রিজার্ভ কমলে বড় চাপ অবশ্যম্ভাবী
গত এক সপ্তাহে ইউরো এবং ডলারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। কারণ, দেশে ভালো রেটে ডলার-ইউরোর বিপরীতে টাকা পাওয়া যাচ্ছে, সঙ্গে বাড়তি শতকরা ২ দশমিক ৫ ভাগ প্রণোদনা তো আছেই। যার ফলে জুলাই মাসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। কিন্তু তার বিপরীতে কেন রিজার্ভ কমছে? বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায়, অনেক উন্নত দেশ অর্থনৈতিক বিপর্যের মুখে রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারকে সংকুচিত করে ফেলেছেন।
ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও আবারও ঋণ নিচ্ছেন। অনেক দেশ সময় মতো ঋণ পরিশোধ না করার কারণে করোনার মধ্যেও বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের চাপের মুখে আছে। গত দুই বছরের করোনার ধাক্কায় সমগ্র বিশ্ব ছিল অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখে। আজ থেকে প্রায় ৪৩ বছর আগে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দার পর থেকে অর্থনীতিতে এত বড় আঘাত আর আসেনি। তবে আর্থিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয় প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা উন্নত দেশগুলোতে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত অনেক দেশ, যাদের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে কম, আর্থিক মন্দার কবল থেকে নিজেদের অনেকটাই সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিল। কিন্তু বিশ্বজুড়ে করোনার প্রভাব ছিল সমান্তরাল ও অভাবনীয়।
ডলার টাকার হিসাবে অনেক আগে থেকেই দাম বাড়ছে। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। রিজার্ভ কমে গেলে একটি চাপ আসবে অবশ্যম্ভাবীভাবেই। আগামীতে হয়তো রপ্তানি বাড়তে পারে। রপ্তানিকারকরাও বিনিময়ে বেশি টাকা পাবে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে এবং বেড়ে গেছেও। সরকারের রাজস্ব আয় ভালো বলা যাবে না। এখনো ১৪ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশের মতো গ্রোথ হয়। নমিনাল জিডিপির হার আনুপাতিক হারে বাড়ছে না। এই সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি। খাদ্যমূল্য অন্তর্জাতিক বাজারে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বেড়ে যাওয়াতে আমাদের উপর অন্যরকম চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। দেশে মূল্যস্ফীতির কারণ হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই উৎপাদন ব্যাহত হবে। একদিকে যেভাবেই হোক সম্ভব মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা এবং অন্যদিকে যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থাৎ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় রাখা লাগবে।
করোনার এ নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বিশ্ব যখন উম্মুখ ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেই পুনরুদ্ধারের গতিকে শ্লথ করে দিয়েছে অনেকটাই। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি নামক এক অর্থনৈতিক খড়গ আরোপ করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোতে সবার উপরে রয়েছে ‘মূল্যস্ফীতি কেন হয় এবং কীভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করা যায়, এ নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট ধোঁয়াশা। বিশ্বের সিংহভাগ বৈদেশিক বাণিজ্য বা আমদানি-রপ্তানি হয় ডলারের বিনিময়ে। ফলে বাংলাদেশ, তুরস্ক, মিসর ও ভারতের মতো যেসব দেশ কাঁচামাল আমদানি করে তারা বর্তমান ডলারের ঊর্ধ্বগতির কারণে কোণঠাসা হয়ে গেছে। এতে অধিকাংশ আমদানি করা পণ্যের দাম স্থানীয় বাজারে রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে, যার একমাত্র কারণ মুদ্রাস্ফীতি-মূল্যস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি বলতে অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি কী বোঝানো হয়। অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে গেলে এবং পণ্য ও সেবার সরবরাহ অপরিবর্তিত থাকলে মূল্যস্ফীতি ঘটে। কারণ, অনেক বেশি টাকা সীমিত পণ্য ও সেবার পেছনে ধাওয়া করে। এতে চাহিদা ও মূল্যস্তর দুটিই বেড়ে যায়।
রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মজুদ চাপ বাড়ছিল।সর্বশেষ কয়েকদিন আগে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের আমদানি দায় শোধ করতে হয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে এবং সে কারণে রিজার্ভ এ কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে।বিশ্বের যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্য বা আমদানি-রপ্তানি বেশি হয়, টাকার অংকে সেই তালিকার শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে নেই রাশিয়া বা ইউক্রেন। কিন্তু দুইটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য রয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশেই জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে। বৈশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবীর যে কোনো দেশের মধ্যে সংঘাতের প্রভাব অন্য দেশগুলোর উপরেও ছড়িয়ে পড়ে, যদিও গত দু'সপ্তাহ যাবৎ বিশেষ বাজারে তেলের দাম অনেকটা কমতির দিকে। সেখানে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম যখন কমছে তখন বাংলাদেশ সরকার কেন তেলের দাম বাড়াল। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়বে, তখন দেশের বাজারে মূল্য সমন্বয়ের চেষ্টা করতে হবে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাবে পরিবহনের ভাড়া বাড়বে। পণ্য পরিবহনে খরচ বেশি হলে সেগুলোর দাম বাড়বে, যাত্রীদের বেশি ভাড়া গুণতে হবে, এমনকি কৃষি উৎপাদনেও খরচ বেড়ে যাবে।
অর্থনীতিরও একটি গতি আছে। একটি নিয়ম কানুন আছে। সামঞ্জস্যের একটি প্রশ্ন আছে। আইন করে কি করা যাবে আমি জানি না। আমার মনে হয় না যে, আইন করে যেটি হয়, মাঝেমধ্যে এটি আরও সমস্যা উদ্রেক করে। সরকার চেষ্টা করছে, টিসিবির মাধ্যমে বিভিন্ন কার্ড দিয়ে কিছুটা হলেও জনদুর্ভোগ এড়াতে চেষ্টা করছে। খুবই দুক্ষজনক। এটি থেকে মানুষের পরিত্রাণ পাওয়া উচিত।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা