চলে গেলেন এলভিস প্রিসলির রক্তের বাঁধন লিসা মেরি প্রিসলি
চলে গেলেন রক এন রোল কিংবদন্তী তারকা এলভিস প্রিসলির একমাত্র সন্তান লিসা মেরি প্রিসলি। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৫৪ বছর বয়সী এই তারকা।
তার মা প্রিসিলা প্রিসলি বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘গভীর বেদনাবিধুর হৃদয়ে আমাকে ভাগ করে নিতে হচ্ছে সেই খবরটি, যে আমার সুন্দরী ও ভালো মেয়ে লিসা মেরি প্রিসলি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘সে ছিল সবচেয়ে আবেগপ্রবণ, শক্তিশালী নারী ও ভালোবাসার দিক থেকে আমার যেকোনো সময়ে চেনা নারীদের মধ্যে সবার সেরা।’
কিংবদন্তী রক এন রোল রাজা এলভিসের মতো তার মেয়েও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি ছিলেন সবার সেরা পুরুষ পপ আইকন মাইকেল জ্যাকসন ও হলিউডের বিশ্বখ্যাত তারকা নায়ক নিকোলাস কেজের সাবেক স্ত্রী।
বিনোদন ম্যাগাজিন টিএমজেড জানিয়েছে, লিসা মেরি প্রিসলি তার লস অ্যাঞ্জলসের শহরতলী ক্যালাবাসেসের বাড়িতে রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এরপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এই সপ্তাহের শুরুতে বেভারলি হিলসের গোল্ডেন গ্লোবে অংশ নিয়েছেন এই তারকা ও মহাতারকার মেয়ে ও মহাতারকাদের সাবেক স্ত্রী।
সেখানে তার বাবার আত্মজীবনীমূলক সিনেমা ‘এলভিস’-এ অনবদ্য অভিনয় করে তরুণ অভিনেতা ‘অস্টিন বাটলার সেরা অভিনেতার গোল্ডেন গ্লোব’ জয় করেছেন। বাটলার তার আনন্দ ফিকে করে দেওয়া লিসা মেরি প্রিসলির মত্যুতে তার শোক প্রকাশ করেছেন ও তার মায়ের প্রতি নিজের সমবেদনা প্রকাশ করেছেন।
লিসা মেরি প্রিসলির বাবা ও প্রিসিলা প্রিসলির স্বামী এলভিস প্রিসলি বিশ্বকে হতবাক করে দিয়ে মোটে ৪২ বছর বয়সে চলে গিয়েছেন ১৯৭৭ সালের ১৬ আগষ্ট। তবে কোনোদিনও এতটুকু কমেনি তার খ্যাতি ও প্রভাব।
ভক্তদের আন্দোলিত করে এলভিস ও প্রিসিলা প্রিসলির একমাত্র সন্তান এই কন্যার জন্ম হয়েছে টেনেসি অঙ্গরাজ্যের মেমফিস শহরে ১৯৬৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি।
এলভিসের সকল সম্পদ ও বৈভবের মালিক ছিলেন লিসা মেরি প্রিসলি। তিনি তার বাবার বিখ্যাত বাড়ি ও তার দর্শনে আগত পর্যটকদের বিখ্যাত বিনোদন এবং ভালোবাসার স্থান গ্রেসল্যান্ড ম্যানশনের মালিক হয়ে ছিলেন শহরটিতে। তিনি তার বাবাকে হারান মোটে নয় বছরের শিশু অবস্থায়।
বাবাকে হারানোর দীর্ঘদিন পরে, তার খ্যাতি, কান্না ও ভালোবাসার জীবনে বন্দী থাকতে, থাকতে ২০০৩ সালে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে লিসা মেরি প্রিসলি নিজের গানের ক্যারিয়ার শুরু করেন। তার প্রথম অ্যালবামটির নাম হলো ‘টু হুম ইট মে কনসার্ন’। তার দুই বছর পর বের করেছেন ‘নট হোয়া’ট। তার এই দুই অ্যালবামের দুটিই বিলবোর্ডে সেরা ২০০ অ্যালবামের বাছাই তালিকাতে প্রথম ১০ এর তালিকাতে ছিল। সাত বছর বিরতি দিয়ে ২০১২ সালে তিনি প্রকাশ করেছেন তার তৃতীয় অ্যালবাম ‘স্টর্ম অ্যান্ড গ্রেস’।
মাইকেল ও কেজকে ছাড়া আরও দুটি বিয়ে করেছেন এই নারী। ১৯৮৮ সালের ৩ অক্টোবর ভালোবাসার প্রথম সংসারটি বেঁধেছিলেন এলভিসের মেয়ে। এই ঘরে তার একটি মেয়ে ও একটি ছেলে আছে। তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে পপ স্টার মাইকেল জ্যকসনের সঙ্গে ১৯৯৪ সালে সারা দুনিয়াকে আলোচিত করে। তার মাত্র ২০ দিন আগে তার প্রথম স্বামী সঙ্গীতবিদ ড্যানি কিয়োর সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৯৬ সালে মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে তিনি বিবাহ বিচ্ছেদ করতে বাধ্য হন। তখন মাইকেল জ্যাকসন শিশুদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগের মামলাগুলোর মোকাবেলা করছিলেন। এরপর আবার ছয় বছর একাকী জীবনযাপন করেন লিসা মেরি প্রিসলি। তিনি তার বাবার প্রবল ভক্ত এবং হলিউডের অন্যতম মহাতারকা নিকোলাস কেজকে ২০০২ সালের ২৫ নভেম্বর বিয়ে করলেন। তবে চার মাস পড়েই আদালতে বিচ্ছেদের আবেদনের ফাইল দাখিল করলেন কেজ।
চার বছর পর ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারি নিজের গিটার শিক্ষক ও গানের প্রযোজক মাইকেল লকডডকে বিয়ে করেন লিসা মেরি প্রিসলি। ২০২১ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়েছে। সারাজীবনই গানের মানুষদের পেছনে ঘুরেছেন এলভিসের একমাত্র সন্তান, অনিন্দ্য সুন্দরী ও বিরাট বড়লোক লিসা মেরি প্রিসলি।
তার প্রথম ঘরে জন্মেছে একমাত্র ছেলে সন্তান বেনজামিন কিয়ো। আরও তিনটি মেয়ে আছে লিসার। তবে তার ছেলেটি ২০২০ সালে মোটে ২৭ বছর বয়সে মাকে ছেড়ে পৃথিবী থেকে চলে যায়।
লিসা মেরি প্রিসলির ছেলে আত্মহত্যা করেছে বলে জানিয়েছেন তাদের লস অ্যাঞ্জেলস কাউন্টির করোনার বা শবদাহকারক। তার বড় বোনটি এখন ৩৩ বছরের, নাম রাইলি কিয়ো। তিনি একজন অভিনেত্রী। তার মায়ের আরও দুটি যমজ মেয়ে আছে শেষ বাবার ঘরে। নাম হার্পার ও ফিনলে লকউড। দুজনেরই ১৪।
এই মঙ্গলবার সর্বশেষ আলো ছড়িয়েছেন তাদের মা লিসা মেরি প্রিসলি। নিজের মাকে নিয়ে তিনি গিয়েছেন গোল্ডেন গ্লোবের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে, তাদের যুক্তরাষ্ট্রেরই বিখ্যাত বেভারলি হিলসে। তার বাবাকে নিয়ে বানানো ছবিটির পুরস্কার জয় করার অনুষ্ঠানে, অন্যতম অতিথি হিসেবে। সেখানে পুরস্কার জয় করে বাটলার তাদের বলেছেন, ‘আমি আপনাদের দুজনকেই ধন্যবাদ জানাই।’ আর এলভিসের জন্য বলেছেন, ‘আপনাকে চিরকাল ভালোবাসি এলভিস।’ তার এই আবেগময় বক্তব্য এলভিস প্রিসলির বিধবা বিশ্বখ্যাত স্ত্রী ৭৭ বছর বয়সী প্রিসিলা ও ৫৪ বছরের লিসাকে কাঁদিয়েছে।
এরপর ফিরে এসে নিজের ইনস্ট্রাগ্রাম পেইজে এলভিস প্রিসলির স্ত্রী ও এখন বয়সের প্রান্তসীমায় চলে আসা প্রিসিলা প্রিসলি অ্যাস্টন বাটলারকে আশীর্বাদ করেছেন ও বলেছেন, ‘অ্যাস্টন বাটলার এলভিসের ওপরে দুই বছর পড়ালেখা করেছে ও সহজেই সে হয়ে গিয়েছে তার অভিনয়ের জাদুতে। আমি তোমার জন্য অত্যন্ত গর্বিত ও তোমার ওপর খুব খুশি। অ্যাস্টন তোমার ওপর আমার আর্শীবাদ থাকলো। এই অবিশ্বাস্য মেধাবী পুরুষটিকে যেভাবে বাজ লুম্যান তার ক্যামেরায় বন্দী করেছেন সেটিও তোমার মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভ করলো।’
এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে সারা দুনিয়া থেকে আসতে সক্ষম এলভিস প্রিসলির ভক্তরা একে, একে জড়ো হয়েছিলেন তাদের আধুনিক তরুণদের গানের রাজার স্মরণে আয়োজিত টানা পাঁচদিনের ‘পার্কস এলভিস ফেস্টিভ্যাল’-এ। ১৯৯৩ সাল থেকে প্রতি জানুয়ারির শুরুতে অস্ট্রেলিয়ান নিউ সাউথ ওয়েলসে এই উৎসব, গানের আয়োজন, এলভিসের প্রদর্শনগুলোর প্রদর্শনী ও তাকে ভালোবাসার আয়োজনটি হয়।
একটি অবিশ্বাস্য ও অসাধারণ জীবন কাটিয়েছেন তিনি একজন নারী হিসেবেই। ছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা গানের আইকনের একমাত্র সন্তান। আর আরেকজন সেই গানের আইকনের একসময়ের জীবনসঙ্গীনী। তবে আজীবন মাটির দিকে তাকিয়ে চলেছেন, এ বড় অবিশ্বাস্য। নিজের জীবনের নানা প্রান্তের ঘটনায় ব্রিটেনের ইস্ট সাসেক্সের অংশকেও স্বীকৃতি দিয়েছেন স্মৃতির খাতায়। ‘আমি হতে চেয়েছিলাম স্বাভাবিক। নিজের ওপর দিয়ে যথেষ্ট গিয়েছে। অনেক ভাবতে হয়েছে। আমাকে অনেক অত্যাচার সইতে হয়েছে। চারপাশে অনেক কিছু হয়েছে যেগুলো নিয়ে ভেবেছি। তারা ছিল ও তারা অনেক বেশি ছিল। ফলে আমাদের শূণ্য থেকে শুরু করতে হয়েছে, আমিও কোনো জায়গা থেকে শুরু করতে চেয়েছি। আমি আমার মাথা থেকে ভেবেছি ও লিখেছি এবং রেকর্ড করেছি। এজন্য আমাকে যত দূর যেতে হয় যেতে হয়েছে। আমার ভাবনা, লেখা ও রেকর্ডগুলোকে ভালোবেসেছি এবং আমি বাড়িটি কিনেছি’ বলেছেন তিনি।
এলভিসের উত্তরাধিকারের একমাত্র ধারক লিসা মেরি প্রিসলি যাকে তারা ডাকতেন ‘প্রিসলি’-এই একমাত্র সন্তানটি এলভিস ও প্রিসিলা প্রিসলির, তার বাবাকে সিনেমাগুলোতে নিয়ে আসার বিষয়েও গভীরভাবে ভেবেছেন। তিনি হলেন সেই মানুষটি, যার গুন্ঠিত চোখজোড়া ছিল, নিষ্পাপ হাসিগুলো চমকে দিয়েছে, নম্র, নীচু ও তিরিক্ষি কন্ঠস্বর ছিল তার এবং তার বাবাকে অনুসরণ করে গিয়েছেন পেশাদারভাবে, নিজের রক গানের অ্যালবামগুলো ২০০০’র দশকগুলোতে প্রকাশ করে। এমনকি বাবার সঙ্গে নিজের সরাসরি সঙ্গীতের বাঁধন বেঁধেছেন। এলভিস প্রিসলির রেকর্ডগুলোর মধ্যে ‘ইন দ্যা গেহটো’ ও ‘ডোন্ট ক্রাই ড্যাডি’ গানে নিজের কন্ঠকে তিনি ভাগ করে নিয়েছেন। অর্থপূর্ণ দ্বৈত একটি গানে তার বাবাকে নিজের মা গ্লাডিস প্রিসলির একেবারে অল্প বয়সে এতিম করে চলে যাওয়ার দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
২০১২ সালে দেওয়া বার্তা সংস্থা এপি কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে লিসা মেরি প্রিসলি বলেছেন, ‘বাবার সবই ছিল আমার জীবনে, বাবা আমাকে সবভাবেই প্রভাবিত করেছেন। এটি এমন কিছু নয় যেটি আমি এখন শুনলাম ও সেটি আলাদা হলো। আমাকে সবসময়ই হয়ত ঘনিষ্টভাবে শুনে যেতে হয়েছে ও হচ্ছে। আমাকে তার বিষয়গুলোতে নিয়মিতভাবে থাকতে হচ্ছে এবং সবসময়ই তার ভালো চেয়েছি, তার সবচেয়ে গুণমুগ্ধদের একজন হয়েছে। তিনি সবসময় আমাকে উদ্দীপ্ত করেছেন। এখনো তাই।’
ওএফএস/এএস