অর্থনীতির মন্দাভাব কাটিয়ে উঠাই এখন চ্যালেঞ্জ
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কয়েক মাস ধরে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছে বাজারে। সব ধরনের পণ্যেরই দাম বাড়তি আছে। এর ফলে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয় ধনী-গরিব নির্বিশেষে গড় হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে গরিব মানুষের উপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি থাকে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের আয় না বাড়লে প্রকৃত ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা উপরে থাকা বিপুল সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়।
এবছর রপ্তানি আয় কমেছে। রেমিট্যান্স কমে গেছে। ব্যাংক রিজার্ভও সংকটজনক। অর্থনীতির এই চ্যালেঞ্জের বড় কারণ হলো বিশ্ব বাজারে অর্থনীতির প্রভাব অর্থাৎ মন্দাভাব। দেশে জ্বালানি তেল ও ভোগ্য পণ্যের দাম বেড়ে সার্বিকভাবে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের ওপর চাপ পড়েছে। আবার রপ্তানি বাড়লেও তা আমদানির মতো নয়। প্রবাসী আয়ও বাড়েনি, বরং তা কমেছে। ফলে দেশে ডলারের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এতে বেড়ে গেছে ডলারের দাম।
আমরা জানি দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে করোনা মহামারির (কোভিড-১৯) ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি তবে চেষ্টা করেছে। মানুষের আয় কমেছে, মানুষ বেকার হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে বহু মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, ২০১৭ সালে দেশের ২২ থেকে ২৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। করোনা মহামারির কারণে সেটি বেড়েছে। প্রায় তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। করোনার আগে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, করোনার মধ্যে তাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। বর্তমানে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির চাপটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয় হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগের পরও দেশে ডলারের সঙ্কট কাটছে না। অনেক ব্যাংক এখন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ১০০ টাকার বেশি পর্যন্ত আদায় করছে। আর কোনো কোনো ব্যাংক ডলারপ্রতি আরও টাকা দিয়েও প্রবাসী আয় পাচ্ছে না। ফলে সংকট কমার পরিবর্তে যেন আরও বেড়েই চলেছে। তবে আমি এটিকে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে দেখছি না। অর্থনৈতিক স্ট্যাবিলিটি অর্জন হলে তখন এই সমস্যা থেকে অনায়াসেই আমরা বের হয়ে আসতে পারব।
পণ্য আমদানি কমলেও গেল অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়ে রেকর্ড হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রতিফলন হয়েছে আমদানি ব্যয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমদানি ব্যয় কখনো এত বেশি হয়নি। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো গেল অর্থবছরে পুরোটা সময় ধরে বৈশ্বিক বাজারে পণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি।
দেশের অর্থনীতিতে যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে, তার প্রভাব শেয়ারবাজারেও পড়েছে। জ্বালানিখাতে লোকসান কমাতে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে এবং সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারা দেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং শুরু হয়েছে। সেইসঙ্গে বিশ্বে জ্বালানি তেল এবং তরলিকৃত গ্যাস বা এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার এর আমদানি কমিয়েছে। এর ফলে শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
খেলাপি ঋণের পাহাড় ক্রমেই বৃহৎ হচ্ছে। মহামারি করোনায় সৃষ্ট অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় ঋণের কিস্তি না দিয়েই খেলাপি নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।
অর্থনীতি স্থিতিশীলতার জন্য দুটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া। মূল্যস্ফীতি বেশি হলে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। ফলে একে সংযত রাখার জন্য দৃষ্টি দিতে হবে। দ্বিতীয় হচ্ছে (আমদানি-রপ্তানি)। কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকের মধ্যে ডলারের দামের পার্থক্য বেশি, এটি কমিয়ে আনতে হবে। না হলে অবৈধপথে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো বেড়ে যাবে। মনে রাখতে হবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের শক্তিশালী উৎস রেমিট্যান্স। অনেক শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছে। কিন্তু বৈধপথে সে তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে না। সেইসঙ্গে দুর্নীতি ও পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
এসএন