পদ্মা পাড়ের অজানায়
বাংলাদেশের বিখ্যাত ভ্রমণবিদ ও দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম নিয়ে গেলেন কোথায়? সেই কাহিনীর ছবিও তাদের দেওয়া।
পরের দিন শুক্রবার মানেই আমার ও আমাদের কজনের বৃহস্পতিবার রাতের ঘুম হারাম। রাতভর এপাশ, ওপাশ করতে, করতেই ভোর চারটা থেকে সাড়ে চারটার মধ্যে, দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র জসিম, হানিফের ফোন চলে আসে। অমনি বিছানা ছেড়ে দিতে হয়, শুরু হয়ে যায় বেরুবার হবার কসরত।
তেমন এক শুক্রবার। মটর বাইকে নবনির্মিত সিঙ্গাইর সড়ক ধরে মিতরা, ঝিটকা পেরিয়ে হরিরামপুর উপজেলার আন্ধারমানিক, নৌঘাট। নতুন সড়কের বর্ণনা না দিলেই নয়। ধল্লা ব্রিজ পার হবার পর হতেই নয়নে আটকাতে থাকবে পথের দুধারের নৈসর্গিক সব প্রাকৃতিক দৃশ্য। আনমনেই গেয়ে উঠবেন গান।
মানিকগঞ্জ যাবার নতুন সড়কটিতে, এখনো ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল তেমন চোখে পড়েনি। ঘাটে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে, দিতে যাত্রীবাহী ট্রলার ছাড়ার সময় হয়ে গেল। চা দোকানদারকে অনুরোধ করে, তার দোকানের পাশেই বাইক রেখে ট্রলারে চড়লাম।
ঢেউ তোলা আষাঢ়ে, প্রমত্তা পদ্মা নদী। ঝলমলে তপ্ত রোদে ছাউনিহীন ট্রলার আমাদের। কিছুক্ষণ চলার পর, আকাশে কালোমেঘের ঘনঘটা এলো। হঠাৎ তুফান ছাড়লে কী হতে পারে, সেদিকে খেয়াল নেই আমাদের কারো। রোদের ঝাঁঝ কমে যাওয়ায় আবার মহা খুশী সবাই। আসলে পাহাড়-সমুদ্রে অ্যাডভেঞ্জার করা দে-ছুটের দামালেরা পদ্মাকে নিয়ে ভাবলো না। পৌনে একঘন্টা পর ট্রলার ভিড়ল লেছড়াগঞ্জ ঘাটে। যাত্রী দেখে ভাড়ায় খাটা বাইকারদের হাঁক, ডাক শুরু হয়ে গেল। আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। হাঁটতে শুরু করলাম।
সবুজে ঘেরা মেঠো পথ। খানিকটা দূরেই একজনের নেটের মত ব্যাগে, কিছু একটা দেখতে পেয়ে থামালাম তাকে। ব্যাগ খুলে দেখতেই, সাপের মত কিছু একটা। উৎসাহে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, এ বাউস মাছ। সর্প আকৃতির বিশাল মাছটি হাতে নিয়ে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিতে হলো। প্রচুর লাইক-কমেন্ট এল। বিভিন্ন জনের নানান মন্তব্যের মাধ্যমে জানা গেল, সচারচর ধারা পড়ে না। খেতে নাকি দারুণ স্বাদ।
গ্রামের দিকে আমরা এগুচ্ছি। চোখে পড়ল ভুট্টা ক্ষেত। নয়নাভিরাম সব দৃশ্য। কৃষক-কৃষাণী সমানতালে গাছ থেকে ছিঁড়ে ভুট্টা জমা করছেন। তাদের সঙ্গে আমরাও যোগ দিয়ে, অন্যরকম অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। ভ্রমণ মানেই হলো বিনোদন ও যাপিতজীবনের শিক্ষা।
লেছড়াগঞ্জ চরের ভেতরে পাটগ্রামের দিকে যেতে, যেতে বাজার পেরিয়ে নদীর ধার। তীর, আশপাশ আর স্বচ্ছ্ব জল দেখে সেখানেই বসে পড়লাম। মানিকগঞ্জের বন্ধু মেহেদীকে ফোন দিয়ে, নদীর নাম জিজ্ঞাসা করতেই জানাল, ‘এ হলো ইছামতী’। যে যার মত, দ্রুত হ্যামোক টানিয়ে, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বিভূতিভূষণের নদীতে কত মজা। ফিরে গিয়েছিলাম আমি সেই শৈশবে, টলটলে বুড়িগঙ্গা নদীর জলে। ডুব সাঁতার, উল্টো সাঁতারসহ ইচ্ছে মতো ইছামতীতে দাপাদাপি। এরপর ছুটলাম জুম্মা আদায়ে। নামাজ শেষে হেঁটে, ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের গ্রামগুলো ঘুরে, ঘুরে দেখলাম। পুরো চর জুড়ে ভুট্টার বাম্পার পলন। প্রচুর গাছগাছালিতে নানান পাখির কলতান। তাল গাছগুলোতে সারি, সারি বাবুই পাখির বাসা। এত, এত বাসা সাধারণত আজকাল কোথাও তেমন চোখে পড়ে না। চরের বাসিন্দারা বেশ বন্ধুবৎসল। রয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বসতঘর।
সাধারণ বর্ষায় লেছড়াগঞ্জের জমি বরাবর নদীর পানি থাকে ছুঁই, ছুঁই কিন্তু বন্যা হলে চরের বাসিন্দাদের সরে যেতে হয়। নির্ভুল তথ্যের জন্য দায়িত্বশীল কাউকে না পাওয়ায়, চরের আয়তন ও জনসংখ্যা জানা হয়নি। যেটুকুন জেনেছি, প্রতি বছরই পদ্মায় লেছড়াগঞ্জর চর একপাশে বিলীন হয়ে যায়। আরেক পাশে জমি জেগে ওঠে, তারা চলে যান। সঠিক আয়তন তাই রেকর্ড করা যায় না। এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে-এই তো নদীর খেলা। নদীভাঙন এলাকার মানুষের মুখে, মুখে, কষ্টের বুলি যুগ, যুগান্তর চলে আসছে। বিদ্যুৎবিহীন নিঝুম চরাঞ্চলের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে, দেখতে বেলা গড়াল অনেক। তাই আর দেরী না করে, নাড়ির টানে ফিরতি ট্রলার ধরতে হলো।
যোগাযোগ : ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনাল হতে বিভিন্ন পরিবহনের বাস মানিকগঞ্জ রুটে চলাচল করে থাকে। মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ যাবার জন্য মটর বাইকাররাও আছেন। ঢাকা হতে সাভারের হেমায়েতপুর হয়ে সিঙ্গাইর-ঝিটকা সড়কে হরিরামপুরের আন্ধারমানিক বাজার। সেখান থেকে প্রতি ঘন্টায় ট্রলার ছেড়ে যায় লেছড়াগঞ্জ ঘাট। মটরবাইকে, ঘোড়ার গাড়িতে পাটগ্রাম। তবে হেঁটে যাবার আনন্দ ভ্রমণে ভিন্ন মাত্রা যোগ হবে।
খাবার-দাবার : লেছড়াগঞ্জ মানিকগঞ্জ জেলার অন্তর্গত হলেও জায়গাটা দুর্গম, চরাঞ্চল। শুকনো খাবার সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।
বাস ও ট্রলার ভাড়া : ভাড়া চড়ার আগেই জায়গায় নির্ধারণ করে নিতে হবে।
সতর্কতা : প্রমত্তা পদ্মা নদী পারি দিতে হয় বলে সাঁতার জানতে হবে ও অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট। নিজ নিরাপত্তা সবসময় মাথায় রাখুন। ভ্রমণ পরিকল্পণার পূর্বে সবসময় নিজের সীমাবদ্ধতা যাচাই করে নিন।
ডালি : লেছড়াগঞ্জ, পাটগ্রাম সবই সব মৌসুমে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ডালি মেলে ধরে থাকে।
ওএফএস।