিনল্যান্ড। তাদের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা, দেশবাসীর সামাজিক-মনস্তাত্বিক পরিস্থিতিও অন্য সব দেশের চেয়ে ওপরে। দেশে সরকার জনগনকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদান করতে পারেন, উন্নয়নের যেকোনো বাধায় জনতাও রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করেন। তবে দেশটির কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৪০ ভাগেরও বেশি বয়স্ক। তারপরও সব বয়সের মানুষের চমৎকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমবায় ব্যবস্থাটি বিদ্যমান আছে।
অসাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা
ফিনল্যান্ডে শিশুদের লালন ও পালনে এতই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে তিনটি মাস বাবা ও মায়ের সান্নিধ্যে থাকতে পারে। তখন সরকার ওই পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করেন। ফিনল্যান্ডের অনবদ্য শিক্ষাব্যবস্থাটি সম্বন্ধে সচেতন নাগরিক সমাজের কে অবগত নন? ফিনিশদের ব্যক্তিসত্তার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে ‘সিসু’। ফিনিশিয় সিসু ধারণাটির মানে হলো, ব্যক্তি অভিযোগহীনভাবে দু:খ ও যন্ত্রণা সইতে পারেন; তার চরিত্রটি হয় দৃঢ়, নাছোড়বান্দার মতো জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সারাজীবন লেগে থাকেন, তার ভেতরে সাহস আছে, সহিষ্ণুতার গুণাবলী রয়েছে, তিনি প্রাণোচ্ছল, জীবনকে আবার ফিরিয়ে আসতে পারেন, তার সহ্যশক্তি রয়েছে। এই সিসু ধারণাটিকে ফিনিশরা তাদের জাতীয় চরিত্র বলে জানান। নানা ধরণের সিসু স্কুল আছে, সিসু পরিবেশ বিদ্যালয় রয়েছে; আছে বইও। ফলে জাতিগতভাবেও তারা প্রতিটি যুক্তিসঙ্গত লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।
জীবনযাপনে তারা
জীবনযাপনের পারস্পরিক যোগাযোগে টুকটাক কথাবার্তাও খুব কম বলেন ফিনল্যান্ডের মানুষজন। এমনকি তারা ধন্যবাদ বা স্বাগতমের মতো ছোট্ট কথাটিও প্রায় বলেন না। এই নয় যে, তারা বিনয়ী নয়। যথেষ্ট দিলখোলা, আন্তরিক। আসলে নীরবতা তাদের সাধারণ আচরণবিধি। আলোচনা, আড্ডার মাঝে হুট করে চুপ করে যাওয়া দেশটিতে সংস্কৃতির সাধারণ মিল।
জীবনযাপনে সবাই
মানুষরা খুব পরিশ্রমী। বছরজুড়ে পরিশ্রমের ফলে বার্ষিক ছুটির ব্যবস্থা আছে এই দেশে। তারপরও মাথাপিছু আয়ে ইউরোপের অন্য অনেক দেশ থেকে পিছিয়ে আছেন। এরপরও যা কামান গড়ে প্রতিটি নাগরিক, দেশের বিচারেও জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত। একেবারে সামান্য, সাধারণ ফিনল্যান্ডের নাগরিকও আয়ব্যয়ের চিন্তায় জীবনকে দুশ্চিন্তামুক্ত যাপনে বরাবর প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এই দেশের মানুষের প্রায় সকলের সামাজিক পরিচয় এক আছে। ‘পরিবার-বন্ধু-কর্ম-শিক্ষা’ এই পরিচিতির ভালো ও মন্দের নির্ধারক। তারপরও শ্রেণীবৈষম্য এবং শ্রেণী সংঘাত এবং সংগ্রাম থাবা মেরেছে ইউরোপের ওই ভুবনে। নিজেদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মানবোধও আছে প্রবলভাবে। নতুন কারো সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে মানুষরা খুব সতর্ক থাকেন। সাউনা নামের একটি সাধারণ জায়গায় তারা বন্ধু ও পরিবারের সাথে সময় কাটান। এটির আরেক নাম সুডাটরি। একটি ছোট্ট ঘর বা ছোট ভবন যেখানে বৃষ্টিহীন বা বৃষ্টিময় কী উত্তাপের দিনগুলোকে উপভোগ করেন। এখানে একটি বা এমন অনেকগুলো সুবিধাকে ভোগ করার ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। বাস্পীয় ইঞ্জিন ও উচ্চমাত্রার উত্তাপ দিয়ে অবগাহনকারীকে স্বগীয় সুখ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। একটি তাপমানযন্ত্র ঐতিহ্যগতভাবে প্রতীক হিসেবে তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য ব্যবহার করা হয়। আদ্রতা মাপার জন্যও থাকে একটি হাইগ্রোমিটার বা আদ্রতামাপক যন্ত্র। এটি বাস্পের বা আদ্রতার পরিমাপ করে। ইনফ্রারেড থেরাপি প্রায়ই এক ধরণের সুনাতে ব্যবহারের মতবাদ আছে। তবে ফিনিশ সুনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, এটি একটি সুনা নয়। বরফে ঢাকা দেশের মানুষের কাছে সুনা অমূল্য।
ব্যক্তিগতভাবে
ব্যক্তিজীবনেও পরিবার, বন্ধু তাদের কাছে বেশ জরুরি। সামাজিক দায়, দায়িত্ব সুনাগরিকের মতই পালন করেন তারা বহুকালের ঐতিহ্যে। শীতপ্রধান দেশটি নির্জনতাপ্রিয়। ফিনিশরা সাধারণত নিজেদের চাওয়া, পাওয়া, অভাব, অভিযোগ, চাহিদা ও যোগান সম্বন্ধে খুব ভালোভাবে জানেন। ছোটকাল থেকে এই দেশের শিশুদের, যেটি বিশ্বের সেরা শিক্ষাব্যবস্থা; সেখানে যেটুকু প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি না চাওয়ার শিক্ষা প্রদান করা হয়। লোভী না হওয়ার মানুষের আদিম শিক্ষা তাদের মজ্জাগত হয়ে যায়। শতভাগ শিক্ষিত দেশটিতে শিক্ষকদের সম্মান সবচেয়ে বেশি, আয়ও। ফলে যেকোনো ধরণের বৈষম্য, সেটি ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়-যাই হোক না কেন; দেশের অন্যতম সামাজিক উদ্বেগে ও পরে রাষ্ট্রীয় সংকটে পরিণত হয়ে থাকে। সব দিক-সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক ভারসাম্য ইত্যাদি ফিনিশীয়দের সবচেয়ে সুখী করে তোলে। তাদের দেশে সুখ হলো ইতিবাচক আবেগীয়, উন্নতির চলমান অবস্থা।
ওএস/২৭-১-২০২২।