মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়াই হোক বাজেটের মূল লক্ষ্য
এবারের বাজেট এমন একটি সময়ে প্রণীত হচ্ছে, যখন কি না বাংলাদেশের অর্থনীতি বাইরের থেকে এবং ভেতরের থেকে বেশ একটি চাপের মুখে আছে। কোভিড থেকে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চাপগুলি বাড়ছে।
প্রথমত আমরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যেসকল পণ্য আমদানি করে থাকি, সেই পণ্যগুলির দাম অনেক বেড়ে গিয়েছে। সরবরাহ কম এবং সরবরাহে অস্থিতিশীল একটি বাজার সৃস্টি হয়েছে। পণ্য পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাওয়াতে আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়েছে। সেটির ফলে আমাদের মুল্যস্ফীতির উপরে একটি চাপ পড়েছে। যেহেতু জ্বালানি তেল ,গম, ভুট্টা ,চিনি,ডাল ইত্যাদি পণ্যের দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে।
সুতরাং আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির চাপ কীভাবে কমানো যায় এবং মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে মানুষকে কীভাবে নিষ্কৃতি দেওয়া যায়, সেটিই একটি অন্যতম বড় পদক্ষেপ হওয়া উচিত। একটি বিষয় হচ্ছে বাজারে দাম কেন বাড়ে? সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে একটি পার্থক্য থাকলে দাম বেড়ে যায়। যেহেতু সরবরাহের উপরে একটি চাপ আছে, কাজেই সেটি নিশ্চিত করাটাই একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। যেগুলি পণ্য আমরা আমদানি করে থাকি, সেগুলি যথেষ্ট পরিমাণে দ্রুত আমদানি করতে হবে।
যেহেতু এই আমদানির উপরে সারাবিশ্বই নির্ভরশীল এবং সারাবিশ্বেই মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে ।কাজেই সবাই কিন্তু পণ্য কিনে রাখার চেস্টা করবে। সুতরাং আমরা আগাম চুক্তি করে রাখতে পারি আন্তর্জাতিক সাপ্লাইয়ারদের সঙ্গে। আমরা অভ্যন্তরীণ পণ্য উৎপাদন করছি, সরকার যে সমস্ত পণ্য উৎপাদন করছে, কৃষকদের ক্ষেত্রে যদি ভর্তুকি লাগে সেক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। কৃষকদের জন্য তাদের পণ্যের দাম দিতে হবে। কৃষক যদি পণ্য উৎপাদন করে দাম না পায়, সে কিন্তু পরের মৌসুমে আর উৎপাদন করবে না। আমাদের সরবরাহের একটি ঘাটতি হবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সরকার যদিও বলছে সরবরাহ ঘাটতি নাই, কিন্তু বাজারে সরবরাহ ঘাটতি আছে। কিছু কিছু প্লেয়ারদের হাতে, যারা ব্যবসায়ী মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। বাজার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনিটরিং করা, মজুতদারি বন্ধ করা, তাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। সরবরাহের পরেও যে কথাটি বলা হয়, হাতে কিছু টাকাই না থাকে তবে তারা কিনবে কী করে? তাদেরকে এবং যারা অতি দরিদ্র তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। তাদেরকে প্রত্যক্ষ অর্থ সহায়তা এবং খোলা বাজারে বিভিন্ন পণ্যের বিক্রির মাধ্যমে তাদেরকে স্বস্তির নিঃশাষ ফেলার সুযোগ করে দিতে হবে।
আমার কাছে মনে হয় এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতির চাপটিই বেশি গুরুত্বপুর্ণ। আমাদের আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়েছে, রপ্তানি আয় অনেক কম, তারপর রেমিটেন্সের প্রবাহ অনেক কম। সুতরাং এখানে আমাদের বানিজ্য ঘাটতি সৃস্টি হয়েছে। চলতি হিসাবের মধ্যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। সেই ঘাটতিগুলি পূরণের জন্য আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে উদ্যোগ নিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, বিলাসী পণ্যের আমদানি, কমিয়ে দিতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার সেটি কম করা অর্থাৎ সাশ্রয়ী হওয়া দরকার।
যেসব ক্ষেত্রে হিসেবের মধ্যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, সেই ঘাটতিগুলি পুরণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে অনেকগুলি পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ এবং অতি ব্যয়রোধে সাশ্রয়ী হওয়ার বিষয়ে যেসকল উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলি যেন দ্রুত বাস্তবায়িত হয়। সেটির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে না যায়, সেটি একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে রেমিট্যান্স কিভাবে বাড়ানো যায়? দেখা যাচ্ছে যে, রেমিট্যান্স সরকারি চ্যানেলে ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে আসে না। সেটি কিন্তু আনঅফিশিয়ালি হুন্ডির মাধ্যমে পাঠায়। এ ব্যাপারেও সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি