আরবের এক টুকরো মাটি থেকে পূণ্যভূমি সিলেট
‘মমতাবিহীন কাল স্রোতে/বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে/নির্বাসিতা তুমি/সুন্দরী শ্রীভূমি/ভারতী আপন পন্য হাতে/বাঙালীর হৃদয়ের সাথে/বাণীমাল্য দিয়া/বাঁধে তব হিয়া।’ সিলেটের নান্দনিক রূপবৈচিত্র্যে মুগ্ধ ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সিলেটকে শ্রীভূমি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন কবিতায়। তিনি সিলেট আসেন ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে। তারও ২৩ বছর আগে এই মাঠিতে আসেন ওলিকূল শিরোমনি হযরত শাহজালাল (র.)।
শাহজালালের সিলেট আগমণ পরবর্তী শ্রীভূমি সিলেট রূপ লাভ করে পূণ্যভূমিতে। ৩৬০ শিষ্যসহ হযরত শাহজালালের সিলেট আগমনে এই মাটির মাহাত্ম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তারও আগে ভারতের নদীয়া জেলার নবদ্বীপ থেকে সিলেট আসেন বৈষ্ণবকূল শিরোমনি এবং সনাতন ধর্মের প্রচারক শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু। তখন থেকেই সিলেটের মাটি আরও মহিমান্বিত হয়ে উঠে। সিলেটকে বলা হতো তীর্থভূমি। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভূর পিতৃভুমি শ্রীহট্টের (সিলেট) গোলপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ। যে স্থানটি গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আখড়া দেশ-বিদেশে খ্যাত। এই প্রসঙ্গে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের বিশারদ, বিদগ্ধ সমালোচক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ বলেছিলেন, বাংলাদেশে দুইবার একদেহে অসামান্য রূপগুণের সমাবেশ হয়েছিল। একবার চৈতন্য দেহে, আর একবার রবীন্দ্র শরীরে। তবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ওলী-আওলিয়া,মহাপুরুষ ও অসংখ্য গুণীজনের পদচারণায় শ্রীভূমি শ্রীহ্ট্ট এখন পূণ্যভূমি সিলেট নামেই দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত। পূন্যভূমিতে সিলেট হযরত শাহজালাল (র.) আগমন পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী বিষয় নীচে তোলে ধরা হল।
যেভাবে সিলেট আসেন হযরত শাহজালাল(রাঃ)
মুুর্শিদ সৈয়দ আহমেদ কবির (রা.) আরবের এক মুষ্টি মাটি তোলে দেন নিজ ভাগিনার হাতে। শর্ত ছিল স্বাদে, বর্ণে ও গন্ধে যেখানে এই মাটির মতো মাটি পাওয়া যাবে, সেখানেই বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করতে হবে। যার হাতে এই মাটি তোলে দেওয়া হলো তিনি হলেন মুর্শিদ সৈয়দ আহমেদ কবির (র.) এর ভাগনা ওলিকুল শিরোমনি হযরত শাহজালাল (র.)। মামার হাতের মাটি পেয়ে ভাগনে হযরত শাহজালাল (র.) সেই মাটির দায়িত্বে নিয়োগ করেন নিজ শিষ্য শেখ আলীকে। তারপর ৩৬০ জন শিষ্য সাথে নিয়ে মাটির সন্ধানে বিভিন্ন দেশে যাত্রা শুরু করেন হযরত (র.)। বহুস্থান ভ্রমণ শেষে মাটির দায়িত্বে নিয়োজিত শিষ্য শেখ আলী মুর্শিদ সৈয়দ আহমেদ কবির (রা.) এর দেওয়া আরবের মাটির সাথে সিলেটের মাটির মিল পান। তারপর সেখান থেকেই বসতি স্থাপন করে শুরু হয় ইসলাম প্রচারের কাজ। যে কারণে সিলেটকে ৩৬০ আওলিয়ার পাদস্পর্শে ধন্য পূণ্যভূমি বলা হয়ে থাকে। আর এই পূণ্যভূমি সিলেট অঞ্চলে হযরত শাহজালাল (র.) এর মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হয়।
শাহজালাল (র.) এর জন্ম
হযরত শাহজালাল (র.) কে বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি দরবেশ। তার পুরো নাম শায়খ শাহ জালাল কুনিয়াত মুজাররদ। শাহজালাল (জন্ম তুরস্ক ৬৭১ হিঃ ১২৭১ইং- মৃত্যু; ৭৪০ হিঃ ১৩৪১ ইং) ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ ইংরেজি সালে ৩২ বৎ্সর বয়সে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজ শুরু তরেন। তবে সিলেট আগমনের সময় কাল নিয়ে যদিও বিভিন্ন অভিমত রয়েছে; তদুপরি শাহ জালালের সমাধির খাদিমগণের প্রাপ্ত পারসী ভাষার একটি ফলক লিপি হতে উল্লেখিত সন-তারিখই সঠিক বলে ধরা হয়। পারসী ভাষায় লিখিত ফলক লিপি বর্তমানে ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সিলেটে তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে সিলেট বিজয়ের পরে শাহ জালালের সঙ্গী অনুসারীদের মধ্য হতে অনেক পীর দরবেশ এবং তাদের পরে তাদের বংশধরগণ সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন। শাহজালাল ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে সিলেটেই কবর দেয়া হয়। দীর্ঘ ২৩ বছর তিনি ইসলাম প্রচার ও সাধনার কাজে নিয়োজিত থেকে এই মাটিতেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। যেখানে প্রতিদিন দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো।
দরবেশ হযরত শাহজালাল
জন্মগত ভাবে শাহ জালাল দরবেশ পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। জানা যায়, তাঁর পিতা ছিলেন একজন ধর্মানুরাগী মোজাহিদ, ইয়্যামনে ধর্ম যুদ্ধে তিনি নিহত হন এবং তার মাতার দিক দিয়ে তিনি সৈয়দ বংশের প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারীর দৌহিত্র ছিলেন।তদুপরি দরবেশ আহমদ কবির তাঁর মামা, যাঁকে শাহ জালালের শিক্ষা গুরু হিসেবে পাওয়া যায়, তিনিও তত্কালের একজন বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। আহমদ কবির যখন শাহ জালালের লালন পালনের ভার গ্রহণ করেন সেই ছোট বেলা থেকেই তাঁকে দরবেশী তর-তরিকায় জীবন যাপনের প্রণালি শিক্ষা দিয়েছেন বলেও পাওয়া যায়।
হযরত শাহজালাল (র.) এর সমাধিটির চারকোনে চারটি স্তম্ভ বিশিষ্ট প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এছাড়াও ইয়েমেনের যুবরাজ শেখ আলী এবং ভারতের গৌররাজ্যের উজির মকবুল খানসহ আরও বিখ্যাত ওলি-আওলিয়া এখানে শায়িত আছেন। দরগাগ শরিফের ভিতরে হযরত শাহজালাল (র.) এর ব্যবহৃত তলোয়ার, খরম, হরিনের চামড়া দিয়ে তৈরি যায়নামাজ, তামার প্লেট ও বাটি সংরক্ষিত আছে এখানে। বাটি এবং পেয়ালাগুলোতে আরবীতে লেখা কিছু কালাম রয়েছে। লোকদের বিশ্বাস এসব বাটি ও পেয়ালায় পানি ঢেলে পান করলে রোগ মুক্তি লাভ সম্ভব। তাছাড়া গজার মাছকে পুষতেন হযরত শাহজালাল (র.)। শাহজালাল দরগাহ শরিফের ভিতরে দীঘিতে এখনও রয়েছে সেই গজার মাছ। যেখানে এসে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা মাছগুলোর মধ্যে খাবার বিতরণ করেন।
গজার মাছ
হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার চত্বরের উত্তর দিকে একটি পুকুর রয়েছে। এ পুকুরে রয়েছে অসংখ্য গজার মাছ। এসব মাছকে পবিত্র জ্ঞান করে দর্শনার্থীরা ছোট ছোট মাছ খেতে দেয়। পুকুরের পশ্চিম কোণে ছোট মাছ বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। পুকুরে অজুর ব্যবস্থাও আছে। ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিষ প্রয়োগে পুকুরের প্রায় ৭শ’রও বেশি গজার মাছ হত্যা করা হয়। ফলে পুকুরটি গজার মাছ শূন্য হয়ে পড়ে। মরে যাওয়া মাছগুলোকে মসজিদের পশ্চিম দিকের গোরস্থানে পুঁতে ফেলা হয়। পুকুরটি মাছ শূন্য হয়ে যাওয়ার পর হযরত শাহজালাল (র.) এর অপর সফরসঙ্গী মৌলভীবাজারের শাহ মোসত্মফার (র.) মাজার থেকে ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি ২৪ টি গজার মাছ এনে পুকুরে ছাড়া হয়। বর্তমানে পুকুরের গজার মাছের সংখ্যা কয়েক শ’তে দাঁড়িয়েছে বলে জানা যায়।
জালালী কবুতর
হযরত শাহজালাল (র.) এর আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (র.) তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ তিনি তাঁকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর বা জালালী কবুতর উপহার দেন। সিলেট ও আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায় তা ওই কপোত যুগলের বংশধর এবং জালালী কবুতর নামে খ্যাত। সিলেটে জাতিধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কেউই এ কবুতর বধ করে না এবং খায় না। বরং অধিবাসীরা এদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে থাকে। শাহজালালের (র.) মাজার এলাকায় প্রতিদিন ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর উড়তে দেখা যায়। মাজার কর্তৃপক্ষ এসব কবুতরের খাবার সরবরাহ করে থাকেন।
জমজমের কূপ ও ঝরণা
লোকশ্রুতি আছে যে হযরত শাহজালাল (র.) একটি কূপ খনন করার আদেশ দিয়ে প্রার্থনা করেন আল্লাহ যেন এই কূপটিকে জমজমের কূপটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেন। এরপর তিনি লাঠি দিয়ে মাটির ওপর আঘাত করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে এই কূপটির সাথে জমজমের কূপের মিলন ঘটে গেল। তারপর এর চারপাশ পাকা করে দেওয়া হলো এবং উত্তর পার্শ্বে দুটি পাথর বসিয়ে দেওয়া হলো-যা থেকে দিনরাত পানি প্রবাহিত হয়।
ডেকচি
মাজারের পূর্ব দিকে একতলা ঘরের ভেতরে বড় তিনটি ডেকচি রয়েছে। এগুলো ঢাকার মীর মুরাদ দান করেছেন বলে জানা যায়। মীর মুরাদ ঢাকার হোসেনী দালান তৈরি করেন। যদিও ডেকচিগুলোতে রান্নাবান্না হয় না, তবুও কথিত আছে প্রত্যেকটিতে সাতটি গরুর মাংস ও সাত মণ চাল এক সাথে রান্না করা যায়। পূণ্যের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা ডেকচিগুলোতে প্রচুর টাকাপয়সা দান করেন।
দরগাহ মসজিদ
বাংলার সুলতান আবু মুজাফ্ফর ইউসুফ শাহের মন্ত্রী মজলিশে আতার আমলে ১৪০০ সালে দরগাহ চত্বরে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ১৭৪৪ সালে বাহরাম খাঁ ফৌজদারের সময় এটি পুনর্নির্মিত হয়। বর্তমানে এটি সিলেট শহরের অন্যতম একটি মসজিদ।
সবমিলিয়ে সিলেটের মানুষের কাছে হযরত শাহজালাল (র.) এখনও পরম শ্রদ্ধার, গর্বের এবং অহংকারের। তাঁর প্রতিটি স্মৃতি এখনও ভক্তিভরে স্মরণ ও শ্রদ্ধা করেন এই অঞ্চলের মানুষ। লোকবিশ্বাস মতে শাহজালাল(র.) এর কবর জিয়ারত করলে মনের বাসনা পূরণ হয়। সেই আশায় প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে পূণ্যভূমিতে সমাগম ঘটে হাজার হাজার লোকের।