নদী ভাঙন রোধে বেড়িবাঁধ নির্মাণ জরুরি
নদী ভাঙন খুবই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক একটি ব্যাপার। আগের দিনে নদী থেকে অনেক দূরে ঘরবাড়ি তৈরি হতো। ছোটবেলায় দেখেছি ট্রেন অথবা বাসে করে কোথাও যাচ্ছি। সেখান থেকে অনেক দূরে গ্রাম দেখা যেত। সড়ক অথবা ট্রেন লাইনের ধারে কাছে বসতবাড়ি ছিল না। পথেরপাঁচালী ছবিতে একটি খুব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আছে। অপু ও দুর্গা কাশবনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। ট্রেন চলছে। আশেপাশে কোনো গ্রাম নেই। এখন থেকে ২০০ বছর আগে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা মিলে লোকসংখ্যা ছিল ২ কোটি।
১০০ বছর আগেও ছিল ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটির মতো। ব্রিটিশরা যখন বিদায় হলো তখন ছিল ৪ কোটির মতো। পাকিস্তানিদের বিদায়ের সময় ছিল ৭ কোটি। বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি। এখন নদী নদীর জায়গায় আছে। কিন্তু মানুষ বেড়ে গিয়ে উঠেছে নদীর ধারে। বসতবাড়ি গড়ে তুলেছে। নদী মুখভার করেছে ও নদী ভেঙেছে। তাহলে আপত্তি কেন? নদীর ভাঙন ঠেকাতে চেষ্টা করা দরকার এবং সেটি করতে হবে।
আমেরিকার মিসিসিপির নদীর পাড়ে শহর আছে। শিল্পকারখানা আছে। ইউরোপে আছে। ইংল্যান্ডে আছে। ফ্রান্স ও জার্মানিতে আছে। এসব জায়গায় নদী কখনো ভাঙে না। কারণ নদী যেন না ভাঙে সেজন্য পাড়গুলি বাঁধানো আছে। কিন্তু আমাদের এখানে তথাকথিত পরিবেশবাদী বুঝে না বুঝে হই চই করে। নদী ভাঙন ঠেকাতে তাদের মাথা গরম হয়ে যায়। তারা কিন্তু আদৌ জানে না নদী কেন ভাঙে এবং তার রোধ করা সম্ভব। প্রথমত কারণ ও প্রতিকার জানতে হবে।
আমি মনে করি, সরকারকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। নদী রক্ষায় অধিক বিনিয়োগ করতে হবে। সরকার বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ করছে। ৫০০ কোটি টাকা বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ করুক। এটি তো খুব বড় অংক নয়। উপকূলে যে বেড়িবাঁধ আছে সেগুলি সংস্কার করে দিলেই হয়ে যায়। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সরকারকে দোষারোপ করেও লাভ নেই। কারণ এসব ক্ষেত্রে বরাদ্দ যে হয় না তা কিন্তু নয়। কিন্তু সেই বরাদ্দ আসলে কোথায় যায় সেটি কারও জানা নেই।
নদীমাতৃক দেশ আমাদের। নদী হচ্ছে প্রাণ। নদী হচ্ছে মা। আজকাল দেখা যায়, বাবা মায়ের প্রতি সন্তানেরা উদাসীন। মা-বাবা সন্তানের কাছে অবহেলিত। সম্প্রতি দেশে একটি আইন হয়েছে যে, সন্তান বাবা-মা কে না দেখলে পুলিশ অথবা ম্যাজিস্ট্রেট ধরে নিয়ে যেতে পারে। ছেলের ঘরে খাবার। কিন্তু কোনো ছেলেই খেতে দেয় না মা-কে। এইকথাগুলো বলার কারণ হলো, জ্যান্ত মায়ের প্রতিই আমাদের সম্মান নেই, যত্ন নেই। যে মা অন্তত কাঁদতে পারে, অভিশাপ দিতে পারে। নদী নামক মায়ের অভিশাপ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। কাজেই তখন ভাঙে কিংবা সে আস্তে আস্তে মরে যায়।
আমাকে যখন কেউ বলে, নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি বলি, আপনি শুকিয়ে ফেলছেন বলেই নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এখন নভেম্বর চলছে। এখন থেকে অথবা সামনের মাসে কিংবা জানুয়ারিতে বাংলাদেশের যেখানেই যান না কেন! দেখা যাবে নদীতে পাম্প বসিয়ে পানি তুলে ধান ক্ষেতে দেওয়া হচ্ছে এবং নদীতে ধান চাষ হচ্ছে। নদীকে চাষাবাদের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবেই নদীগুলো আস্তে আস্তে শুকিয়ে গিয়ে একসময় মরে যাচ্ছে।
লেখক: পানিসম্পদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
এসএন