বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিনাশী ষড়যন্ত্র এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড
আমরা প্রায়শই বলে থাকি বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য ও সমার্থক তিনটি শব্দ। কিন্তু কেমন করে এটা সম্ভব হলো তা গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আসলে বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশ শব্দের একসূত্রে গ্রথিত হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে নাতিদীর্ঘ ইতিহাস। যে ইতিহাসের রচয়িতা তিনি নিজেই। এই ইতিহাস সৃষ্টির মূলে রয়েছে তার স্বপ্ন, দূরদর্শিতা এবং ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের বিভাজনকে কেন্দ্র করে তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন আঁকেন মনে। সেই স্বপ্নের সফল রূপায়নে তিনি দীর্ঘ ২৪ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। এ আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে ১৯৭১ সালে নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ভারতের প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষায়, ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সেই অবশ্যম্ভাবী ঐতিহাসিক পরিবর্তনটি সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়। তিনি ছিলেন ক্রান্তদর্শী পুরুষ। আপন ব্রতে নিবেদিত কর্মবীর। একটি স্বপ্ন নিয়েই তার যাত্রারম্ভ। যাত্রাশেষও সেই স্বপ্নের রূপায়নে।’ আর এই স্বপ্নের রূপায়নের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশ তিনটি সমার্থক শব্দে পরিণত হয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এমনি একজন নেতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রশ্ন হলো, যে নেতা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের জন্য আদর্শ হয়ে উঠলেন, যার সারা জীবনের রাজনীতি ছিল বাঙালির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি এবং বাংলার স্বাধীনতা তাকে কেন হত্যা করা হলো? এ নিয়ে আলোকপাত করতে হলে ফিরে যেতে হয় ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতিতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনার সাড়ে তিন বছরের নীতি, উদ্যোগ ও কার্যক্রমে।
বঙ্গবন্ধুর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তার উদ্ভবের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ভারতবর্ষ ভাগকে কেন্দ্র করে এই চিন্তার উদ্ভব। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষ ভাগের অসম ম্যাপ রেখা ও পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এই ম্যাপ রেখায় বাংলার বিভক্তি বয়সে তরুণ শেখ মুজিবসহ বাংলার নেতারা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে-বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন মেনে নিতে পারেননি। বাঙালি এই নেতারা চেয়েছিলেন যুক্তবঙ্গ। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কেউই এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। বাংলার বিভক্তিকে মেনে নিয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হলে তাতে বাঙালির যে কোনো লাভ হবে না তা তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব খুব গভীরভাবেই উপলব্ধি করেন। শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের সিরাজ-উদ্-দৌলা হলে ছাত্র ও যুব নেতাদের নিয়ে এক রুদ্ধদার বৈঠকে মিলিত হন। সভায় শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান হতে যাচ্ছে, এই স্বাধীনতা সত্যিকারের স্বাধীনতা নয়। হয়তো বাংলার মাটিতে নতুন করে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মযহারুল ইসলাম, আগামী প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৯৪)।
ওই সভায়ই শেখ মুজিব একটি সংগঠন করার তাগিদ অনুভব করেন। সভায় সিদ্ধান্ত নেন পূর্ব বাংলায় বিরোধী ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করার। মুজিব ঢাকায় ফিরে আসেন। মুসলিম লীগ, বিরোধী ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। গোটা পূর্ব বাংলাব্যাপী প্রস্ততির পর শেখ মুজিবুর রহমান, কমরউদ্দিন আহম্মদ, শামসুল হক, তাজউদ্দিন আহমেদ, তসাদ্দক আহম্মেদের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গঠিত হয় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ। এর সভাপতি মনোনীত হন তসাদ্দক আহম্মদ। এটি ছিল একমাত্র অসাম্প্রদায়িক সংগঠন। যুবলীগের ইশতেহারে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রের অধীনস্ত বিভিন্ন এলাকার পৃথক পৃথক সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশকে সরকার স্বীকার করিয়া নিবেন, জীবন ও সংস্কৃতিকে গড়িয়া তুলিতে এইসব এলাকার সকল ব্যাপারে স্বায়ত্বশাসন মানিয়া লইতে হইবে।’ এর পাঁচ মাস পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে বাংলা, বাঙালি, স্বাধীনতা ও স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে গঠিত হয় ছাত্রলীগ।
বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা কতটা গভীর ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা থেকে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি ভারতীয় প্রতিনিধিমণ্ডলীর নেতা হয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন। ভারতে ফেরার দিন এ প্রতিনিধিদলের বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’ আমাদের এমন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালে তখন আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙালিরা এক হলে কী না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত......... হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দেই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার লোকদের জিজ্ঞেস করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে পাক বাংলা, কেউ বলে পূর্ব বাংলা। আমি বলি- না, বাংলাদেশ।’ (সূত্র: ইন্দ্রপাত, অন্নদা শঙ্কর রায়, বাংলাদেশের হৃদয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৪৬)।
ভারতবর্ষ ভাগের অবসানের পর পাকিস্তান ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। এ কথা বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন। ‘পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হলো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন প্রকাশ্যে কেউ সাহস পায় নাই। যেদিন মারা গেলেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পুরোপুরি প্রকাশ্যে শুরু হয়েছিল।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৭৮)। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ১৯৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেওয়া হলে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংসে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র সবার সামনে উন্মোচিত হয়। শুরু হয় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এ আন্দোলনের শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে এক নম্বর শক্র হিসেবে চিহ্নিত করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ২৪ বছরের এই আন্দোলন-সংগ্রামে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারবাহিকতায় যোগ হয় গণতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ-বৈষম্য, ধর্ম ও ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্বশাসন। এসব ইস্যুতে জনমত সংগঠিত করে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করায় মূখ্য ভূমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত তার দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও কৌশলী নেতৃত্বে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই পরিণত হয় স্বাধীনতার আন্দোলনে। এ আন্দোলন বিভ্রান্ত করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতা ও ভারতবিরোধী কার্ড খেলে। তারা বঙ্গবন্ধুকে বারবার হত্যার চেষ্টা করে। একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার পর প্রথম তিন মাসে তাকে ৪ বার গ্রেপ্তার করা হয়। জীবনের প্রায় ১৪ বছর কাটে তার কারাগারে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মুখে এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে পাকিস্তানের কারাগারে হত্যা পরিকল্পনা করা হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার ব্যাপারে কতটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তা জানা যায় ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় দেওয়া তার ভাষণ থেকে। ভাষণে তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ভাঙার অভিযোগ এনে বলেন, ‘দিস ক্রাইম উইল নট গো আনপানিসড।’ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তারের পর অজ্ঞাত স্থানে এবং পরে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ইয়াহিয়া সামরিক ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধুর ক্যামেরা ট্রায়ালের আয়োজন করেন। প্রহসনের এ বিচারের লক্ষ্য ছিল একটাই, আর তা হলো বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি। বিচার শেষ হয় ৪ ডিসেম্বর। পাকিস্তানের সামরিক বিশেষ আদালতের বিচারে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রহসনের এ বিচার এবং ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক তৎপরতায় এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক প্রবল চাপ এবং ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির রায় কার্যকর করতে পারেনি।
পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় সফল না হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরে তারা সফল হয়। পাকিস্তান ও তাদের আন্তর্জাতিক মিত্র এবং বাংলাদেশি এজেন্টরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি। তাই পাকিস্তান পরাজিত হতে যাচ্ছে এটা জেনেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ঠিক দশ দিন আগে ৬ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় বাংলাদেশ যেন কখনোই স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে না পারে সেজন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ বানানোর ব্যাপারে আলোচনা হয়। অর্থাৎ আমেরিকা বাংলাদেশে খাদ্য সহায়তা বন্ধ করবে এবং যত আন্তর্জাতিক সাহায্যই বাংলাদেশ পাবে তা ওই ঝুড়ির ফুটো দিয়ে পড়ে যাবে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাদের ষড়যন্ত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয় শীতল যুদ্ধ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পশ্চিমা ব্লক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ব্লক। সত্তরের দশকে শীতল যুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লক বাংলাদেশকে সোভিয়েত বলয়ভুক্ত দেশ হিসেবে বিবেচনা করে। সোভিয়েত বলয়ে শেখ মুজিবের মতো এমন একজন জাতীয়তাবাদী নেতার উত্থান, যাকে ১৯৭৩ সালে জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয় তা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখেনি। তা ছাড়া বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার দূরদর্শী চিন্তা থেকে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ও বিভিন্ন পদক্ষেপ সাম্রাজ্যবাদীদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠে। এক বছরের মধ্যে তিনি একটি সেকুলার সংবিধান উপহার দেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারায় ফিরিয়ে আনেন। বাংলাদেশকে উন্নত ও মর্যাদাশীল দেশে পরিণত করার জন্য তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ঘোষণার পরের বছরই ৯ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনসহ বঙ্গবন্ধুর নানা পদক্ষেপে বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দিকেই যাচ্ছিল। আর এটা হলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো তাবেদার রাষ্ট্র বানানো সম্ভব হবে না। এ ছাড়া সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (এসইএটিও) এবং সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (সিইএনটিও) সদস্য হওয়ায় পাকিস্তানই সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। পক্ষান্তরে, সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। এসব বিবেচনায় নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশকে নব্য পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। তারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। দেশের অভ্যন্তরে প্রতিবিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। প্রতিবিপ্লবীরা পাঁচজন সংসদ সদস্য হত্যাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। খাদ্যের জাহাজ ফেরত নিয়ে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়। এমনি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে রাষ্ট্র পরিচালনার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। লক্ষণীয় যে, পাকিস্তান ও তাদের আন্তর্জাতিক মিত্ররা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য বাংলাদেশের প্রতিবিপ্লবী, প্রতিক্রিয়াশীল, বেসামরিক আমলাদের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর কতিপয় সামরিক কর্মকর্তাকে বেছে নেয়। এটি কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড ছিল না। এর নেপথ্যে কাজ করে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার সুদূর প্রসারী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও বাসস এর সাবেক সিটি এডিটর