কোনো খরচ নেই, উল্টো বৃত্তি দিয়ে পিছিয়ে পড়াদের আইটি কোর্স
‘বিটবার্ডস সল্যুশনস’, ঢাকার ফর্মগেটের একটু সামনে। ডেইলি স্টার ভবনের উল্টোদিকে, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এনইউবি) ভবনের পাঁচ তলায়। ঠিকানা-ইডিবি ট্রেড সেন্টার, পঞ্চম তলা, ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, ঢাকা-১২১৫। আইটি (ইনফরমেশন টেকনোলজি) খাতে দক্ষ জনবল তৈরিতে কাজ করে হাতে-কলমে। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইআইপি)’ আছে। প্রকল্পটিতে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ প্রদান করে ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)’। ২০১৫ সালে শুরু, প্রকল্পটিতে বেসিস সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দরপত্র আহবান করেছে। তাদের মধ্যে সেরা ছয়টি প্রতিষ্ঠান হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্বটি লাভ করেছে। অন্যতম ‘বিটবার্ডস সল্যুশনস’র ‘পেন্সিলবক্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’।
‘স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ বা ‘এসইআইপি’ নামের এই বিশেষ প্রকল্পটিতে শুরু থেকে কোনো খরচ দিতে হয় না কাউকে। তবে ছাত্র বা ছাত্রী প্রার্থীকে অবশ্যই কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই)য়ে অনার্স পাশ হতে হবে। চূড়ান্ত বষের ছাত্র, ছাত্রীরাও আবেদন করতে পারেন। তাদের বয়স ১৮ থেকে ৪৫ হতে হবে। কিন্তু প্রতি ব্যাচে ৩০ ভাগ নারী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভতি করা হয়। প্রতিটি ব্যাচের ছাত্র, ছাত্রী মোট ২৫ জন। তাদের নিয়মিত ক্লাস করার শর্তে পড়ানো হয়। সফল প্রশিক্ষণ লাভের পর প্রতিজনকে দিন হিসেবে উপবৃত্তির টাকা দেওয়া হয় প্রশিক্ষণের সময় সব ছেলে, মেয়েকে বিনাখরচে প্রশিক্ষণ উপকরণ দেওয়া হয়। সেগুলোর মধ্যে আছে নোটবুক, কলম, পেন্সিল, পেন্সিল কাটার, ইরেজার ও ফাইল। তাদের সবার আলাদা ল্যাপটপ থাকে। ফলে প্রত্যেকেই খুব ভালোভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহন করতে পারেন বলে জানালেন ‘বিটবার্ডস সল্যুশনস’র সহকারী ম্যানেজার ও কোর্সের সমন্বয়ক রাশেদুল ইসলাম। আরো বললেন, “কোর্স শেষে ‘বেসিস-এসইআইপি’র জবপ্লেসমেন্ট সেলের মাধ্যমে ও আমাদের সাহায্যে প্রত্যেককে চাকুরি পেতে সাহায্য করা হয়। আনন্দের বিষয়, এই কোর্সগুলো শেষে প্রায় সবাই চাকরি পেয়ে যান। যারা বাকী থাকেন, তাদের সিভি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দিয়ে ও তাদের পাঠিয়ে কোম্পানীগুলোতে আমরা যোগাযোগ করিয়ে দেই। এভাবেও কর্মজীবনে প্রবেশ করেন এসইআইপি প্রকল্পের প্রশিক্ষনার্থীরা।”
কিভাবে এই কোর্সে ভতি নেওয়া হয়? “শুরুতে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন, নানা অনলাইন মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন দেই আমরা ‘বিটবার্ডস সল্যুশনস’র ‘পেন্সিলবক্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট’ নামে।” আরো বললেন, ‘এবারের জন্য আমরা বার্তা ২৪.কম, প্রিয়.কম, কপোতাক্ষ নিউজ, বাংলা দর্পণ ইত্যাদিতে বিজ্ঞাপন দিয়েছি।’
প্রতিটি অনলাইন পোর্টালে বিজ্ঞাপনের শিরোনাম থাকে-‘সরকারি অর্থায়নে সম্পূর্ণ ফ্রি আইসিটি প্রশিক্ষণ, বৃত্তি ও চাকুরির সহায়তা আছে।’ উল্লেখ করা হয় বিস্তারিত-“অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় চলে স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইআইপি)। এই প্রকল্পে বেসিস তত্বাবধান করে। আমরা সবাই আইটিখাতে দক্ষ জনশক্তি গড়তে কাজ করছি। সম্পূর্ণ সরকারি খরচে যাতায়াত ও টিফিনসহ তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণগুলো প্রদান করি। নারী, আদিবাসী, গরীব ও প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষনার্থীদের অগ্রাধিকার আছে। মোট ৪টি কোর্স পড়ানো হয়। সপ্তাহে পাঁচ দিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত, বেলা ১টা ৩০ থেকে বিকাল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত-এই দুই শিফটে ক্লাস চলে। পেন্সিলবক্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে তিন মাসের প্রতিটি ক্লাসে উপস্থিত থাকার নিয়ম আছে। শেখানো হয় ‘গ্রাফিক্স অ্যান্ড ইউআই ডিজাইন’, ‘পিএইচপি উইথ লারাভেল ফ্রেমওয়ার্ক’, ‘মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট-অ্যানড্রয়েড’ ও ‘সার্ভার অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন ইনক্লুডিং উইন্ডোজ সার্ভার ম্যানেজমেন্ট’। প্রতিটি কোসে ক্লাসের পাঁচদিন ‘প্রফেশনাল ইংলিশ কমিউনিকেশ’ ক্লাস নেওয়া হয়।”
প্রশিক্ষণের পুরোটিই প্রযুক্তিনির্ভর। অনলাইনে পেন্সিলবক্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট www.pencilbox.edu.bd/seip-এ ক্লিক করে আবেদন করতে পারেন। সেখানে রাখা ফর্ম পূরণে করতে হবে। আবেদনপত্রের সঙ্গে, সঙ্গে মোবাইল ও ইমেইলে কনফার্মেশন ম্যাসেজ চলে যাবে। একটি ইউনিক আইডি নাম্বার পাওয়া যাবে, সংরক্ষণ করতে হয়। ভাইভা দিয়ে ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরু করতে হয়। এখন চলছে ‘বেসিস-এসইআইপি টি-৩ প্রজেক্ট’। বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য, কোর্স প্রশিক্ষকরা ছাত্র, ছাত্রীদের ভাইভা নেন। নিয়মানুযায়ী ‘বেসিস-এসইআইপি টি-৩ প্রজেক্ট’তে ভর্তির ক্ষেত্রে সবসময় নারী, দরিদ্র, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
রাশেদুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমাদের প্রতি কোর্সের জন্য দুইজন করে দক্ষ প্রশিক্ষক থাকেন। ফলে সব প্রশিক্ষনার্থীই ভালোভাবে কাজ শিখতে পারেন। তাদের বই-খাতার বিদ্যার বাইরে হওয়ায় বাস্তব জীবনে খুব কাজে লাগে।’ জানালেন, ‘আমাদের এ পর্যন্ত মোট ব্যাচে ১শ জন ছাত্র, ছাত্রী পাশ করে গিয়েছেন। তাদের ৪৮ জন বিভিন্ন কোম্পানীতে চাকুরি বা নিজেরা ফ্রিল্যান্সিং করছেন। ধীরে, ধীরে সংখ্যাটি বাড়ছে।’
জানালেন, ‘এখন বেসিস-এসইআইপি টি-৩ প্রজেক্ট-এর চারটি কোর্সে মোট ১৭৫ জন হাতে-কলমে কাজ শিখছেন। তাদেরও চূড়ান্ত মূল্যায়ন হবে। পরীক্ষা নেবেন বেসিস-এসইআইপি টি-৩’র প্রজেক্ট বাস্তবায়ন কমিটির অ্যাসেসর (পরীক্ষক)। যাদের ফলাফল ভাল হবে, তারাই সার্টিফিকেট ও ভাতা পাবেন। সিবিটিএ (কম্পিটেন্সি বেইসড ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট) হওয়ায় এই কোর্সে ও মূল্যায়নে খারাপ করার সুযোগ নেই।’
যাতায়াত ভাতার বিষয়ে বলেছেন, ‘প্রত্যেক ছাত্র ও ছাত্রী যাতায়াত এবং নাস্তা হিসেবে প্রতিদিন ১৫০ টাকা হারে তাদের উপস্থিতির ভিত্তিতে ভাতা পান। যারা সবগুলো মানের মোট ৬০টি ক্লাসই করবেন, তারাই ৯ হাজার টাকা ভাতা পান। ৮০ ভাগ উপস্থিতি না থাকলে ঠাত্র, ছাত্রীরা ড্রপ-আউট হন। তারা পরে এসইআইপি প্রকল্পের অন্য কোনো কোর্সও করতে পারেন না।’
প্রশিক্ষকদের গ্র্যাজুয়েশনসহ চারটি কোসের নিজেরটিতে অন্তত পাঁচ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। তাদের মতো এমন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের তত্বাবধানে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেওয়া কোনো সাধারণ বিষয় নয়। ফলে প্রত্যেকেই হয়ে ওঠেন দক্ষ মানব সম্পদ। তারা চাকুরি ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারেন সহজেই। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরেও কাজ করার সুযোগ নিয়ে নেন।
দারুণ সুন্দর ও গোছানো এই পেন্সিলবক্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট ঘুরে দেখা গেল, তাদের প্রতিটি ল্যাপটপই হাই করফিগারেশনের। ৩টি অত্যাধুনিক, ভালো ক্লাসরুম আছে। সবসময় ছাত্র, ছাত্রীতে মুখর থাকে। শিক্ষাথীরা নিয়মিত ক্লাস করছেন। পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা ওয়াশরুম ব্যবস্থা আছে। ফায়ার এক্সটেনগুশিয়ার ও ফার্ষ্ট এইড বক্স অছে। সার্বক্ষনিক নিরাপত্তা ব্যাবস্থা রয়েছে। প্রতিটি কোণে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। তাতেও প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হয়।
পেন্সিলবক্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন আছে, গর্বের সঙ্গে বলেছেন রাশেদুল ইসলাম। এরপর জানালেন, ‘এই ২০২২ সাল পুরোটা বছর জুড়ে আমরা কোর্সগুলোতে দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলব। আমাদেরও প্রশিক্ষণ প্রদানের চুক্তির মেয়াদ আরো বাড়বে বলে আশা করছি।’ ছাত্র, ছাত্রীদের নিয়ে সবসময় খেটে চলা এই হাস্যোজ্জ্বল যুবক বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রশিক্ষনার্থীকে গড়ে তোলার পেছনে আমাদের মৌলিক ইচ্ছে হলো, তারা সবাই যেন আয় ও রোজগার করতে পারেন। সেভাবেই কোর্সগুলো ডিজাইন করা হয়েছে।’ এরপর জানালেন, ‘আমাদের প্রত্যেক ছাত্র, ছাত্রীকে আলাদা সময় দিতে হয়। দক্ষ প্রশিক্ষকরা হাসিমুখে কাজটি করেন। বিশেষ প্রয়োজনে দিন বা রাতে অনলাইনে যুক্ত হয়ে কাজ বুঝিয়ে দেন। আমাদের পুরো বিটবার্ডস টিম তাদের সহযোগিতা করে। কারো কোনো ক্লান্তি নেই।’
রাশেদ বলেছেন, ‘এই প্রকল্পের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমার নিজেরও খুব ভালো লাগে। কেননা, আমরা আইটি সেক্টরে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছি। তৈরি করছি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটারভিত্তিক রোজগারের অত্যন্ত যোগ্য জনশক্তি। কোর্স শেষ হলেও সবাইকে নিয়মিত আয়-রোজগারের ভুবনে চলে যেতে না পারা পর্যন্ত তদারকি করে চলি। সিভিগুলো দরকারী জায়গায় পাঠানো, অনেকে কাজ ভুলে গিয়েছেন, মনে করিয়ে দেওয়া, চাকরি হলো কী-খবরগুলো রাখতে হয় আমাদের নিয়মিত।’
বলেছেন, “বিটবার্ডস সল্যুশনস’র প্রধান নির্বাহী ও ‘বেসিস-এসইআইপি প্রকল্প (টি-৩)’র সেন্টার পেন্সিলবক্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ইনচার্জ খন্দকার আলী আসগর পাভেলের মূল লক্ষ্য, প্রতিটি ছাত্র, ছাত্রীকে গুণগত মানের প্রশিক্ষণ দেওয়া। সেভাবেই সব সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত করেছেন। এমনকি প্রতিটি প্রশিক্ষনার্থীর সমস্যা জানতে প্রশিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করেন তিনি। তাদের পড়ালেখার খবর রাখেন সবসময়। দুর্বল ছাত্র, ছাত্রীর জন্য অতিরিক্ত ক্লাস ও যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তাদের এভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে কী সবসময় জানতে চান। মাঝেমধ্যে ক্লাসরুমে গিয়ে ছাত্র, ছাত্রীদের সঙ্গেও আলাপ করেন তিনি।’
তাদের সবার হয়ে সব শেষে ‘বিটবার্ডস সল্যুশনস’র সহকারী ম্যানেজার ও কোর্সের সমন্বয়ক রাশেদুল ইসলাম বলেছেন, ‘আইটি সেক্টরে দক্ষ জনবল তৈরিতে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমরা খুব খুশি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দক্ষ জনবলের চাহিদা আছে, সেই অভাবগুলো পূরণে কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের নারী, গরীব ও আদিবাসীরা এখনো যেকোনো সুযোগে আনেক পিছিয়ে আছেন। তারা আধুনিক কম্পিউটারনির্ভর প্রশিক্ষণ নেবার সুযোগই লাভ করতে পারেননি। তাদের গুণগতমানের প্রশিক্ষণ দানে পেন্সিলবক্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটও অঙ্গীকারবদ্ধ।’
পেন্সিলবক্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে কোর্সগুলোতে ভর্তি চলছে। নারী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত ও গরিব হলে দেরি না করে আজই অনলাইনে আবেদন করতে পারেন। বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ-মোবাইল ০১৭১৪১২১৭১৯, +৮৮০২৪১০১০০৯০ টেলিফোন।