মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া মানেই বড় দুঃসংবাদ
দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ অতিক্রম করা মানেই বড় দুঃসংবাদ। এতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয় হয়ে ওঠে। গত মে মাসেই এটি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। জুন মাসে তা আরও বাড়ল। দেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বিগত ৯ বছরে এই জুন মাসের মতো এত মূল্যস্ফীতি আর হয়নি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মূলত পাঁচ মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।
গত জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচে ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে তা ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে মূল্যস্ফীতির হার। বিশেষ করে গরিব মানুষের ওপর এই মূল্যস্ফীতির চাপ ১০ শতাংশের বেশি।
আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে। তবে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার কম। কয়েক মাস ধরেই বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বাজারে সব ধরনের পণ্যেরই দাম বাড়তি আছে।
এর ফলে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। এসব কারণে কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য আবারও মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে ছয় মাস ধরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে গত অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল।
তবে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার বর্ষাকালে বিশেষ করে জুলাই থেকে অক্টোবর সময়ে মূল্যস্ফীতি একটু বাড়ে। কারণ, এ সময়ে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ধান, শাকসবজির মৌসুম নয় বলে বাজারে এসবের দাম কিছুটা বাড়ে। মূল্যস্ফীতির চক্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ সময় সাধারণত খাদ্যমূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পায়। প্রায় সবক্ষেত্রেই রয়েছে মূল্যবৃদ্ধির চাপ।
গত জুন মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত দুই ধরনের পণ্যেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এর মানে হলো, চাল-ডাল, তেল-নুন, মাছ-মাংসসহ খাদ্যপণ্য কিনতে গিয়ে মানুষ বেশি চাপে আছে। শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ এই চাপ বেশি অনুভব করছেন। কারণ, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেশি।
বিবিএসের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। একই সময়ে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ।মূল্যস্ফীতি এক ধরনের করের মতো। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের উপর চাপ বাড়ে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা উপরে থাকা বহু মানুষের আবার গরিব হওয়ার শঙ্কা থাকে।এর মানে, যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সেই হারে কাজ অর্থাৎ শ্রমের মূল্য বাড়ছে না। ফলে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। বিশেষ করে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ছে।
গত নভেম্বর মাসে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গত ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। অবশ্য জানুয়ারি মাসে তা আবার ৬ শতাংশের নিচে নেমে যায়। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়, যা মূল্যস্ফীতিকে আরেক দফা উসকে দেয়। মূল্যস্ফীতি আবার ৬ শতাংশে উঠে যায়। সর্বশেষ তিন মাস ধরে চলমান ডলার–সংকট আমদানি ব্যবস্থাকে টালমাটাল করে তোলে। সার্বিকভাবে আমদানিকারকদের আমদানি খরচ বেড়ে যায়। এর ফলে গত মে ও জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের উপরে উঠে গেছে।
আমরা চিন্তিত আগামীতে মূল্যস্ফীতি আরও না বেড়ে যায়।গ্লোবালি চিন্তা করলে এটি সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জাদুর কাঠি কারও হাতেই নেই। সরবরাহ ঘাটতি একটি সমস্যা।আমদানি ও বিক্রির তারতম্যের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।আমাদের ফরেন একচেঞ্জ রিজার্ভ আমাদের জন্য এখন মস্তবড় চ্যালেঞ্জ। এটি যদি সহসা নিচের দিকে নেমে যায় তাহলে আমাদের হাঁটু কাপা শুরু হয়ে যাবে।পাকিস্তান বিপদের মুখে আছে। শ্রীলঙ্কা শেষ হয়ে গিয়েছে।
ব্যুরোক্রেসি থেকে আরম্ভ করে আমাদের সবকিছুতে খরচ কমাতে হবে। আগামী দিনগুলোতে সমস্যা কিন্তু আরও বাড়বে এবং সমস্যাগুলো গ্লোবালি হচ্ছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ অস্থিরতা ইত্যাদি থামবে বলে আমার মনে হয় না। আমার মতে কমপক্ষে দুই কোটি মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা উচিত। ভর্তুকি আসলে সেখানেই দিতে হবে।হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে।মানুষ চিন্তিত আরও একটি বিষয়ে। আগামী দুই বছর পরে বিদেশ থেকে যে ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেটির সুদ দেওয়া শুরু হবে। তখন বাংলাদেশ ফরেন একচেঞ্জের রিজার্ভ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটিই দেখার বিষয়।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়