‘হিজড়াদের টেকসই উন্নয়নে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ’
সমাজের পিছিয়ে পড়া হিজড়া সম্প্রদায়কে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে সমাজসেবা অধিদপ্তর রংপুরে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তবে হিজড়াদের টেকসই উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে সমন্বিত উদ্যোগ ও সুর্নিদিষ্ট স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় সরকারি উদ্যোগের ইতিবাচক সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ হিজড়াদের। ফলে কর্মহীন হিজড়া জনগোষ্ঠীর একটি অংশ সমাজে প্রতিনিয়ত উশৃঙ্খল জীবনযাপন করছেন। এ ছাড়া তাদের কিছু কার্যক্রমে সাধারণ মানুষও অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে এবং তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করছে।
এদিকে পিছিয়ে পড়া এ হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে সমাজসেবা অধিদপ্তর এরই মধ্যে রংপুর জেলার ৮ উপজেলায় জরিপ চালিয়ে ৩৭০ জন হিজড়াকে তালিকাভুক্ত করেছে। তালিকাভুক্তদের মধ্য থেকে রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকাসহ সাত উপজেলার মোট ১৫০ জন হিজড়াকে বাছাই করে তাদের কর্মসংস্থানের জন্য ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এর মধ্যে সেলাই, কম্পিউটার, বিউটিফিকেশন ও রান্নাসহ হাতের কাজের কারিগরী প্রশিক্ষণ ছিল। তিন মাস মেয়াদি এ প্রশিক্ষণ শেষে এদের প্রত্যেককে কর্মসংস্থানের জন্য ১০ হাজার টাকা করে এককালীন আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হয়। এ কর্মসূীচর আওতায় এরই মধ্যে ১৫/২০ জন হিজড়া স্বাবলম্বী হয়েছেন বলওে জানা গেছে। তবে এদের অধিকাংশই এখন রয়েছেন কর্মহীন। ফলে ভিক্ষাবৃত্তি ও চাঁদা তোলাই জীবন-জীবিকার সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হিজড়াদের একটি অংশ দল বেঁধে বিভিন্ন সড়কের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়, বাসা-বাড়ি, যানবাহন, যাত্রীবাহী বাস ও ট্রেন এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে জোর করে চাঁদা আদায় করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। শুধু তাই নয় স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী বিশেষ করে ছাত্রী, নারী পথচারীসহ নিরীহ পথচারীদের সঙ্গে এরা নানা ধরনের অশ্লীল আচরণ করে। এসব অস্বস্তিকর পরিবেশ প্রতিরোধে সমাজসেবা অধিদপ্তর, জেলা ও পুলিশ প্রশাসন অনেকটাই নির্বিকার।
সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, রংপুর মহানগরীর প্রবেশদ্বার মর্ডান মোড়, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মোড়, বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়, মাহিগঞ্জ সাত মাথা মোড়, নববাগঞ্জ বাজার, সিটি বাজার, কাচারীবাজার এলাকাসহ মহানগরী এবং জেলা-উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হিজড়া সম্প্রদায়ের একটি অংশ দল বেঁধে এ ধরনের চাঁদাবাজি নির্বিঘ্নে চালিয়ে আসছে।
সম্প্রতি নগরীর কামাড়পাড়া এলাকায় এক বাসায় প্রবেশ করে হিজড়ার দল শিরিন বেগম নামে এক গৃহবধূকে তার শিশু সন্তানসহ জিম্মি করে ১০ হাজার টাকা দাবি করে। শেষে কিছু টাকা দিয়ে পরিবারটি ওই যাত্রায় রক্ষা পায়। এ চিত্র প্রায় সর্বত্র বিরাজ করছে।
এ ব্যাপারে রংপুর জেলা সমাজসেবা অধিপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মতিন বলেন, রংপুর নগরীর বিভিন্ন স্থানে উত্ত্যক্ত করা হিজড়ারা ভিন্ন এলাকা থেকে আসা ও বহিরাগত। এরা রংপুর জেলার বাসিন্দা নয়। হিজড়াদে প্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে এদের কাউন্সিলিং করে এসব বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে রংপুর জেলা হিজরা নেতা আনোয়ারুল ইসলাম রানা জানালেন ভিন্ন কথা। তার ভাষায় এরা রংপুরেরই সন্তান। তবে ক্ষুধা নিবারণের জন্য এসব করে। আমরা এসব আচরণ না করার জন্য পরামর্শ দেই। তবে জীবন চালানর কাজ পেলে এসব বন্ধ হবে।
রংপুর জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর জানায়, হিজড়াদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত হিজড়াদের শিক্ষা সহায়তা ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক শিক্ষার্থী ৮০০ টাকা, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থী ১ হাজার ১০০ টাকা এবং উচ্চতর শিক্ষার্থীদের ১ হাজার ২০০ টাকা হারে প্রতি মাসে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। এ কর্মসূচির আওতায় রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় ছয়জন এবং মিঠাপুকুর উপজেলায় তিনজন হিজড়া শিক্ষার্থী শিক্ষা সহায়তা ভাতা পাচ্ছে। এ ছাড়া ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ বয়স্ক ভাতা কর্মসূচির আওতায় জনপ্রতি মাসে ৬০০ টাকা হারে রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় দুইজন, পীরগঞ্জ উপজেলায় ১১ জন, মিঠাপুকুর উপজেলায় ১০ জন ও বদরগঞ্জ উপজেলায় একজনসহ রংপুর মহানগর এবং জেলায় মোট ৩৩ জন হিজড়াকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি কর্মসূচির আওতায় মাসিক ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে হিজড়াদের সংগঠন ”ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থা”, রংপুরের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম রানা জানান, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সর্বপ্রথম নিজ বাসা থেকেই নিগৃহীত হন। এরাও যে মানুষ তা বোঝাতে যুদ্ধ করতে হয়। কেবল মা ছাড়া আর কেউ এদের স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না। পরিবারের অন্য সদস্যদের কথিত ’পারিবারিক ভবিষ্যৎ নিরাপদ’ পরিবেশের স্বার্থেই তারা যেন এমন বঞ্চনার শিকার।
রংপুর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী টিটু হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন বিষয়ে বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসায় হিজড়া সম্প্রদায় আগের থেকে কিছুটা সুশৃঙ্খল। তবে এদের শারীরিক কাঠামো অনুপাতে উপযোগী কর্মসংস্থানের মতো পরিবেশ ও সুযোগ এখনো রংপুরে গড়ে ওঠেনি। এদের জন্য গার্মেন্টস শিল্পের মতো বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। এজন্য সরকারি সহায়তায় সমাজসেবা অধিদপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সবাইকে সরকারি ভাতার আওতায় এনে ভাতার পরিমাণ জীবন চলার উপযোগী করে বাড়ানো উচিৎ। সেই সঙ্গে সরকারের আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে এদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন বলেন, এদের পুনর্বাসন ও মোটভিশনের বিষয় নিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে আমরা বসেছি। সরকারও সাধ্য মতো চেষ্টা করছে। হিজড়াদের চাদাঁ তোলা বন্ধে বিভিন্ন পয়েন্টে মাঝে মাঝে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। কখনো বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে এসব নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি।
এসএন