দূরদর্শিতা, সততা ও সক্ষমতার পদ্মা সেতু
পাঁচ দশকের উন্নয়ন অভিযাত্রা এবং পদ্মা সেতু
মাত্র কিছুদিন আগে আমরা উদযাপন করেছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। ২০২১ সালে মহাকালের এ দুটি মহান ধারা এক মোহনায় এসে উপনীত হয়। এমন এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের পাঁচ দশকের উন্নয়ন ও অর্জন। ১৭ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে প্রদত্ত শুভেচ্ছা বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ বিশ্বনেতারা প্রায় অভিন্ন সুরে বাংলাদেশকে বিশ্বে দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছিলেন, 'Bangladesh is one of the fastest growing economies in the world'. বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষাও বলছে এক সময়ের দরিদ্রতম দেশটি আজ বিশ্বে ৪১তম অর্থনীতির দেশ। বৃটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) এর সমীক্ষা মতে, বর্তমান ধারায় অর্থনৈতিক বিকাশ অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বে ২৫তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ পায় বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি হবে উন্নয়নশীল দেশ।
আর ২০৪১ এর আগেই হবে উন্নত দেশ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৫১ বছরে পা রাখে। কিন্তু ৫১ বছরের পথচলা মসৃণ ছিল না। ২৮ বছরই দেশ শাসিত হয়েছে অন্ধকারের শক্তির দ্বারা। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে যত উন্নয়ন দৃশ্যমান তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্র পরিচালনার সাড়ে তিন বছর এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়ে ১৮ বছরের দূরদর্শী ও সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফসল। বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) প্রণয়ন করে। লক্ষনীয় যে, এটি প্রণয়নের দ্বিতীয় বছরে ১৯৭৪-৭৫ সালে দেশের জিডিপি ৯.৫৯ শতাংশে উন্নীত হয়। ওই সময়েই যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। দীর্ঘ ২১ বছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক ও ছদ্ম গণতন্ত্রী শাসকরা দেশ শাসন করে। ফলে জিয়া, এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার শাসনামলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কখেনোই ৪/৫ শতাংশের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ২১ বছরের লড়াই-সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসুরি জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রাখে। তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে দেশকে আবার উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনেন। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সাড়ে ১৮ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বর্নালী সময়, যা আজও অব্যাহত আছে।
বঙ্গবন্ধুর পরে অর্থনীতি ও উন্নয়ন, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, আইন-শৃঙ্খলা, পররাষ্ট্রনীতিসহ সকল খাতকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। দেশকে পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২৮২৪ ডলারে। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, যা কোভিড-১৯ মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৮ শতাংশের ওপরে। অবকাঠামো, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সমুদ্র এমন কোন খাত নেই যেখানে মাইলফলক অর্জন নেই। এই মাইলফলক অর্জনের তালিকায় আগামী ২৫ জুন যোগ হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু।
অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পদ্মা সেতু এবং সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র
যারা স্বপ্নচারী নেতা তারা স্বপ্ন দেখেন দেশের উন্নয়ন ঘিরে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন দূরদর্শী ও স্বপ্নচারী নেতা। অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা ভেবেই প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। একটি সেতু কতোটা অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করে তা আমরা জেনেছি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমীক্ষা থেকে। সমীক্ষাগুলো বলছে পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ।
এ ছাড়া, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। গড়ে উঠবে সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ অঞ্চলকে ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সাথে যুক্ত করবে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ২০০৯ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়, ২০২২ সালের শুরুতে সেতুটির উদ্বোধন করা হলে ২৪ হাজার যানবহন সেতুটির ওপর দিয়ে যাতায়ত করবে এবং প্রতি বছরই তা বৃদ্ধি পাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ সেতুটির ওপর দিয়ে ৬৭ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণকে কতোটা অগ্রাধিকার দিয়েছেন তা তার সরকারের উদ্যোগগুলো থেকেই বোঝা যায়। ১৯৯৭ সালে তিনি জাপান সফর করেন। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৩ সালে জাপান সফরে যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে জাপান সরকারের সহযোগিতা কামনার কথা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের দুটি সেতুতে তাদের সহযোগিতা চান। একটি রূপসা সেতু এবং অন্যটি পদ্মা সেতু। ১৯৯৯ সালে পদ্মা সেতুর প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। বিশদ সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে জাইকা মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণের সুপারিশ করে। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের পথ চলা সহজ হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে এই সেতুর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্থ হয়। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে পদ্মা সেতু নির্মাণে উৎসাহে ভাটা পড়ে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এ সেতু নির্মাণের গতি শ্লথ হয়। এমনকি তাদের শাসনামলে জাইকা বিশদ সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পদ্মা সেতুর ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি)’ পাস করা হয়নি। এর অন্যতম কারণ ছিল শেখ হাসিনার পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একনেক সভায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের ডিপিপি পাস হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণে জননেত্রী শেখ হাসিনা এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণ অঙ্গীকার আকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য নিউ জিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এইকমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো বিশ্বব্যাংক একটি ‘ব্লাক লিস্টেড’ কোম্পানিকে পরামর্শক নিয়োগের জন্য বার বার সুপারিশ করে। কিন্তু খ্যাতিমান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন মূল্যায়ন কমিটি ‘ব্লাক লিস্টেড’ বলে ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কারণ ছিল ওই কোম্পানি নিজেদের অভিজ্ঞতার ফিরিস্তি দিয়ে যেসব সেতুর ছবি ও কাগজপত্র জমা দিয়েছিল তার সবই ছিল ভূঁয়া।
বিশ্বব্যাংকের বার বার সুপারিশে পরামর্শক নিয়োগ বিলম্বিত হয়। ওই কোম্পানির বাংলাদেশী এজেন্ট ‘কীভাবে পদ্মা সেতু হয়’ বলে হুমকি দেয়। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে, তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দুর্নীতির ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছে, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই দুর্নীতির সাথে জড়িত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অভিযোগের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং বিশ্বব্যাংককেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে বলেন। বিশ্বব্যাংক কানাডিয়ান এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে কানাডিয়ান রয়েল মাউন্টেড পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে। পরবর্তীতে কানাডিয়ান আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করেন। বিশ্বব্যাংককের ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্তে সবাই হতবাক। আসলে এর নেপথ্যে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। ঋণ বাতিলের এই সিদ্ধান্ত শুধু বিশ্বব্যাংকের একার নয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কুশীলবদের প্রভাব এতে কাজ করেছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিল পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর বিশ্লেষণ করলে তা আরও স্পষ্ট হবে।
পুনরায় ঋণ পেতে বিশ্বব্যাংক সরকারকে একের পর শর্ত দিতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের দাবী অনুসারে সরকার সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে কারাগারে যেতে হয়। তিনি চাকুরিও হারান। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহামানকে ছুটিতে যেতে হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে কোন ইতিবাচক সাড়াতো দূরের কথা তারা সৈয়দ আবুল হোসেন, মশিউর রহমানকে গ্রেপ্তারের জন্য চাপ দিতে থাকে। সৈয়দ আবুল হোসেনের কোম্পানী সাকোর অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে বলে। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে পুনরায় ঋণ পেতে নেপথ্যের ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে প্রধানমন্ত্রী কঠোর অবস্থান নেন। তিনি ২০১২ সালের ৮ জুলাই জুলাই জাতীয় সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। এটি ছিল সাহসী উচ্চারণ এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, যা দেশ-বিদেশে সকল মহল কর্তৃক সমাদৃত হয়।পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ, ঋণ চুক্তি বাতিল এবং নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রশ্নে দুটি ধারা পরিলক্ষিত হয়।
একটি ধারার সঙ্গে যুক্ত আন্তর্জাতিক একটি মহল, দেশের বিরোধী রাজনীতিক, সুশীল সমাজের একটি অংশ। বিশ্বব্যাংকের আনীত দুর্নীতির অভিযোগের স্বপক্ষে তাদের অবস্থান ও ভূমিকা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় এর নেপথ্যে অন্য উদ্দেশ্য কাজ করেছে। আর তা হলো ২০১৪ সালের জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত করা। গণমাধ্যমে প্রতিদিন তাদের এমন সব বক্তব্য-বিবৃতি ও লেখা প্রকাশ পেতে থাকে যা মনে করিয়ে দেয় ১৯৩০ দশকে হিটলারের জার্মানির প্রচার বিভাগের প্রধান ইয়োজেফ গোয়েবলসের কথা। তিনি বলেছিলেন যে, একটি মিথ্যাকে দশবার সত্য হিসেবে তুলে ধরা হলে যাদের কাছে সেটা বলা, তারা সেটাকে সত্য হিসেবেই মেনে নেবে। তবে এই অপপ্রচারের বিপরীতে সেদিন আরেকটি ধারার সাথে যুক্ত অর্থনীতিবিদ ও লেখকরা নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণে যুক্তিনির্ভর তথ্য-উপাত্ত এবং উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। প্রাসঙ্গিকভাবে আমি এখানে উল্লখ করছি সেই সব অর্থনীতিবিদ ও লেখকদের মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক ড. আবুল বারকাত, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ও বিশিষ্ট লেখক বুদ্ধিজীবি ডা. এস এ মালেক এবং খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালিন গভর্নর ড. আতিউর রহমানের কথা, যাদের গবেষণা ও লেখনি এবং উদ্যোগ নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। স্মৃতি যদি বিশ্বাস ঘাতকতা না করে কারো ভুলে যাবার কথা নয় ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ‘নিজ অর্থে পদ্মা সেতু‘ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে পঠিত বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাতের গবেষণাধর্মী মূল প্রবন্ধকে উদ্ধৃত করে পরের দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘নিজস্ব অর্থয়নেই চারটি পদ্ম সেতু সম্ভব’ শিরানামে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার কথা। তিনি তার মূল প্রবন্ধে হিসাব কষে দেখিয়ে দেন ১২টি উৎস থেকে চার বছরে ৯৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা সংগ্রহের কথা। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগের পক্ষে সাফাই গাওয়া সুশীল সমাজের কেউ কেউ একে অবাস্তব ও কল্পনাপ্রসূত বলে উড়িয়ে দেন।
আমি ধন্যবাদ জানাই ড. আবুল বারকাতকে এজন্য যে, তিনি তাদের বিবৃতিগুলো তার লেখা ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগ’ গ্রন্থে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আমি গ্রন্থটি থেকে রাজনীতিক, সুশীল সমাজ খ্যাত ব্যক্তি, অর্থনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের কয়েকটি বিবৃতি ও লেখার শিরোনাম আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। ‘এ সরকারের আমলে আর পদ্মা সেতু হবে না’—বেগম খালেদা জিয়া (৩০ জুন, ২০১২, দৈনিক মানব জমিন), `Padma bridge with local fund is not possible’,---Mirza Fakrul (১২ জুলাই, ২০১২, দ্য ডেইলি স্টার), ‘বিশ্বব্যাংক ছাড়া পদ্মা সেতু লাভজনক হবে না,’- তত্তাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলী খান, বিডিনিউজ ২৪.কম, ২৯ জুলাই ২০১২), ‘স্বপ্নের কুসুম দিয়ে মহাকাশে সেতু তৈরি করবেন প্রধানমন্ত্রী’,--সিরাজুর রহমান, বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান ও দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক খন্ডকালীন উপ-সম্পাদক, ‘পদ্মা সেতু: নতুন সরকারের অপেক্ষা’, প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমদ, প্রাক্তন উপাচার্য, ঢাবি, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ১৩ জুলাই ২০১২), ‘বীর দর্পে ভোঁ দৌড়’, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি অধ্যাপক ড. শাহদীন মালিক, প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট ২০১২। এদের বিবৃতি এবং লেখনির মোদ্দা কথা ছিল শেখ হাসিনার সরকারের দুর্নীতির কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার বিষয়টি হাস্যকর ও অসম্ভব ব্যাপার। দুর্নীতির বিষয়টিকে আড়াল করতেই এ ধরনের ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। কারণ কেঁচো খুড়তে সাপ বের হতে পারে।
এ জন্য দুর্নীতি প্রতিরোধের কাজে হাত দিতে চাচ্ছে না সরকার। আর বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবি প্রফেসর এমাজউদ্দিনের লেখার শিরোনামই বলে দেয় পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য তারা নতুন সরকার অর্থাৎ বিএনপি সরকারের অপেক্ষায় আছে। এসব আলোচনা সমালোচনার মধ্যেই ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা এবং আইডিবিকে লেখা দুটি পত্রে তাদের কাছে ঋণ চেয়ে আবেদন প্রত্যাহারে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। ২০১৫ সাল থেকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়। এই নির্মাণযজ্ঞ চলার মধ্যেই কানাডার ফেডারেল কোর্টের রায়ে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তাদের রায়ে বলা হয়, ‘এক নম্বর তথ্যদাতা পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির যে অভিযোগ এনেছেন তা মূলত গুজবের ওপর ভিত্তি করে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সাত বছরে নিজস্ব অর্থায়নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়।
ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে স্বপ্নজয় এবং কিছু পর্যবেক্ষণ
পদ্মা সেতু কেবলই একটি সেতু নয়, এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসিকতা ও সততার প্রতীক। এটি তার স্বপ্নজয়ের সেতু। ষড়যন্ত্রকে পদদলিত করে নিজস্ব অর্থায়নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক সক্ষমতা সৃষ্টির উজ্জ্বলতম উদাহরণ ও ইতিহাস সৃষ্টির পদ্মা সেতু। এই সেতু কারও কাছে স্বপ্নের, কারও কাছে গর্বের, কারও কাছে জাতীয় মর্যাদার। আবার একজন মূমূর্ষু রোগীর মনের প্রবল ইচ্ছা পূরণের সেতু এটি।
সংবাদটি গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে। ২০২২ সালের ৫ মে লিভারের জটিলতায় আইসিইউতে থাকা একজন রোগী পিতার কাছে পদ্মা সেতু দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে। সন্তানের ইচ্ছা পূরণে পিতা তাকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে পদ্মা সেতু দেখাতে নিয়ে যান। সেদিন সে অ্যাম্বুলেন্স থেকেই প্রাণভরে দেখেছে নান্দনিক সৌন্দর্যের পদ্ম সেতু।বিশ্বে অনেক বড় বড় সেতু নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এমন কোন দেশ আছে কী যারা দেশের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণে একটি সেতু নির্মাণ করতে যেয়ে সুশীল সমাজ ও রাজনীতিকদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেছে? আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ ছাড়া এমন উদাহরণ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশকে পদ্মা সেতু নির্মাণ ঘিরে অপরাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছে। গোটা বিশ্ববাসী তা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে। কিন্তু কেন এই ষড়যন্ত্র? পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণ বাতিলের ঘটনাবহুল ইতিহাস থেকে এ সম্পর্কে কিছুটা ধারনা পাওয়া গেলেও ষড়যন্ত্রের গভীরতা বোঝার জন্য কিছু পর্যবেক্ষণ এখানে তুলে ধরছি:এক. এই ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে। যাতে যুক্ত হয় দেশের বিরোধী রাজনীতিক, সুশীল সমাজের কতিপয় ব্যক্তি এবং আন্তর্জাতিক একটি মহল। দুঃখজনক হলো দেশের সুশীল সমাজের অনেকেই বিবৃতি ও লেখনির মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের সাথে সুর মিলিয়ে পদ্মা সেতুতে সরকারের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগকে সত্য বলে প্রচারে সচেষ্ট হন। দুই. একজন নবেল লরিয়েট এর তৎপরতার কথা প্রায় সকলেরেই জানা। তিনি একটি বিদেশী প্রভাবশালী রাষ্ট্রে জোর লবিং করেন এবং সেই রাষ্ট্রটি বিশ্বব্যাংকের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে ঋণ বাতিল করান। উল্লেখ্য, এক/এগারোতেও ওই ব্যক্তিসহ সুশীল সমাজের এই অংশটি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে চেয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখেও ওই একই মহল অত্যন্ত সক্রিয় হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের কপালে দুর্নীতির কলঙ্ক তিলক এঁকে দেওয়া, যাতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হতে না পারে। তিন. বিরোধী দল বিএনপি-জামাতের হাতে আন্দোলনের অস্ত্র তুলে দেওয়াও ছিল এই ষড়যন্ত্রের অংশ, যাতে তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। চার. আন্তর্জাতিক প্রভাবে ঋণ বাতিলে বিশ্বব্যাংক এতটাই ডেসপারেট ছিল যে, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক বোর্ডের কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই ঋণ বাতিল করেন। সাধারণত ঋণ অনুমোদন এবং বাতিল করা হয় বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে। কিন্তু পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুসারে হয়নি। পাঁচ. একটি ‘ব্লাক লিস্টেড’ কোম্পানিকে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ ছিল রহস্যজনক। ওই কোম্পানির বাংলাদেশী এজেন্ট ‘কীভাবে পদ্মা সেতু হয়’ বলে হুমকিও দেয় এবং পরবর্তীতে সে বাংলাদেশ থেকে উধাও হয়ে যায়। ‘ব্লাক লিস্টেড’ কোম্পানিরর সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের পক্ষে এই অবস্থান দুর্নীতি নয় কি? ছয়. ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের পদ্মা সেতুতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ দিতে চেয়েছিল এডিবি। কিন্তু হঠাৎ করে বিশ্বব্যাংক বিশাল অঙ্কের ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতির ঘোষণা দিয়ে প্রকল্পের লিড ডোনার হয় এবং পুরো প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এ নিয়ে এডিবি’র ক্ষোভের কথাও শোনা গিয়েছিল।
কিন্তু বিশ্বব্যাংকের লিড ডোনার হতে আগ্রাসী মনোভাব কিসের ইঙ্গিত বহন করে? সাত. নকশা পরিবর্তনের যৌক্তিক কারণ ছাড়াও বিলম্বের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং মূল্য স্ফীতির কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। পদ্মা সেতুর সর্বশেষ নকশায় রেল লাইন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ লাইন, শক্তিশালী নদী শাসন যোগ করা হয়। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জমির পরিমাণ আগের চেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়। এসব কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিলের কারণে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হতে তিন বছর দেরি হয়। ফলে পণ্য মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রকল্পের ব্যয়ও অনেক বেড়ে যায়। তিন বছর আগে সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নির্মাণ ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার চেয়ে অনেক কম হতো। সুতরাং এ ব্যয় বৃদ্ধির দায় বিশ্বব্যাংক এড়াতে পারে না। এ ছাড়া ভাবমূর্তি বিনষ্টের দায়ও তারা এড়াতে পারে না। আজকের এই আলোচনা সভার মাধ্যমে ‘ব্লাক লিস্টেড’ কোম্পানির সাথে বিশ্ব্যাংকের দুর্নীতির যোগসূত্র খুঁজে বের করার পাশাপাশি তিন বছর বিলম্বের কারণে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে যে পরিমাণ ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে তা বিশ্বব্যাংকের কাছে দাবী কারার জন্য সরকারকে অনুরোধ করছি।
পরিশেষে, উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, লক্ষ্য বাস্তবায়নে যদি সৎ ও আন্তরিক থাকা যায় এবং আত্মা যদি ভয়হীন হয় সেখানে ব্যর্থতা আসতে পারে না। পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন তার উজ্জ্বলতম উদাহরণ। সেতুটি নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন সৎ এবং আন্তরিক। আর তাইতো তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন পদ্মা সেতুতে একটি টাকাও দুর্নীতি হয়নি। এ কথা একজন সৎ রাষ্ট্র নেতার পক্ষেই তা বলা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বে পাঁচ জন সৎ রাষ্ট্রনায়কদের একজন। তার সততার অসংখ্য উদাহরণ আছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে যে উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন তা এক অর্থে ব্যতিক্রমী। কারণ যড়যন্ত্র ও চ্যালেঞ্জ মেকাবেলা করে এই সেতু অর্থনৈতিক সক্ষমতার এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যা বিশ্বে তুলনাহীন। আর তাই পদ্মা সেতু একদিকে যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা, সাহসিকতা ও সততার প্রতীক অন্যদিকে অর্থনৈতিক সক্ষমতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টির অনন্য দৃষ্টান্ত। এই সেতু আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করেছে ।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক