শিক্ষায় কতটা এগোলাম, কতটা এগোতে পারতাম
স্বাধীনতার পর থেকে এ র্পযন্ত আমাদের শিক্ষা কতটা এগোলো, কতটা এগোতে পারত,সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতা মোকাবেলা করে এগিয়েছে, তার একটা খতিয়ান নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন এজন্য যে অন্যান্য অনেক ক্ষেত্র থেকেও শিক্ষায় এর অভিঘাতটা বহুমুখী এবং শক্তিশালী। যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, ব্যবসা-বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, ব্যবসায়ীরাও একটা সময়ে এসে রাজনীতিতে তাদের আসন পাকা করেছেন। যোগাযোগ, স্বরাষ্ট্র, কৃষি ও প্রতিরক্ষাতেও বিনিয়োগের ধারাবাহিকতা দেখা গেছে,নানাভাবে তা বেড়েছেও। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে সেই উদ্যম বা আগ্রহ চোখে পড়েছে কম।
মোটা দাগে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাস্তবতাগুলোর একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করলে কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব পায়। যেমন, পঞ্চাশ বছরের রাজনীতি। স্বাধীনতার পর থেকে অনেক ধরণের মানসিকতার, রাজনৈতিক মত ও চিন্তার সরকার এদেশ পরিচালনা করেছে। ১৯৭৫ সালের আগস্টের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র, ওই দিনের পর থেকে এলো সামরিক শাসন, যা মাঝে মাঝে ছদ্মবেশী গণতন্ত্রের মোড়কেও ১৯৯০ এর গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত চলেছে। এরপর বাংলাদেশ গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন করল, কিন্তু ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর আবার সামরিক শাসনে ফিরে গেল। গণতন্ত্র আবার ফিরে এল ২০০৯ এর শুরুতে। তবে গণতন্ত্র বলতে বহুদলের অংশগ্রহণে একটি কার্যকর ও প্রাণবন্ত জাতীয় সংসদ খুব অল্প সময়ের জন্যই এদেশের মানুষ পেয়েছিল। এর ফলে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা, নানা বিষয়ে জাতীয় কথোপকথন ও গঠনমূলক আলোচনার অভাবটা প্রকটভাবেই থেকে গেছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি। এই অগ্রগতির একটি প্রতিফলন অবশ্য পড়েছে পুঁজির অধিষ্ঠানে, নানান ক্ষেত্রে বাজার সৃষ্টিতে,পণ্যায়নের একটা সার্বিক আবহ তৈরিতে এবং সামাজিক বৈষম্যের প্রকট আকার ধারণের ক্ষেত্রে। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে, যার ফলে সামাজিক গতিশীলতা বেড়েছে।
কৃষি উন্নয়ন। যার ফলে প্রান্তিক কৃষকও অনেক ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে উৎসাহী হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সমাজের আগ্রহ বাড়া ও অঙ্গীকার সুদৃঢ় হওয়া। এর ফলে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে অগ্রগতি। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও পর্যটন সেবা খাতসহ অনেক অঞ্চলেই ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সমাজ আরও গতিশীল হয়েছে, মানুষে মানুষে, অঞ্চলে অঞ্চলে দূরত্ব কমেছে। শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য এর প্রয়োজন ছিল। সাম্প্রদায়িকতার উত্থান, যা শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে নেতিবাচক, দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রাখছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে এসব প্রতিটি বিষয় দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য-দু’ধরণের অভিঘাত রেখেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে এবং আগ্রহে প্রস্তুত করা কুদরত-এ-খোদা শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন বাস্তবায়িত হলে আমাদের শিক্ষাচিত্র উজ্জ্বল হত, আমাদের আকাঙ্ক্ষা অনেকটাই মিটতো, কিন্তু ১৯৭৫ পরবর্তী সরকারগুলি সেই প্রতিবেদন হিমাগারেই রেখে দিল শিক্ষা চলল গতানুগতিক পথে। ভাগ হয়ে গেলে তিনি ধারায়, এবং ফেরার কোনো পথ না রাখায় দেশ একটা বড় বিপর্যয়ের সামনে পড়ল। পৃথিবীর আর কোনো দেশের শিক্ষা এভাবে তিন পায়ের ওপর ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে কিনা, কে জানে। সামরকি এবং আধা সামরকি সরকারগুলির আমলে সাম্প্রদায়িকতা তীব্র রূপ ধারণ করে, যা উদারনৈতিক, ভবিষ্যৎমুখী শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে একে অনেকটাই পেছনে নিয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা চলেছে কোনো শিক্ষা নীতি ছাড়াই। আওয়ামী লীগ সরকার অনেক আগ্রহে-আয়োজনে একটি শিক্ষানীতি তৈরি করে, যা ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীতও হয়। কিন্তু এটি অনেকটা কাগজে-কলমেই থেকে গেছে।
অর্থনীতিতে উল্লম্ফন ঘটলেও শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ এই পঞ্চাশ বছরে আমাদের জিডিপির ২ শতাংশের বেশি বাড়েনি। বড় বিনিয়োগ না হলে শিক্ষাক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন হবে না এবং বড় পরিবর্তন না হলে ২০৪১ সাল, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব--এসব কিছুর জন্য আমরা প্রস্তুত হতে পারব না। তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ না বাড়লেও সামাজিক বিনিয়োগ বেড়েছে। কোনো পরিবারই এখন একেবারে নি:স্ব, দরিদ্র পরিবারও সন্তানদের শিক্ষাহীন রাখতে চায় না। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লে এই সন্তানরা নিজেদের ভবিষ্যৎতা দাবী করে নিতে পারবে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণও শিক্ষায় বড় অবদান রেখেছে, কারণ কর্মজীবী নারী শিশুদের শিক্ষিত করতে প্রত্যয়ী হন। দেশে পণ্যায়ন সংস্কৃতির প্রচলন হলে শিক্ষাতেও তার প্রভাব পড়েছে। শিক্ষা এখন বাজারমুখি, শিক্ষার সনদগুলির মূল্য এখন পণ্যের বাজার নির্ধারণ করে। এটি ভবিষ্যতের জন্য সুসংবাদ নয়।
এসব প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতা সত্তেও পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে শিক্ষা এগিয়েছে যতটা না মানের দিক থেকে, তার থেকে বেশি পরিমাণ ও বিস্তারের দিক থেকে। এই বৃদ্ধির একটি বিস্তারিত পরিসংখ্যানচিত্র দেয়া গেলে বিষয়টি পরিস্কার হত, কিন্তু স্থানাভাবে তা দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও বলা যায়, প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এই বৃদ্ধি বা বিস্তার ১৯৭১ সালের বিজয়ের মাস থেকে এখন পর্যন্ত বিস্ময়কর। ১৯৭১ সালে সকল ধরণের প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল ২৭,১৩৪; এখন তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪০,০০০ এর ধারে কাছ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বিশবিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬; ২০২২ সালে সেই সংখ্যা ১৬০ বা তারও বেশি। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সংখ্যাও বেড়েছে, তবে অনুপাতের হিসাবে অনেক বেশি। পাঠ্য বিষয়, শিক্ষাসূচি, ও বিশেষায়িত পাঠক্রমের ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির চিত্রটি উর্দ্ধমুখী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা, প্রকৌশল ও স্থাপত্য, কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রেই এখন শিক্ষার প্রচুর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চামড়া প্রযুক্তি, সিরামিক, গ্রাফিক শিল্প অথবা টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের মতো বিষয়েও এখন বাংলাদেশে উচ্চতর পর্যায়ে পাঠ দেয়া হয়। তথ্য প্রযুক্তি, বিশেষ করে কম্প্যুটার ও ইলেকট্রনিক ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নতিটা হয়েছে প্রকৃতই আশাব্যঞ্জক। সরকার সারা দেশের স্কুলগুলিকে তথ্য-প্রযুক্তিসক্ষম করতে, সেগুলিতে ইন্টারনেট সংযোগ ও সেবা দেয়ার জন্য একটি উচ্চাভিলাশী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের--বিশেষ করে মেয়েদের--বৃত্তি ও উপবৃত্তি বাড়ানো হয়েছে, দশম শ্রেণী পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ আরো কার্যকর ও নিবিড় করা হচ্ছে।
অর্জনের তালিকাটা যথেষ্ট দীর্ঘ। পঞ্চাশ বছরে অনেক দেশ হয়তো আমাদের থেকে অনেক বেশি এগিয়েছে। এই এশিয়ারই অনেক দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি ঈর্ষনীয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল একটা ভগ্নাংশ থেকে, পূর্ণ সংখ্যা থেকেও নয়। দারিদ্র, ক্ষুধা এবং কর্মহীনতা এমনই প্রবল ছিল যে এক বিশাল সংখ্যক পরিবার পড়াশোনাকে বিলাসিতা হিসেবেই দেখত। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এতদূর আসতে পারাটা সামান্য কথা নয়। সব চাইতে আশ্চর্যজনক যা, সেই কঠিন, ভাঙ্গা-পা নিয়ে উঠে দাঁড়াবার সময়ে বঙ্গবন্ধু এক দূরদর্শী পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন। কুদরত-এ-খোদা শিক্ষা কমিশন গঠন ছিল তার প্রথম পর্যায়। তিনি শিক্ষায় যে বড় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কমিশনের প্রতিবেদনে তা-ই লিপিবদ্ধ হয়েছিল জিডিপির ৫-৭ ভাগ! অবাক, বঙ্গবন্ধুর সেই সাহসী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন আওয়ামী লীগ সরকার এই এতগুলো বছরও করতে পারেনি। পারলে আমাদের শিক্ষার মান আকাশমুখী হতে পারত।
আমরা সবাই স্বীকার করি, শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। এখন অর্জন ঘটাতে হবে মানের ঘরে। মানহীন শিক্ষা নিয়ে আমরা এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদের জায়গাটা ধরে রাখতে পারব না, এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা। মানের উন্নতিতে একটা উল্লম্ফন ঘটাতে হবে পাঠ্যক্রম, পাঠ্যবই, শিখন, শিক্ষাদানসহ শিক্ষাক্রমের সকল ঘওে; মানের উন্নতি ঘটাতে হবে ভাষাশিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, গণিত ও অন্যান্য সকল বিশেষায়িত শিক্ষায়; শ্রেণীকক্ষ, পাঠাগার, গবেষণাগারসহ সকল ভৌত কাঠামো ও সুযোগ সুবিধায়। এ কথাটি সারা বিশ্বে স্বীকৃত যে ভাল শিক্ষক ছাড়া ভাল শিক্ষা দেয়া, ভাল শিক্ষার্থী তৈরি করা সম্ভব নয়। আর ভাল শিক্ষক পেতে হলে শিক্ষকদের বেতন ভাতা, সুযোগ সুবিধা প্রচুর বাড়াতে হবে। যদি একদিন দেখা যায়, পেশার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ও গবেষণা এবং শিক্ষকতাকে এক নম্বরে রাখছেন, তাহলে বুঝতে হবে আমরা সত্যিকারভাবে উল্লম্ফনটা ঘটাতে পারছি।
মানের উন্নতির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা। সেটি আমাদের না থাকার কথা নয়। কিন্তু এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে শিক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়িয়ে যাতে সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খরচের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সংকুলান হয়। সেই সঙ্গে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা ও বাস্তবায়নদক্ষতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বর্তমানে যেভাবে আমরা শিক্ষা দিচ্ছি, যা মুখস্থ-নির্ভর, পরীক্ষাসর্বস্ব, নিরানন্দ এবং অসৃজনশীলই রয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন, তা আমূল বদলাতে হবে।
কোচিং বাণিজ্য এবং নোট-বই, গাইড বই এ দেশে কোনোদিনই নিষিদ্ধ করা যাবে না, যদি না আমরা শিক্ষার পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন আনতে পারি। আমাদের এমন শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োজন, যাতে শ্রেণীকক্ষেই সব শিক্ষা দেয়া হয়ে যাবে। তখন কোচিং বাণিজ্য এমনিতেই তার দোকানে ঝাঁপি ফেলবে। সম্ভব, এ সবই সম্ভব। এবং তিনটি ধারাকে একটি মূল ধারাতে সন্নিবেশিত করাও সম্ভব। কিন্তু তার জন্য বঙ্গবন্ধুর সাহস, নিষ্ঠা, এবং দূরদৃষ্টির প্রয়োজন। সেই সম্ভাবনাও এদেশের আছে। আরও পঞ্চাশ বছর পর কেউ যখন বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে লিখবেন, তিনি হয়তো ওই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন দিয়েই শুরু করবেন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ